ফরজ বলতেই মনে করা হয় অবশ্য পালনীয় কিছু একটি কাজ। ফরজ সালাত আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত ইবাদত। এখানে ইচ্ছা করলে পালন করলাম আর ইচ্ছা না থাকলে ছেড়ে দিলাম। এমনটি হয় না। এ ছাড়া সালাত সুন্নত ও নফল সবই আল্লাহর জন্য। তবে রাসূল (সাঃ)-এর অনুকরণে বা তার নির্দেশে আদায় করা হয় বলে একে সুন্নত বলা হয়। গুরুত্বের দিক দিয়ে ফরজ সালাত তুলনাহীন, এর সাথে যাতে অন্য কোনো সালাতের গুরুত্ব সমান মনে না করা হয়, সে জন্য ফরজ সালাত অন্তে রাসূল (সাঃ) এমন কিছু কাজ করতেন যাতে এর পরবর্তী সালাত হতে এর বৈশিষ্ট্য আলাদা হয়ে যায়। হাদিসগুলোর প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায় ফারাক সৃষ্টির লক্ষ্যে রাসূল (সাঃ) সালাম ফেরানোর পর মুকতাদিগণের দিকে ঘুরে বসতেন। এ সময় তিনি তাসবিহ তাহলিলসহ বিভিন্ন ওজিফা পাঠ করতেন। উম্মাতকেও সেগুলো পাঠের প্রতি অনুপ্রাণিত করতেন। সুন্নত-নফল সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি স্থান ত্যাগ করে ঘরে চলে যেতেন।
মুকতাদিগণের দিকে ফিরে বসা সম্পর্কে ইমাম বুখারী একটি অনুচ্ছেদ উপস্থাপন করেছেন। শিরোনামটি হলো সালাম ফেরানোর পর ইমাম মুকতাদিগণের মুখোমুখি হয়ে বসবেন। এ ব্যাপারে সামুরা ইবন জুনদাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) যেকোনো সালাত আদায় করে আমাদের দিকে তার চেহারা ফিরিয়ে বসতেন, (বুখারী ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৭)। আরো বর্ণিত হয়েছে ‘আনাস ইবন মালিক (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (সাঃ) অর্ধ্ব রাত শেষে ইশার সালাতে উপস্থিত হলেন। সালাত শেষে তিনি মুকতাদিগণের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে বললেন, লোকজন সালাত শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে আর আপনারা এখনো সালাতের অপেক্ষায় রয়েছেন। আপনারা যতক্ষণ সালাতের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন, অবশ্যই সালাত আদায়ের সাওয়াব হতে বঞ্চিত হন নাই।’ (বুখারী, প্রাগুক্ত) হাদিসে আরো ইরশাদ হয়েছেঃ আল-বারা ইবন আযিব (রাঃ) বলেন, আমরা যখন রাসূল (সাঃ)-এর পেছনে সালাত আদায় করতাম তখন তার ডান দিকে দাঁড়ানোকে পছন্দ করতাম যাতে তিনি মুখমণ্ডল আমাদের দিকে ফিরিয়ে বসেন। (ইমাম মুসলিম, আস-সাহিহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৭) এ মর্মে আরো বহু হাদিস বর্ণিত রয়েছে যেখানে কোনো বিশেষ সালাতে মুখ ফিরিয়ে বসার কথা উদ্ধৃত হয়নি। বিশেষ করে যেখানে ইশার সালাতের পর রাসূল (সাঃ) ঘুরিয়ে বসেছিলেন বলে সুদৃঢ় প্রমাণ রয়েছে। ফলে এ ধরনের অভিমত পোষণ করা যে কেবল রাসূল (সাঃ) ফজর ও আসরের সালাতের পর ঘুরে বসতেন, অন্য কোনো সালাতে বসতেন না। তা কেবল অবান্তরই নয় সম্পূর্ণ মনগড়া অভিমত বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
কেউ কেউ মনে করেন জোহর, মাগরিব ও ইশার সালাতের পর যেহেতু সুন্নত সালাত আছে ফলে এগুলোর পর ইমাম ও মুকতাদি কারো জন্য বিলম্ব না করে দ্রুত সুন্নতে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত। এমনটি এ অজুহাতে ইমামের জন্য ঘুরিয়ে বসাকেও মাকরূহ বলেন। এ ক্ষেত্রে তারা দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন সাহাবায়ে কিরামের আমলকে। বিশেষ করে আবু বকর ও উমার (রাঃ) সম্পর্কে বলা হয়, তারা সালাত থেকে ফারিগ হওয়ার পর এত দ্রুততার সাথে সুন্নতে দাঁড়াতেন যে মনে হতো তারা উত্তপ্ত বালুর মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। (ফাতাওয়ারে মাহমুদিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৫)
