মহান আল্লাহ পাকের এটি একটি বড় রহমত যে, যখন কোন ব্যক্তি তার স্মরণে প্রবৃত্ত হয় তখন সে ক্রমশঃ আল্লাহপাকের নিকট থেকে নিকটতর হতে থাকে। আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের এটিই সহজ রাস্তা যে, বান্দা তাকে বেশী বেশী স্মরণ করবে। আল্লাহ পাকের কাছে এজন্য বান্দার শুকরিয়া জানানো উচিত। আল্লাহপাক বলেন, যখনই তোমরা আমাকে স্মরণ করবে- বান্দা তখনই তোমার রব তোমাকে স্মরণ করবেন আর আল্লাহর স্মরণের আওতায় কোন বান্দার পড়ে যাওয়ার মত সৌভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন-
আল্লাহ ও তার বান্দার মধ্যে নিকটতম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমই হল স্মরণ। উভয়ের মধ্যে যখন সম্পর্কের আদান প্রদান শুরু হয়ে যায় তখন আর এই দুয়ের মাঝে কোন হেযাব থাকে না। আর পরস্পর পরস্পরকে স্মরণ করা ভালবাসার উৎকৃষ্টতম নমুনা।দুনিয়ার মানুষের মধ্যে বহুভাবে ভালবাসার বন্ধন গড়ে উঠে। জন্মসূত্রে যেমন মা-বাবা থেকে সন্তানাদি। বৈবাহিক সূত্রে যেমন স্বামী-স্ত্রী, শশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-শালিকা, দেবর-জা। আত্মীয়তা সূত্রে ভাগিনা, ভাগিনি, চাচা, মামা ইত্যাদি। এরকম যে কেউ কোন একজনকে ভালবাসে তো তাকে সময়ে সময়ে স্মরণ করে। দুরে চলে গেলে তার জন্য ঋববষ হয়। চিঠি বা ফোন কলের মাধ্যমে হলেও তাকে কাছে রাখতে চায়। তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যদি কোন খারাপ সংবাদ পায়। সবার েেত্র অবশ্য এরকম হয়না কেবল যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নীবিড় তাদের ব্যাপারে এমন উতলাভাব মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যেই দেখা যায়।
আল্লাহর জিকিরও এমন একটা খরহশ যেটা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে যোগসূত্র ঘটায়। আল্লাহর জিকির মানুষের জন্য সহজ করে দেয় যেন সে তার প্রভুর প্রতি বিনীত হয়। স্মরণের সবচেয়ে বেশী ফায়দা হল যে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা তার গভীর থেকে গভীরতর হবে- কেননা মুমিনদের অন্তরে তো কেবল আল্লাহর ভালবাসাই থাকবে। মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত হয় জিকিরে।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেন- আমার কোন বান্দা যখন আমার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য তার হাতকে বাড়িয়ে দেয় আমি তখন আমার বাহুকে বাড়িয়ে দেই, সে যদি এক হাত বাড়ায় আমি তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দেই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত- হুযুর (সাঃ) বলেন, আল্লাহ পাক তার বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আমার বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে আমিও তাকে স্মরণ করি। সে যদি একাকী স্মরণ করে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। সে যদি কোন মজলিসে স্মরণ করে আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম ফেরেস্তাদের মজলিশে স্মরণ করি।
আল্লাহ সুবহানাতালার ভালবাসা পাওয়া যদি জীবনের ল্য হয়ে থাকে তাহলে মুমিনকে সে লইে তার দৈনন্দিন কার্যসূচী তৈরী করে নেয়া উচিৎ। আর এ জন্য ২৪ ঘন্টাই হবে নির্ধারিত, কোন বিশেষ দিন বা মুহুর্ত বা উপল্য নয়। শুধু জুমার দিন, শুধু রোজার মাস, শুধু কুরবানীর মাসই হবে আল্লাহর ভালবাসায় উৎসর্গকৃত, বাকী সময় কি তবে শয়তানের জন্য? নিশ্চয়ই নয়। কেননা আল্লাহর প্রকৃত গোলামেরা তাঁর স্মরণ থেকে এক মুহুর্তের জন্যও গাফেল হয় না।
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
তারা দাড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি কুশলতা নিয়ে ভাবে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি কোন কিছুই অনর্থক বানাওনি। তুমি পবিত্র, আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রা কর।” (আলে এমরান ঃ ১৯১)
