সত্য সন্ধানী হযরত সালমান ফারসী (রা•)

সত্য সন্ধানের জন্য যে কজন মনীষী পৃথিবীতে অমর এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিয়ে আজো মানুষের অন্তরকে আন্দোলিত করেন, চিন্তাশক্তিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যান, তাদের মধ্যে অন্যতম হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) পনের বছর বয়স থেকে শুরু হয় তার সত্য ধর্ম অনুসন্ধান প্রক্রিয়াতখন তার নাম ছিল মাহবা পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহান এলাকাভুক্ত রামহরমুজ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তিনিবাবা ছিলেন সেখানকার বড় জমিদারতিনি ছিলেন অগ্নিপূজারী এবং খুবই ধর্মভীরুএকজন পদস্থ এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনদিন ধর্মের একটি সাধারণ কাজেও অবহেলা করতেন নাতার ধর্মানুরাগের জন্যও লোকে তাকে শ্রদ্ধা করতো

বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় মাহবাকে তার স্থলাভিষিক্ত করার সব শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেনছেলেকে কখনো কাছছাড়া করতেন নাএকদিন বিশেষ কারণবশতঃ মাহবাকে তার বাবা খামার দেখবার জন্য পাঠালেনপথিমধ্যে তিনি খ্রীষ্টানদের একটি উপাসনালয় থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে সেখানে ঢুকে দেখলেন তারা নামাজ পড়ছেএর আগে তিনি কখনো বাইরে আসবার এবং লোকদের দেখবার সুযোগ পাননিতাদের নামাজ পড়া, বিনম্র ব্যবহার, রীতি-নীতি এবং প্রাণখোলা ব্যবহার তার খুবই ভাল লাগলোতিনি বাবার আদেশ ভুলে সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করলেন এবং ভাবলেন, তাদের ইবাদতখানায় অন্য মযহাবের লোক প্রবেশ করলে ইবাদতখানা অপবিত্র হয়ে যাবে এবং অগ্নি দেবতার অভিশাপে তারা ধ্বংস হয়ে যাবেকিন্তু এখানে সব মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছেএই নীতিই তো মহান ও শ্রেষ্ঠযদি কেউ ধর্ম চর্চা করে পরকালের শান্তির আশা করে, তবে এই ধর্মই শান্তির ধর্ম

তিনি খ্রীস্টানদের ধর্মমত গ্রহণ করতে চাইলে পাদ্রী বললেন, তাকে জেরুজালেম যেতে হবেকেননা এখানকার রাজ আদেশ মতে কোন অগ্নি উপাসককে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা বেআইনী এবং দণ্ডনীয়এই আদেশ অমান্যকারীকে এখানে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়ে থাকেমাহবা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে এলে বাবা বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেনমিথ্যে বলার অভ্যাস তার ছিল নাতাই তিনি বাবাকে সব খুলে বললেনবাবা প্রথমে বোঝালেনপরে পায়ে শিকল দিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখলেনবাবার এই কঠোর ব্যবস্থায় মাহবার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলপ্রতীজ্ঞা করলেন যে, সত্য সন্ধানে যদি এমন বাধাই আসে তবে তিনি বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সব ত্যাগ করবেন

বন্ধুদের মাধ্যমে মাহবা পাদ্রীর কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, সিরিয়ার কোন যাত্রী কাফেলার খোঁজ পেলে তাকে যেন জানানো হয়পাদ্রী শিকলকাটা যন্ত্র বন্ধুদের মাধ্যমে মাহবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং সিরিয়া যাবার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিলেনযেদিন কাফেলা সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হবে সেদিন তিনি পায়ের শিকল কেটে কাফেলার সাথে মিলিত হলেন এবং সিরিয়ায় পৌঁছে গেলেন