আবু বকর ও উমার (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত এ হাদিসটিকে বিশেষজ্ঞরা জাল বলে অভিহিত করেছেন। হাদিসটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে আবু বকর ও উমার (রাঃ) সম্পর্কে অন্য রিওয়ায়তগুলোর প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায় তারা রাসূল (সাঃ)-এর পেছনে সালাতে দাঁড়ানোর জন্য সেই স্থানটি বেছে নেয়ার চেষ্টা করতেন যেখানে দাঁড়ালে রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা মুবারকের মুখোমুখি হতে পারবেন। উমার (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে কেউ দ্রুত সুন্নত সালাতে দাঁড়াতে গেলে তিনি জোর করে বসিয়ে দিতেন। নিবন্ধের পরবর্তী অংশে হাদিসটি বিশদভাবে বর্ণনা করা হবে। এ ছাড়া তারা উম্মত জননী আয়েশা (রাঃ)-এর একটি উক্তিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়ামিনকাস সালাম তাবারাকতা যাল-জালালি ওয়াল ইকরাম’ এটুকু বলবার সময় হতে অধিক সময় রাসূল (সাঃ) সালাম ফেরানোর পর বসতেন না। (সহিহ - মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৮)
এ হাদিসটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লামা ইবনুল হুমাম বলেন, এ হাদিসটির মর্ম কথা হলো সাধারণভাবে ফরজের পর এ দোয়া পরিমাণ সময় ফারাক করা যাবে। এ থেকে দীর্ঘ দোয়া তাসবিহ তাহলিল আয়াতুল কুরসি ইত্যাদি পাঠের যেসব বর্ণনা রয়েছে সেগুলো সুন্নত সালাত শেষে আদায় করা উচিত। কারণ এগুলো মিলিতভাবে পড়তে বলা হয়নি। (পাদটীকা সুনানি তিরমিজী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৬) আল-বাদাইওয়াস সানাই ‘গ্রন্থকার তো বলেই ফেলেছেন, যে সালাতের পর সুন্নত আছে তার পর বসে থাকা মাকরূহ। (পাদটীকা সুনানি নাসাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯)
ফকিহ ইবনুল হুমাম ও আল বাদাইওয়াস সানাইয়ের গ্রন্থকার ফিকাহ শাস্ত্রে বিশাল ব্যক্তিত্ব হানাফী ফিকাহ শাস্ত্রে তাদের অবদান অপরিসীম। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রে মা আয়েশার (রাঃ)-এর হাদিস এবং সুন্নত সালাতের গুরুত্ব দিতে গিয়ে এ অভিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে যেই হাদিসগুলো রয়েছে, হাদিসের ইমামগণ এর আলোকে যেই সব অনুচ্ছেদ উপস্থাপন করছেন সেগুলোর প্রতি গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করেননি। এমনকি বলতে বাধ্য হচ্ছি ফরজ ও সুন্নতের মাঝে ফারাক করার যে তাকিদ রয়েছে সেগুলোও বুঝার চেষ্টা করেননি। ফকিহ সাহাবি মুয়াবিয়া (রাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে জুমার ফরজ আদায়ের পর অনতিবিলম্বে সুন্নতে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বললেন, এভাবে করবে না। কারণ রাসূল (সাঃ) আমাদের আদেশ করেছেন, ফরজ সালাতের সাথে অন্য কোনো সালাতকে মিলিয়ে না পড়তে। হয় উভয়ের মাঝখানে কথা বলব, না হয় মসজিদ হতে বেরিয়ে গিয়ে সুন্নত পরে পড়ব। ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৮) বিশিষ্ট সাহাবি আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা কি ফরজ সালাতের পর সুন্নতের জন্য আগ-পিছ হতে অথবা ডানে বামে স্থান বদল করতে অক্ষম হয়ে যাও? (সুনানু আবি দাউদ ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৪)