আল্লাহর জিকির যত বেশী বেশী হবে কলব তত পরিচ্ছন্ন হবে- হাদীস শরীফে এসেছে আমাদের শরীরের মধ্যে বাম স্তনের নীচে এক টুকরা মাংসপিণ্ড আছে যার নাম কলব- আমরা যত পাপ করি তাতে একটি একটি করে দাগ পড়ে, এভাবে কলবে মরিচা ধরে যায়। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে সেই মরিচা পরিস্কার হয়। আল্লাহ পাক বলেন- আল্লাহর স্মরণ কলবের প্রশান্তি’। যে কলবে আল্লাহর যিকির হবে সে কলব তাজা হবে, হবে প্রশান্তিময়। শয়তান সেখানে আশ্রয় প্রশ্রয়তো দুরের কথা এর ত্রিসীমানায় যেতে পারবেনা। ফলে সেখানে গুনাহের দাগ পড়বে না। অসৎ কর্ম, অসৎচিন্তা সেখানে বিলকুল জায়গা পাবেনা। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন আল্লাহ আল্লাহ শব্দে হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ দ্বারা রক্তনালিসমূহে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। Heart সুস্থ থাকে
সমস্ত ইবাদতে আল্লাহর স্মরণ ঈড়সসড়হষু এসেছে কেননা এটি সমস্ত ইবাদতের প্রাণ। নামাজের প্রতিটি আরকাম আহকাম. উঠবস, রুকু, সেজদা, কিয়াম, ছালাম সবখানে আল্লাহর স্মরণ। তেলাওয়াত, তছবিহ, তাশাহুদ সবই সেই মহান স্বত্তার স্মরণে। যতণ বান্দাহ নামাজে থাকে ততণ আল্লাহর স্মরণের আওতায় থাকে। আল্লাহর শেখানো বাক্য ছাড়া নামাজে নামাজী একটি বাক্যও নিজ থেকে বলেনা।
একই ভাবে রোজার উদ্দেশ্যও আল্লাহর স্মরণ। ছেহরী থেকে ইফতার পর্যন্ত অভূক্ত থেকে বান্দাহ সেই মহান স্মরণ সারাদিন অন্তরে জাগরুক রাখেন বলে রোজা থেকে সে আল্লাহর হুকুম লংঘন করার স্পর্ধা পায়না, মিথ্যা বলেনা, গালা-গালি করেনা, উদ্ধত আচরণ থেকে বিরত থাকে, দান ছাদাকায় ব্যাপৃত হয়। বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করে মন ও জবানকে পবিত্র রাখে। কামনা বাসনার উপর লাগাম পরায়।
হজ্বের ব্যাপারেও একই কথা। কাবার দর্শন অভিলাষ চরিতার্থ করতে মুমিন হজ্বে যায়না-কিংবা হজ্বের উদ্দেশ্য এটিও না যে দীর্ঘ সফর করে মুমিন কিছু দেখা হয় নাই চু মেলিয়া’ এমন ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলী দেখতে যায় বরং কাবার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে অন্তরের দীদার লাভের জন্য মুমিন দুর দুরান্ত থেকে ছুটে আসে, এহরামের পোষাক পড়ে, হালাল কাজও হারাম করে দেয় শুধু আল্লাহকে রাজীখুশী করার জন্য।
কাজেই আল্লাহর যিকির হচ্ছে নির্যাস। এটি যখন যে ইবাদতের গোড়ায় পড়ে তখন সেই ইবাদত পরিপুষ্টি লাভ করে।
حَقِيقٌ عَلَى أَن لاَّ أَقُولَ عَلَى اللّهِ إِلاَّ الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُم بِبَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَرْسِلْ مَعِيَ بَنِي إِسْرَائِيلَ - قَالَ إِن كُنتَ جِئْتَ بِآيَةٍ فَأْتِ بِهَا إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ
তোমার রবকে স্মরণ কর রোদনের সাথে ভীতি বিহ্বল চিত্তে, অনুচ্চ বাক্যে, সকালে ও সন্ধায়। কখনো কোথাও (এ ব্যাপারে) গাফেল হয়োনা। যারা রবের সান্নিধ্য পেতে চায়, তারা অহংবোধে ইবাদাত বিমূখ হয়না বরং তাঁর মহিমা ঘোষণা করে আর তাঁর প্রতি সিজহদাবনত হয়।” (আরাফ ঃ ১০৫-১০৬)
কেবল ইবাদত বন্দেগীতে আল্লাহর নাম নেওয়াই যিকির নয় বরং পার্থিব প্রত্যেকটি কাজে তার হুকুমের অনুস্মরণ করাও যিকির। এজন্য কুরআনে হাকীমের অপর নাম জিকির করা হয়েছে। কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত, অর্থ অনুধাবন এবং বাস্তব জীবনে এর অনুশীলনও জিকিরের অন্তর্ভূক্ত।
দুনিয়ার সকল কাজে যেখানে আল্লাহর যিকির থাকবে সেখানেই সফলতা। সেটা ব্যবসা হোক, চাকুরী হোক, শিকতা বা ডাক্তারী যাই হোক। আল্লাহর হুকুম মেনে আল্লাহকে ভয় করে চলবে- আল্লাহপাক উন্নতি দেবেন।
যিনি ব্যবসায়ী তিনি জমীনে ব্যবসা করতে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার অর্থ ওজনে কমবেশী করবেন না, ভেজাল মিশাবেন না, গুদামে মাল জমা করে কৃত্রিম ভাবে মূল্য বৃদ্ধি ঘটাবেন না। সৎ ও সততার ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করবেন। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করবেন না। যিনি সরকারী আমলা তিনি চাকুরী স্থলে বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ সরকারী দপ্তরের সম্পদকে নিজের মাল ভেবে পকেটস্থ করবেন না- সততার সাথে আমানত রা করবেন, ঘুষ রিসওয়াতের বদলায় সরকারী সম্পদের অপচয় করবেন না। এভাবে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পেশার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং নিজ নিজ আঙ্গিনায় মহান রব আল্লাহর হুকুমের বাস্তবায়ন করবেন। এটিই তার জন্য জিকির, এটিই তার জন্য ইবাদত। তখন তা আর শুধু দুনিয়াদারী হবে না। দুনিয়ার কাজ করলেও এটি তার জন্য উত্তম ইবাদত হিসাবেই আমল নামায় লিপিবদ্ধ হবে।