সিরিয়ার প্রধান পাদ্রীর কাছে তাদের ধর্ম গ্রহণ এবং তার খেদমতে থেকে ধর্ম শিক্ষার আগ্রহ জানালেনসে মাহবাকে তার কাছে রেখে দিলপাদ্রীটি ছিল জঘন্য প্রকৃতিরলোকদের দান-খয়রাতের ওয়াজ শোনাতোলোকেরা তার কাছে দান-খয়রাত এনে দিলে সে তা গরীব মিসকীনকে না দিয়ে নিজেই সব আত্মসাৎ করতো সে সাত মটকী সোনা-রূপা লুকিয়ে রেখেছিলএ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে মাহবা উপস্থিত ভক্তদের তার অপকর্ম সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং লুকিয়ে রাখা সোনা-রূপা দেখিয়ে দিলেনএ দুষ্কার্যের জন্য লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে তার লাশ শূলি কাঠে ঝুলিয়ে পাথরের আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন করল

নতুন পাদ্রী নিয়োগ দেয়া হলতিনি ছিলেন খুব ভাল লোক; দুনিয়ার লিপ্সাহীন এবং আখেরাতের প্রতি আকৃষ্টতার সাথে মাহবার সম্পর্ক খুব ভাল ছিলতার মৃত্যুর সময় মাহবা জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাকে কি আদেশ করেন এবং তিনি এখন কার আশ্রয়ে থাকবেনপাদ্রী বললেন, ‘বর্তমানে খাঁটি ধর্ম কোথাও নেই, সকলেই বিকৃত করে ফেলেছেইরাকের মোসেলএলাকায় একজন খাঁটি খ্রীষ্ট ধর্মীয় পাদ্রী আছেন, তুমি তার কাছে চলে যাও

মাহবা বর্ণিত সেই পাদ্রী জিরোমের কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন এবং তার কাছে রয়ে গেলেনজিরোম একজন সত্যিকার আবেদ এবং জাহেদ ছিলেনকিন্তু তিনি ইল্‌ম সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেনদামেশকে থাকাকালে মাহবা তাওরাত, ইঞ্জিল প্রভৃতি আসমানী কিতাব পাঠ করেছিলেনতাছাড়া ঈসায়ী সাহিত্যে মাহবা বেশ বুৎপত্তি লাভ করেনকোন সাধারণ রাহেব তার বাছাইয়ের কষ্টিপাথরে টিকে থাকতে পারতো নাএকমাত্র এই একটি কারণেই জিরোমের কাছে তার শান্তি মিলছিল না শুধু ভাবতে লাগলেন কে তাকে বলে দেবে তার মঞ্জিল কোথায়

একদিন সায়মানা নামে এক ব্যক্তির সাথে তার দেখা হয়তিনি মানভী শাখার এক পাদ্রীতিনি মাহবার কাছে তার মযহাব সম্বন্ধে বক্তৃতা করলেনতিনি আন্তরিকতার সাথে তার মযহাবের আদর্শসমূহ শিক্ষা করতে শুরু করলেনকেননা তার কাছেই ছিল সত্যের অনুসন্ধান করাএ সময় জিরোম মারা গেলেনতার মৃত্যুর আগে মাহবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার পরে আমি কার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করব?’

তিনি মাহবাকে ইরাকেরই নসীবীনএলাকার এক পাদ্রীর খোঁজ দিলেনতিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই পাদ্রীর কাছে থাকলেনতার মৃত্যুকালে মাহবাকে তিনিআমুরিয়ানামক স্থানের এক পাদ্রীর খোঁজ দিলেনসেখানে উপস্থিত হয়ে মাহবা সেই পাদ্রীর কাছে থাকলেনএখানে তিনি সঞ্চয়ের দ্বারা কিছু পশুপাল সংগ্রহ করেনপাদ্রীর মৃত্যুর সময় কারো খোঁজ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘বর্তমানে আমার কাছে খাঁটি একটি প্রাণীরও খোঁজ নেই, যার কাছে আশ্রয় নেবার পরামর্শ তোমাকে দেবঅবশ্য এক নতুন নবীর আবির্ভাবকাল ঘনিয়ে আসছে, যিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর খাঁটি একেশ্বরবাদী আদর্শ নিয়ে আসবেনআরবে জন্মগ্রহণ করবেন এবং উভয় পাশে কাঁকরময় জমি আর মধ্যস্থলে খেজুর বাগানের আধিক্য-এমন এক এলাকায় হিজরত করে সেখানে বসবাস করবেনসে নবীর নিদর্শন এমন হবে যে, তিনি হাদিয়া বা উপঢৌকনস্বরূপ খাদ্য দিলে তা খাবেন কিন্তু সদকা- খয়রাতের বখাবেন না এবং তার কাঁধে মোহরে নবুয়তথাকবেযদি তোমার সাধ্যে কুলায় তবে তুমি সে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করো