নিম্মোক্ত হাদিসটির প্রতি লক্ষ্য করুন, একজন সাহাবি কিভাবে ফরজ সালাত শেষে রাসূল (সাঃ) মুসল্লিগণের প্রতি ফিরিয়ে বসতেন তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। দু’শ্রেণীর সালাতের মাঝে ফারাক না করার দরুন এক মুসল্লি উমার (রাঃ)-এর তোপের মুখে পড়েছিলেন। আজরাক ইবন কায়স (রাঃ) বলেন, আমাদের ইমাম আবু রিদছাহ (রাঃ) একদিন সালাত আদায়ের পর বললেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর পেছনে একদিন সালাত আদায় করলাম। এতে আবু বকর ও উমার (রাঃ) প্রথম কাতারে ডান দিকে শরিক ছিলেন। সালাতান্তে রাসূল (সাঃ) এমনভাবে ডানে বামে সালাম ফেরালেন আমরা তার গালের শুভ্রতা প্রত্যক্ষ করলাম। অতঃপর তিনি বললেন, আমি যেভাবে আপনাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছি রাসূল (সাঃ) ও সেভাবে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। প্রথম রাকাত থেকেই এক লোক সালাতে অংশগ্রহণ করেছিল। সে জামায়াত শেষ হতেই সুন্নাতে দাঁড়িয়ে গেল। উমার (রাঃ) তাৎক্ষণিক তার প্রতি এগিয়ে গিয়ে কাঁধে নাড়া দিয়ে বললেন, বসুন। আহলে কিতাবগণ ধ্বংস হয়েছে, কারণ তাদের সালাতে ফরজ ও নফলের মাঝে কোনো তারতম্য ছিল না। বিষয়টি রাসূল (সাঃ) তাকিয়ে দেখলেন এবং মন্তব্য করলেন হে খাত্তাব পুত্র। আল্লাহ তোমাকে সঠিক কাজের তাওফিক দিয়েছেন। (আবু দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৪) এই যদি হয় উমার (রাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি তাহলে কি করে এ কথাটি বানানো হলো যে, ফরজ শেষ করেই আবু বকর ও উমার (রাঃ) দ্রুত সুন্নতের প্রতি ধাবিত হতেন।
ফরজ সালাত শেষে রাসূল (সাঃ) কোন কোন সূরা ও কোন আয়াত পাঠ করতেন। এ ব্যাপারে বহু হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, তাসবিহে ফাতিমি, আয়াতুল কুরসি, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ইত্যাদি পাঠ করার কথা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত আছে। সুতরাং যারা মনে করেন ফরজ সালাত শেষে দ্রুত সুন্নাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত, তারা হয়তো শারিয়াতের ‘ইবাদতগুলোর শ্রেণীভেদ বুঝতে চান না। এ ছাড়া বর্ণিত আছে ফরজ সালাত শেষে দোয়া কবুল হয়। সালাত শেষে রাসূল (সাঃ) থেকে বহু ধরনের দোয়া বর্ণিত আছে। সেগুলো সালাতের শেষেই পড়তেন বলে প্রমাণিত। পরিতাপের সাথে আরো একটি কথা বলতে হয়, দোয়া বলতে মনে করা হয় হাত উঠিয়ে সম্মিলিতভাবে ইমাম সাহেব কর্তৃক কিছু বলা। কিন্তু হাদিস তা সমর্থন করে না। সালাত শেষে সম্মিলিতভাবে আমাদের সমাজে পরিচিত মুনাজাত যদি সুন্নাহ সমর্থিত হতো তাহলে হাদিসে স্পষ্টভাবে না হলেও ইঙ্গিতেও এ ব্যাপারে কোনো বর্ণনা থাকত। হাদিসে বর্ণিত আছে সালাত শেষে রাসূল (সাঃ) কোন কোন দোয়া পড়তেন এবং কোন কোন প্রয়োজন আল্লাহর দরবারে উত্থাপন করতেন।
ফয়সল আহমদ জালালী
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৩ মে ২০০৮