আল্লাহর যিকিরের এটিতো কেবল বাহ্যিক আমলের দিক। আর একটি দিক রয়েছে নির্জনতায় আল্লাহকে গভীর ভাবে স্মরণ করার। আল্লাহ পাক যদি ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু হন তাহলে বান্দা তার আশেক। আশেক মাশুকের মিলনের জন্য চাই নির্জনতা। কোলাহলময় স্থানে অভিসার হয়না। দুনিয়ার প্রেমিক যুগল যদি অভিসারের জন্য গোপনীয়তাকে বেছে নিতে চান তাহলে আল্লাহর প্রেম তো অনেক উর্ধ্বে, সেজন্য নির্জনতা তো বাঞ্ছনীয়। এ জন্য আল্লাহপাক নিজেই তার হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
পান্তরে আল্লাহর স্মরণের জন্য রাতের সুবিধাটি আলোকিত ও কোলাহলময় দিনের চেয়ে বেশী। কাজ কর্মের ব্যস্ততার জন্য দিনের বেলা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর স্মরণের জন্য বসা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক নিজেই এর স্বপে যুক্তি দিচ্ছেন- রাত্রির জাগরণ অপোকৃত কঠিনতো বটেই।
إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا - إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْءًا وَأَقْوَمُ قِيلًا - إِنَّ لَكَ فِي اَلنَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا - وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا
প্রকৃত পে রাতের বেলা বিছানা ছাড়া খুবই কষ্টকর কিন্তু পড়ার জন্য উপযুক্ত। দিনের বেলা রয়েছে দীর্ঘ কর্মবস্ততা। এই সময় তুমি তোমার রবের নাম স্মরণ কর- সব কিছু থেকে মনকে ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে সেদিকেই মন লাগাও।” (মুজাম্মিল ঃ ৬ - ৮)
আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সম্পর্ক করতে হলে গভীর রাতের তাহাজ্জুদ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। গোটা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী পতংগ, গাছপালা তরুলতা যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন আপনি আরামের বিছানা ছেড়ে স্রষ্টার গভীর সানিধ্য পেতে নিদ্রা ভেঙে উঠুন। আল্লাহপাকের আরশ রাত যত গভীর হয় ততই কর্মচঞ্চল হয়। আল্লাহপাক নিকট আসমানে অবস্থান করেন আর বান্দাদের ডাকতে থাকেন- ও বান্দা! কে আছিস গুনাহ মাফের জন্য, প্রয়োজন পুরণের জন্য। আশেক আর মাশুকের মিলনের জন্য এ সময়টা খুবই উপযুক্ত সময়। আল্লাহপাক বলেন-
তাহাজ্জুদ তো নামাজ নয়-নামাজের ছলে আশেক মাশুকের ভাব বিনিময়। আল্লাহর সাথে সরাসরি-প্রেম বিনিময়ের একমাত্র উপায়। আপনার আর আল্লাহর মাঝে অন্তরাল ছাড়া কথাবার্তা বলার উপায় হল তাহাজ্জুদ।
হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন রাসুল (সাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলনের আকাংখা করাকে পছন্দ করে আল্লাহপাকও তার সাথে মিলনের আকাংখাকে পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলনকে পছন্দ করে না আল্লাহও তার সাথে মিলন পছন্দ করেন না। (মুসলিম)
এরকম একই নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে এসেছে এভাবে-
সুতরাং জিকির কখন হবে আর জিকিরে কি উচ্চারণ করবেন তা স্পষ্ট ভাবে আল্লাহপাক বর্ণনা করেছেন।
জিকিরের অনেকগুলো উপায় আছে যেমন তাছবিহ-তাহলিল, তেলওয়াতে কুরআন, নামাজ ও সর্বশেষ এস্তেগফার।
তাছবীহ মানে আল্লাহর প্রসংশা করা। আল্লাহপাকের পবিত্রতার ঘোষণায় হামদ ও বড়ত্ব প্রকাশ করা। বোখারী শরীফের সর্বশেষ হাদীসে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করেন এমন দুটি বাক্য আছে যা করুণাময় আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়, উচ্চারণে হালকা কিন্তু ওজনে খুবই ভারী। বাক্য দুটি হল- সুবহানাল্লাহি অবেহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল আযীম।
আর একটি তাছবীহকে আল্লাহর রাসুল আল বাকিয়াতুছ ছোলেহাত’ চিরস্থায়ী ছওয়াবের বস্তু বলেছেন। সেটি হল- আল্লাহু আকবার কাবিরান, আলহামদু লিল্লাহে কাছীরান, সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওআছীলা।