পাদ্রীর মৃত্যুর পর মাহবা কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেনএখানে আরবের একদল বণিকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা যদি আমাকে তোমাদের দেশে নিয়ে যাও তবে আমার পশুপাল তোমাদের দিয়ে দেবএতে তারা রাজি হলো এবং মাহবাকে সঙ্গে নিয়ে আসলকিন্তু তারা ওয়াদিল ক্কোবানামক স্থানে পৌঁছে অন্যায়ভাবে তাকে ক্রীতদাসরূপে এক ইহুদীর কাছে বিক্রি করে দিলএরপর তিনি একজন থেকে অপরজনের কাছে বিক্রি হতে থাকলেনএমনিভাবে তিনি তের বা ততোধিক মনিবের হাত বদল হন

শেষে মদীনাবাসী এক ইহুদী মাহবাকে ক্রয় করলে তিনি মদীনায় পৌঁছেনএলাকা দেখে তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এটাই ঐ স্থান যার কথা পাদ্রী বলেছিলেন তখনো হযরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা হতে মদীনায় আসেননিমাহবা অতি যত্নের সাথে তার প্রতীক্ষায় ব্যাকুল থাকতেনএকদিন সে তার মনিবের উপস্থিতিতে খেজুর গাছের উপরে কাজ করছিলেনহঠাৎ এক লোক এসে তার মনিবকে সংবাদ দিল যে, ক্কোবা মহল্লায় মক্কা হতে একজন লোক এসেছেসে নিজেকে নবী বলে দাবি করে মাহবা গাছের ওপর থেকে কথাগুলো শুনতে পানতার শরীর শিউরে ওঠেউত্তেজনায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হনকোন প্রকারে গাছ থেকে নেমে মনিবকে সংবাদটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে মাহবাকে ঘুষি মেরে বলল, তুই কাজে থাক এ সংবাদে তোর দরকার কি? মাহবা বিকালে ক্কোবা মহল্লায় উপস্থিত হয়ে কিছু খাদ্যবস্তু হযরতের সামনে পেশ করলেনহযরত (সাঃ) সে খাদ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন যে, এগুলো সদকা বা দানএ কথা শুনে হযরত (সাঃ) তা সঙ্গীদের দিয়ে দিলেন, নিজে খেলেন নাআর একদিন মাহবা কিছু খাবার নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘আপনি সদকা-খয়রাত গ্রহণ করেন না দেখে আজ আমি এগুলো আপনার হাদিয়াস্বরূপ পেশ করছিহযরত (সাঃ) সঙ্গীগণসহ তা খেলেন