আল্লাহর জিকির ও প্রশংসা আলোচনার জন্য যখন বান্দারা মিলিত হয়, মজলিশ বা সভা কায়েম করে আল্লাহপাক তার উপর রহমত নাজিল করেন। ফেরেশতাদের দ্বারা ঐ মজলিশ ঘিরে রাখেন। যারা এ রকম মজলিশে যোগ দিতে দুর দুরান্ত থেকে আসেন তাদের সম্মানে ফেরেশতারা নুরের পলক বিছিয়ে দেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত- হুজুর (সাঃ) বলেন- আল্লাহ পাকের অসংখ্য ভ্রাম্যমান ফেরেশতা রয়েছে যারা জিকিরের মজলিশ তালাশ করেন। এমন মজলিশের সন্ধান যখন পান তখন সাথে সাথে তারা পরস্পর বাহুবন্ধনে মজলিশ ঘিরে রাখেন। মজলিশ শেষ হলে লোকেরা যখন বাড়ী ফিরে যায়, ফেরেস্তাকুল রিপোর্ট নিয়ে আসমানে উঠে যায়। আল্লাহপাক যদিও সব কিছু জানেন তবুও জিজ্ঞাসা করেন তোমরা কোথা থেকে আসলে? ফেরেস্তারা জবাব দেন ওগো মাবুদ! জমীনের এমন এক স্থান থেকে আমরা এসেছি যেখানে তোমার কিছু সংখ্যক বান্দাকে দেখলাম তোমার প্রসংশা করছে, তোমার জিকির করছে, তাদের গুনাহ মাফ চাইছে আর দোয়া চাইছে। আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করেন- তারা কি প্রার্থনা করছে? ফেরেশতারা বলে, তারা আপনার কাছে বেহেশত চাইছে। আল্লাহপাক বলেন তারা বেহেশত দেখেছে কি? ফেরেশতারা বলেন, না। তারা দোযখের আগুন থেকে আশ্রয় চায়। দোযখ কি দেখছে নাকি? ফেরেশতারা বলেন, না। অতঃপর ফেরেশতারা বলেন মাবুদ- ঐ লোকটাকেও মা করে দাও যে বাজারে যাওয়ার পথে মজলিশে বসেছিল- আল্লাহপাক বলেন মা করে দিলাম। (মুসলিম)
আল্লাহপাক বলেন-
আবু মুসা (রাঃ) বর্ণিত- রাসুল (সাঃ) বলেন, যে ঘরে আল্লাহর স্মরণ করা হয় আর যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় না তাদের পার্থক্য হল প্রথমটি জিবিত আর দ্বিতয়িটি মৃত ঘর।
আল্লাহপাকের স্মরণ বা জিকির এক অমূল্য নেয়ামত। যে ব্যক্তি এই নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছে আল্লাহ পাকের দরবারে তার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়েছে তার জন্য আল্লাহর প থেকে রয়েছে দুর্ভোগ এবং দুঃসহ শাস্তি।
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া মানেই শয়তানের খপ্পরে পড়ে যাওয়া। মানুষের আমৃত্যু শত্র“ শয়তান যখন কারো ঘনিষ্ঠ সহচর বনে যায় তখন সে বিভ্রান্তির দোলাচলে দুলতে থাকে। তার কাছে মনে হয় ঠিক পথটিই সে অনুসরণ করে চলছে, প্রকৃতপে সে বিপরীত দিকেই ধাবিত হচ্ছে। অবশেষে ভুল বুঝতে পেরে যখন শয়তানকে ধিক্কার দেবে, তখন তা আর কোন কাজে আসবে না।
অতএব মুমিন বান্দার উচিত তার জীবনের সকল কর্মকাণ্ডে আল্লাহর স্মরণকে অগ্রে স্থান দেয়া। যে কোন কাজের শুরুতেই যদি ভাবা হয় এই কাজটিতে আল্লাহ খুশি হবেন কিনা তাহলে সব কাজই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, গুনাহ হতে পারে না। এরকম পরিশুদ্ধতা, পবিত্রতাই আল্লাহ পছন্দ করেন। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্য তাঁর স্মরনের (জিকির) কোন বিকল্প নেই।
মু. শামসুজ্জামান
এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জোন প্রধান
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
কুমিল্লা জোন।
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِي وَلاَ تَكْفُرُونِ
তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অস্বীকারকারী হয়োনা।” (সুরা বাকারা ঃ ১৫২)আল্লাহ ও তার বান্দার মধ্যে নিকটতম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমই হল স্মরণ। উভয়ের মধ্যে যখন সম্পর্কের আদান প্রদান শুরু হয়ে যায় তখন আর এই দুয়ের মাঝে কোন হেযাব থাকে না। আর পরস্পর পরস্পরকে স্মরণ করা ভালবাসার উৎকৃষ্টতম নমুনা।দুনিয়ার মানুষের মধ্যে বহুভাবে ভালবাসার বন্ধন গড়ে উঠে। জন্মসূত্রে যেমন মা-বাবা থেকে সন্তানাদি। বৈবাহিক সূত্রে যেমন স্বামী-স্ত্রী, শশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-শালিকা, দেবর-জা। আত্মীয়তা সূত্রে ভাগিনা, ভাগিনি, চাচা, মামা ইত্যাদি। এরকম যে কেউ কোন একজনকে ভালবাসে তো তাকে সময়ে সময়ে স্মরণ করে। দুরে চলে গেলে তার জন্য ঋববষ হয়। চিঠি বা ফোন কলের মাধ্যমে হলেও তাকে কাছে রাখতে চায়। তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যদি কোন খারাপ সংবাদ পায়। সবার েেত্র অবশ্য এরকম হয়না কেবল যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নীবিড় তাদের ব্যাপারে এমন উতলাভাব মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যেই দেখা যায়।
আল্লাহর জিকিরও এমন একটা খরহশ যেটা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে যোগসূত্র ঘটায়। আল্লাহর জিকির মানুষের জন্য সহজ করে দেয় যেন সে তার প্রভুর প্রতি বিনীত হয়। স্মরণের সবচেয়ে বেশী ফায়দা হল যে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা তার গভীর থেকে গভীরতর হবে- কেননা মুমিনদের অন্তরে তো কেবল আল্লাহর ভালবাসাই থাকবে। মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত হয় জিকিরে।
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা ঈমানদার তাদের চিত্ত প্রশান্ত হয় জিকির দ্বারা। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে চিত্ত প্রশান্তকারী।” (রাদ ঃ ২৮)আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেন- আমার কোন বান্দা যখন আমার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য তার হাতকে বাড়িয়ে দেয় আমি তখন আমার বাহুকে বাড়িয়ে দেই, সে যদি এক হাত বাড়ায় আমি তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দেই। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত- হুযুর (সাঃ) বলেন, আল্লাহ পাক তার বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আমার বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে আমিও তাকে স্মরণ করি। সে যদি একাকী স্মরণ করে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। সে যদি কোন মজলিসে স্মরণ করে আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম ফেরেস্তাদের মজলিশে স্মরণ করি।
আল্লাহ সুবহানাতালার ভালবাসা পাওয়া যদি জীবনের ল্য হয়ে থাকে তাহলে মুমিনকে সে লইে তার দৈনন্দিন কার্যসূচী তৈরী করে নেয়া উচিৎ। আর এ জন্য ২৪ ঘন্টাই হবে নির্ধারিত, কোন বিশেষ দিন বা মুহুর্ত বা উপল্য নয়। শুধু জুমার দিন, শুধু রোজার মাস, শুধু কুরবানীর মাসই হবে আল্লাহর ভালবাসায় উৎসর্গকৃত, বাকী সময় কি তবে শয়তানের জন্য? নিশ্চয়ই নয়। কেননা আল্লাহর প্রকৃত গোলামেরা তাঁর স্মরণ থেকে এক মুহুর্তের জন্যও গাফেল হয় না।
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
তারা দাড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি কুশলতা নিয়ে ভাবে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি কোন কিছুই অনর্থক বানাওনি। তুমি পবিত্র, আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রা কর।” (আলে এমরান ঃ ১৯১)
আল্লাহর জিকির যত বেশী বেশী হবে কলব তত পরিচ্ছন্ন হবে- হাদীস শরীফে এসেছে আমাদের শরীরের মধ্যে বাম স্তনের নীচে এক টুকরা মাংসপিণ্ড আছে যার নাম কলব- আমরা যত পাপ করি তাতে একটি একটি করে দাগ পড়ে, এভাবে কলবে মরিচা ধরে যায়। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে সেই মরিচা পরিস্কার হয়। আল্লাহ পাক বলেন- আল্লাহর স্মরণ কলবের প্রশান্তি’। যে কলবে আল্লাহর যিকির হবে সে কলব তাজা হবে, হবে প্রশান্তিময়। শয়তান সেখানে আশ্রয় প্রশ্রয়তো দুরের কথা এর ত্রিসীমানায় যেতে পারবেনা। ফলে সেখানে গুনাহের দাগ পড়বে না। অসৎ কর্ম, অসৎচিন্তা সেখানে বিলকুল জায়গা পাবেনা। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন আল্লাহ আল্লাহ শব্দে হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ দ্বারা রক্তনালিসমূহে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। Heart সুস্থ থাকে
সমস্ত ইবাদতে আল্লাহর স্মরণ ঈড়সসড়হষু এসেছে কেননা এটি সমস্ত ইবাদতের প্রাণ। নামাজের প্রতিটি আরকাম আহকাম. উঠবস, রুকু, সেজদা, কিয়াম, ছালাম সবখানে আল্লাহর স্মরণ। তেলাওয়াত, তছবিহ, তাশাহুদ সবই সেই মহান স্বত্তার স্মরণে। যতণ বান্দাহ নামাজে থাকে ততণ আল্লাহর স্মরণের আওতায় থাকে। আল্লাহর শেখানো বাক্য ছাড়া নামাজে নামাজী একটি বাক্যও নিজ থেকে বলেনা।
একই ভাবে রোজার উদ্দেশ্যও আল্লাহর স্মরণ। ছেহরী থেকে ইফতার পর্যন্ত অভূক্ত থেকে বান্দাহ সেই মহান স্মরণ সারাদিন অন্তরে জাগরুক রাখেন বলে রোজা থেকে সে আল্লাহর হুকুম লংঘন করার স্পর্ধা পায়না, মিথ্যা বলেনা, গালা-গালি করেনা, উদ্ধত আচরণ থেকে বিরত থাকে, দান ছাদাকায় ব্যাপৃত হয়। বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করে মন ও জবানকে পবিত্র রাখে। কামনা বাসনার উপর লাগাম পরায়।