মাহবা ভাবলেন, দুটা নিদর্শন ঠিক হলএরপর একদিন হযরত (সাঃ) বসেছিলেন মাহবা তার পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠ মোবারক দেখার চেষ্টা করতে লাগলেননবীজী তার মনোভাব বুঝতে পেরে কাঁধের কাপড় সরিয়ে ফেললেনমাহবা তার মোহরে নবুয়ত দেখলেন এবং শ্রদ্ধার সাথে চুম্বন করে কেঁদে ফেললেনহযরত (সাঃ) তার সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবা তার জীবনের সুদীর্ঘ কাহিনী শোনালেন এবং তখনই ইসলাম গ্রহণ করলেনমাহবার নাম রাখা হল সালমানতিনি পারস্যের অধিবাসী বলে সাহাবীরা তাকে সালমান ফারসীবলে ডাকেনযে মহাসত্য সন্ধানে অশেষ দুঃখ, কষ্ট, ঘাত-প্রতিঘাত, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা তিনি সহ্য করেছেন, সত্য সন্ধানী অতৃপ্ত আত্মা শত বৎসরেও যার তৃপ্ত হয়নি সেই অতৃপ্ত আত্মা আজ তৃপ্তিতে পরিপূর্ণতখন শুধু হ্নদয় ছাপিয়ে একটি শব্দই সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে প্রভুত্ব করে যাচ্ছিল পেয়েছি

ক্রীতদাসরূপে ইহুদীর কাছে আবদ্ধ থাকায় স্বাধীনভাবে হযরতের (সাঃ) সাহচর্য লাভ সম্ভব হচ্ছিল নাএমনকি বদর এবং ওহুদ যুদ্ধে তিনি শরিক হতে পারেননিতাই হযরত (সাঃ) বললেন, আপনি বিনিময় আদায়ের শর্তে মুক্তি লাভের চুক্তি করে নিনসে মতে তার মনিবের সাথে আলাপ করলে সে তার মুক্তির জন্য দুইটি শর্ত আরোপ করল -(১) তিন বা পাঁচশত খেজুর গাছের চারা সঞ্চয় করে তা রোপণ করতে হবে এবং ঐসব গাছে ফল না আসা পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে (২) চল্লিশ উকিয়াঅর্থাৎ ৬ সেরের অধিক পরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করতে হবে এই দুই শর্ত পূর্ণ করলে তিনি মুক্তি লাভ করবেন বলে চুক্তি সম্পাদিত হল

হযরত (সাঃ) সাহাবিগণকে বললেন, খেজুরের চারা দিয়ে তোমরা সবাই সালমানকে সাহায্য করসে মতে কেউ পাঁচটা, কেউ দশটা করে খেজুরের চারা তাকে দিলেন তিন মতান্তরে পাঁচশত খেজুর চারা জমা হলে হযরত (সাঃ) সালমানকে (রাঃ) গাছ রোপণ করার জন্য গর্ত তৈরি করতে বললেনগর্ত তৈরি হলে হযরত (সাঃ) সেখানে এসে নিজ হাতে গাছগুলো রোপণ করলেন; শুধু একটি গাছ ওমর (রাঃ) রোপণ করলেন আল্লাহর কুদরতে এক বৎসরেই এই ঐ গাছগুলোতে ফল ধরলওমর (রাঃ)-এর লাগানো গাছটিতে এক বৎসরে ফল না ধরায় হযরত (সাঃ) তা উঠিয়ে পুনঃরোপণ করলে ঐ বৎসর তাতে ফল এসে গেলএভাবে প্রথম শর্ত পূরণ হল

এদিকে ডিমের আকারে একটি স্বর্ণ চাকা হযরত (সাঃ)-এর হস্তগত হলে তিনি তা সালমানকে (রাঃ) দিয়ে বললেন, ‘এ দিয়ে আপনার মুক্তির শর্ত পূরণ করুনসালমান (রাঃ) এতটুকু স্বর্ণে শর্ত পূরণ হবে না জানালে নবীজী বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা এর দ্বারাই সম্পূর্ণ আদায় করে দেবেন

বাস্তবিকই যখন শর্ত আদায়ের জন্য ওজন দেয়া হল তখন তা চল্লিশ উকিয়া পরিমাণ দেখা গেলএমনিভাবে দুইটি শর্ত পূরণ হল এবং সালমান (রাঃ) আজাদ হয়ে গেলেনসত্য সাধনার জয়লাভের নিশ্চয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন সালমান ফারসী (রাঃ)

র ও শ ন আ খ তা র
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৯ মে ২০০৮