হজ্বের ব্যাপারেও একই কথা। কাবার দর্শন অভিলাষ চরিতার্থ করতে মুমিন হজ্বে যায়না-কিংবা হজ্বের উদ্দেশ্য এটিও না যে দীর্ঘ সফর করে মুমিন কিছু দেখা হয় নাই চু মেলিয়া’ এমন ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলী দেখতে যায় বরং কাবার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে অন্তরের দীদার লাভের জন্য মুমিন দুর দুরান্ত থেকে ছুটে আসে, এহরামের পোষাক পড়ে, হালাল কাজও হারাম করে দেয় শুধু আল্লাহকে রাজীখুশী করার জন্য।
কাজেই আল্লাহর যিকির হচ্ছে নির্যাস। এটি যখন যে ইবাদতের গোড়ায় পড়ে তখন সেই ইবাদত পরিপুষ্টি লাভ করে।
حَقِيقٌ عَلَى أَن لاَّ أَقُولَ عَلَى اللّهِ إِلاَّ الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُم بِبَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَرْسِلْ مَعِيَ بَنِي إِسْرَائِيلَ - قَالَ إِن كُنتَ جِئْتَ بِآيَةٍ فَأْتِ بِهَا إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ
তোমার রবকে স্মরণ কর রোদনের সাথে ভীতি বিহ্বল চিত্তে, অনুচ্চ বাক্যে, সকালে ও সন্ধায়। কখনো কোথাও (এ ব্যাপারে) গাফেল হয়োনা। যারা রবের সান্নিধ্য পেতে চায়, তারা অহংবোধে ইবাদাত বিমূখ হয়না বরং তাঁর মহিমা ঘোষণা করে আর তাঁর প্রতি সিজহদাবনত হয়।” (আরাফ ঃ ১০৫-১০৬)
কেবল ইবাদত বন্দেগীতে আল্লাহর নাম নেওয়াই যিকির নয় বরং পার্থিব প্রত্যেকটি কাজে তার হুকুমের অনুস্মরণ করাও যিকির। এজন্য কুরআনে হাকীমের অপর নাম জিকির করা হয়েছে। কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত, অর্থ অনুধাবন এবং বাস্তব জীবনে এর অনুশীলনও জিকিরের অন্তর্ভূক্ত।
দুনিয়ার সকল কাজে যেখানে আল্লাহর যিকির থাকবে সেখানেই সফলতা। সেটা ব্যবসা হোক, চাকুরী হোক, শিকতা বা ডাক্তারী যাই হোক। আল্লাহর হুকুম মেনে আল্লাহকে ভয় করে চলবে- আল্লাহপাক উন্নতি দেবেন।
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে- জমীনে রুজী তালাশের জন্য ছড়িয়ে পড়। আর একাজে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (জুমা ঃ ১০)যিনি ব্যবসায়ী তিনি জমীনে ব্যবসা করতে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার অর্থ ওজনে কমবেশী করবেন না, ভেজাল মিশাবেন না, গুদামে মাল জমা করে কৃত্রিম ভাবে মূল্য বৃদ্ধি ঘটাবেন না। সৎ ও সততার ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করবেন। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করবেন না। যিনি সরকারী আমলা তিনি চাকুরী স্থলে বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ সরকারী দপ্তরের সম্পদকে নিজের মাল ভেবে পকেটস্থ করবেন না- সততার সাথে আমানত রা করবেন, ঘুষ রিসওয়াতের বদলায় সরকারী সম্পদের অপচয় করবেন না। এভাবে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পেশার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং নিজ নিজ আঙ্গিনায় মহান রব আল্লাহর হুকুমের বাস্তবায়ন করবেন। এটিই তার জন্য জিকির, এটিই তার জন্য ইবাদত। তখন তা আর শুধু দুনিয়াদারী হবে না। দুনিয়ার কাজ করলেও এটি তার জন্য উত্তম ইবাদত হিসাবেই আমল নামায় লিপিবদ্ধ হবে।
আল্লাহর যিকিরের এটিতো কেবল বাহ্যিক আমলের দিক। আর একটি দিক রয়েছে নির্জনতায় আল্লাহকে গভীর ভাবে স্মরণ করার। আল্লাহ পাক যদি ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু হন তাহলে বান্দা তার আশেক। আশেক মাশুকের মিলনের জন্য চাই নির্জনতা। কোলাহলময় স্থানে অভিসার হয়না। দুনিয়ার প্রেমিক যুগল যদি অভিসারের জন্য গোপনীয়তাকে বেছে নিতে চান তাহলে আল্লাহর প্রেম তো অনেক উর্ধ্বে, সেজন্য নির্জনতা তো বাঞ্ছনীয়। এ জন্য আল্লাহপাক নিজেই তার হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ- قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا- نِصْفَهُ أَوِ انقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا- أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
হে কম্বলাচ্ছাদিত! উঠ! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধ রাত্রি অথবা তার চেয়ে অল্প অথবা তার চেয়ে বেশী। আর কুরআন তেলওয়াত কর ধীরে ধীরে সঠিক ভাবে।” (মুজাম্মিল ঃ ১-৪)পান্তরে আল্লাহর স্মরণের জন্য রাতের সুবিধাটি আলোকিত ও কোলাহলময় দিনের চেয়ে বেশী। কাজ কর্মের ব্যস্ততার জন্য দিনের বেলা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর স্মরণের জন্য বসা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক নিজেই এর স্বপে যুক্তি দিচ্ছেন- রাত্রির জাগরণ অপোকৃত কঠিনতো বটেই।
إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا - إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْءًا وَأَقْوَمُ قِيلًا - إِنَّ لَكَ فِي اَلنَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا - وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا
প্রকৃত পে রাতের বেলা বিছানা ছাড়া খুবই কষ্টকর কিন্তু পড়ার জন্য উপযুক্ত। দিনের বেলা রয়েছে দীর্ঘ কর্মবস্ততা। এই সময় তুমি তোমার রবের নাম স্মরণ কর- সব কিছু থেকে মনকে ফিরিয়ে একনিষ্ঠভাবে সেদিকেই মন লাগাও।” (মুজাম্মিল ঃ ৬ - ৮)
আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সম্পর্ক করতে হলে গভীর রাতের তাহাজ্জুদ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। গোটা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী পতংগ, গাছপালা তরুলতা যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন আপনি আরামের বিছানা ছেড়ে স্রষ্টার গভীর সানিধ্য পেতে নিদ্রা ভেঙে উঠুন। আল্লাহপাকের আরশ রাত যত গভীর হয় ততই কর্মচঞ্চল হয়। আল্লাহপাক নিকট আসমানে অবস্থান করেন আর বান্দাদের ডাকতে থাকেন- ও বান্দা! কে আছিস গুনাহ মাফের জন্য, প্রয়োজন পুরণের জন্য। আশেক আর মাশুকের মিলনের জন্য এ সময়টা খুবই উপযুক্ত সময়। আল্লাহপাক বলেন-
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا
রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত। তোমার রব তোমাকে মাকামে মাহমুদে পৌছাবেন।” (বনী ইসরাঈল ঃ ৭৯)তাহাজ্জুদ তো নামাজ নয়-নামাজের ছলে আশেক মাশুকের ভাব বিনিময়। আল্লাহর সাথে সরাসরি-প্রেম বিনিময়ের একমাত্র উপায়। আপনার আর আল্লাহর মাঝে অন্তরাল ছাড়া কথাবার্তা বলার উপায় হল তাহাজ্জুদ।
হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন রাসুল (সাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলনের আকাংখা করাকে পছন্দ করে আল্লাহপাকও তার সাথে মিলনের আকাংখাকে পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলনকে পছন্দ করে না আল্লাহও তার সাথে মিলন পছন্দ করেন না। (মুসলিম)
وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُواْ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَآئِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
আল্লাহর নামের জিকির কর” এর অর্থ হল আল্লাহর বহু সুন্দর সুন্দর নাম আছে সেসব নামে তাকে ডাক। (আরাফ ঃ ১৮০)এরকম একই নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে এসেছে এভাবে-
وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا - وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَيْلًا طَوِيلًا
তোমার রবের নাম স্মরণ কর সকাল ও সন্ধায় এবং রাত্রের কিছু অংশে তার প্রতি সেজদাবনত হও। তার তাছবীহ কর।” (দোহার ঃ ২৫-২৬)قُلِ ادْعُواْ اللّهَ أَوِ ادْعُواْ الرَّحْمَـنَ أَيًّا مَّا تَدْعُواْ فَلَهُ الأَسْمَاء الْحُسْنَى وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلاً
আল্লাহ নামে তাকে ডাক বা রহমান নামেই ডাক না কেন সব সুন্দর সুন্দর নাম তাঁরই।” (ইসরা ঃ ১১০)সুতরাং জিকির কখন হবে আর জিকিরে কি উচ্চারণ করবেন তা স্পষ্ট ভাবে আল্লাহপাক বর্ণনা করেছেন।
জিকিরের অনেকগুলো উপায় আছে যেমন তাছবিহ-তাহলিল, তেলওয়াতে কুরআন, নামাজ ও সর্বশেষ এস্তেগফার।
তাছবীহ মানে আল্লাহর প্রসংশা করা। আল্লাহপাকের পবিত্রতার ঘোষণায় হামদ ও বড়ত্ব প্রকাশ করা। বোখারী শরীফের সর্বশেষ হাদীসে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করেন এমন দুটি বাক্য আছে যা করুণাময় আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়, উচ্চারণে হালকা কিন্তু ওজনে খুবই ভারী। বাক্য দুটি হল- সুবহানাল্লাহি অবেহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল আযীম।
আর একটি তাছবীহকে আল্লাহর রাসুল আল বাকিয়াতুছ ছোলেহাত’ চিরস্থায়ী ছওয়াবের বস্তু বলেছেন। সেটি হল- আল্লাহু আকবার কাবিরান, আলহামদু লিল্লাহে কাছীরান, সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওআছীলা।
আল্লাহর জিকির ও প্রশংসা আলোচনার জন্য যখন বান্দারা মিলিত হয়, মজলিশ বা সভা কায়েম করে আল্লাহপাক তার উপর রহমত নাজিল করেন। ফেরেশতাদের দ্বারা ঐ মজলিশ ঘিরে রাখেন। যারা এ রকম মজলিশে যোগ দিতে দুর দুরান্ত থেকে আসেন তাদের সম্মানে ফেরেশতারা নুরের পলক বিছিয়ে দেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত- হুজুর (সাঃ) বলেন- আল্লাহ পাকের অসংখ্য ভ্রাম্যমান ফেরেশতা রয়েছে যারা জিকিরের মজলিশ তালাশ করেন। এমন মজলিশের সন্ধান যখন পান তখন সাথে সাথে তারা পরস্পর বাহুবন্ধনে মজলিশ ঘিরে রাখেন। মজলিশ শেষ হলে লোকেরা যখন বাড়ী ফিরে যায়, ফেরেস্তাকুল রিপোর্ট নিয়ে আসমানে উঠে যায়। আল্লাহপাক যদিও সব কিছু জানেন তবুও জিজ্ঞাসা করেন তোমরা কোথা থেকে আসলে? ফেরেস্তারা জবাব দেন ওগো মাবুদ! জমীনের এমন এক স্থান থেকে আমরা এসেছি যেখানে তোমার কিছু সংখ্যক বান্দাকে দেখলাম তোমার প্রসংশা করছে, তোমার জিকির করছে, তাদের গুনাহ মাফ চাইছে আর দোয়া চাইছে। আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করেন- তারা কি প্রার্থনা করছে? ফেরেশতারা বলে, তারা আপনার কাছে বেহেশত চাইছে। আল্লাহপাক বলেন তারা বেহেশত দেখেছে কি? ফেরেশতারা বলেন, না। তারা দোযখের আগুন থেকে আশ্রয় চায়। দোযখ কি দেখছে নাকি? ফেরেশতারা বলেন, না। অতঃপর ফেরেশতারা বলেন মাবুদ- ঐ লোকটাকেও মা করে দাও যে বাজারে যাওয়ার পথে মজলিশে বসেছিল- আল্লাহপাক বলেন মা করে দিলাম। (মুসলিম)
আল্লাহপাক বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا - وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا - هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا - تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ وَأَعَدَّ لَهُمْ أَجْرًا كَرِيمًا.
হে ঈমানদাররা! তোমরা বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ কর। সকল সময় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। তিনি তোমার প্রতি রহম করেন। তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। তিনি তোমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে আনেন, তিনি মুমিনদের প্রতি রহীম। যে দিন তারা আল্লাহর সাথে সাাৎ করবে সেখানে তাদের অভিাবদন জানানো হবে। তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন উত্তম প্রতিদান” (আহযাব ঃ ৪১-৪৪)আবু মুসা (রাঃ) বর্ণিত- রাসুল (সাঃ) বলেন, যে ঘরে আল্লাহর স্মরণ করা হয় আর যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় না তাদের পার্থক্য হল প্রথমটি জিবিত আর দ্বিতয়িটি মৃত ঘর।
আল্লাহপাকের স্মরণ বা জিকির এক অমূল্য নেয়ামত। যে ব্যক্তি এই নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছে আল্লাহ পাকের দরবারে তার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়েছে তার জন্য আল্লাহর প থেকে রয়েছে দুর্ভোগ এবং দুঃসহ শাস্তি।
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া মানেই শয়তানের খপ্পরে পড়ে যাওয়া। মানুষের আমৃত্যু শত্র“ শয়তান যখন কারো ঘনিষ্ঠ সহচর বনে যায় তখন সে বিভ্রান্তির দোলাচলে দুলতে থাকে। তার কাছে মনে হয় ঠিক পথটিই সে অনুসরণ করে চলছে, প্রকৃতপে সে বিপরীত দিকেই ধাবিত হচ্ছে। অবশেষে ভুল বুঝতে পেরে যখন শয়তানকে ধিক্কার দেবে, তখন তা আর কোন কাজে আসবে না।
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ - وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُم مُّهْتَدُونَ.
যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তান মানুষকে সৎপথ থেকে সরিয়ে রাখে অথচ মানুষ মনে করে সে সৎপথেই চলছে।” (যুখরুফ ঃ ৩৬-৩৭)অতএব মুমিন বান্দার উচিত তার জীবনের সকল কর্মকাণ্ডে আল্লাহর স্মরণকে অগ্রে স্থান দেয়া। যে কোন কাজের শুরুতেই যদি ভাবা হয় এই কাজটিতে আল্লাহ খুশি হবেন কিনা তাহলে সব কাজই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, গুনাহ হতে পারে না। এরকম পরিশুদ্ধতা, পবিত্রতাই আল্লাহ পছন্দ করেন। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্য তাঁর স্মরনের (জিকির) কোন বিকল্প নেই।
মু. শামসুজ্জামান
এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জোন প্রধান
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
কুমিল্লা জোন।