ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা

চরমপন্থার প্রতিকার
এখন আমরা চরমপন্থার প্রতিকার এবং তার উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমেই এ বিষয়টি বুঝে নেয়া দরকার যে, প্রতিকার চরমপন্থার কারণ থেকে অবিচ্ছিন্ন। এর কারণগোলো যেমন বিভিন্ন ও জটিল তেমনি এর প্রতিকারগুলোও। বলা বাহুল্য, কোনো যাদুস্পর্শে চরমপন্থার অবসান ঘটানো যাবে না কিংবা তাদেরকে মধ্যপন্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমাদের কাছে চরমপন্থা ও গোঁড়ামি-এর মনস্তাত্ত্বিক, সামজিক ও রাজনৈতিক দিকসহ একটি অদ্ভুত ধর্মীয় সমস্যা। সুতরাং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এর সবগুলো দিক বিবেচনা করতে হবে।
আমি তাদের সাথে একমত নই যারা কেবল সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে এই অদ্ভুত সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত করে যুব সমাজের আচরণ ও পদক্ষেপগুলো উপেক্ষা করতে চান। আবার সমাজ, সরকার, সরকারী বিভাগ, বিশেষত শিক্ষা ও প্রচার মাধ্যমকে সকল দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে কেবর যুব সমাজকে দোষ দেয়া অন্যায়। দায়িত্বটা আসলে পারস্পরিক এবং প্রতিটি পক্ষের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমরা সকলে তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্থ ব্যক্তিদের অভিভাবক এবং দায়িত্বশীল।” (বুখারী)
আমরা এখন চরমপন্থা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সমাজের পরিপূরক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান যুগের অন্তর্গত পরস্পর বিরোধিতা ও অরাজক অবস্থা এবং ইসলাম থেকে মুসলমানদের বিচ্যুতি চরমপন্থা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অতএব, এই সামজকেই এর প্রতিকারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে, ইসলামের প্রতি তাদের আন্তরিক, সুদৃঢ় ও সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার নবায়ন করা। এটা কেবল মৌখিক ঘোষণা, কিছু মনোহর শ্লোগান অথবা সংবিধানে ‘ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করে নয়, বরং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ঘনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
আমরা জানি, ইসলাম এমন একটি সার্বিক জীবন বিধান যা মানুষের মধ্যে ঐশী বৈশিষ্ট্যকে বিকশিত করতে চায়। এ জন্যে ইসলাম জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে আদর্শিক কাঠামো, পথ-নির্দেশ ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এর আওতায় থাকলে মানুষের এবাদত-বন্দেগী, মনমানস, আইন-বিধান এক সৌন্দর্যময় রূপ লাভ করে, এক সুবিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে ওঠে। তাই প্রকৃত ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসরাঈলদের মতো খন্ডিতভাবে নয়। আল্লাহ তায়লা কুরআনুল করীমে বলেন:
“তাহলে তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে জিল্লতি আর কিয়ামতের দিনে তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।” (২:৮৫)
সুতরাং ইসলামী চরিত্রের সমাজ কায়েম করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তথা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ র বিধান ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ প্রয়োগ করতে হবে। এটাই ঈমানের প্রকৃত দাবী। কুরআনের ঘোষণা:
“কিন্তু না, তোমার প্রভুর শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।”(২৪:৫১)
আমরা ইসলামকে ঐশী বিধান হিসেবে মানি। কিন্তু বাস্তব জীবনে শরীয়াহকে প্রয়োগ করি না। তার জায়গায় আমরা পূর্ব ও পশ্চিম থেকে ধার করা ব্যবস্থা চালু করেছি, তবুও আমরা মুসলমান বলে দাবী করি! সমাজ থেকে এই সুষ্পষ্ট পরস্পর বিরোধিতা অবশ্যই দূর করতে হবে।
সুতরাং আমেদের শাসকদের অনুধাবন করতে হবে যে, তারা মুসলিম ভূখন্ড শাসন করছেন এবং মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে শাসিত হওয়ার অধিকার আছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিবুত্তিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
সকল ও আন্তর্জাতিক নীতি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে। মুসলিম শাসকরা যদি এই ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন তবে তা হবে চরম ইসলাম বিরোধিতার শামিল। বস্তুত এ বিষয়টির প্রতি মুসলিম শাসকদের উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যে ইসলামী আন্দোলনকারীদের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। এই শাসকরা মসজিদকেও তাদের মতলব হাসিলের কাজে লাগান। কেউ এর বিরোধিতা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। আবার কিছু কিছু শাসক মুসলমান বলে দাবী করেন এবং যা তাদের ধারণা নেহায়েত মনগড়া এবং শয়তানী খেয়ালখুশীর নামান্তর। যা তাদের মতলব হাসিলের অনুকূল তা গৃহণ করেন এবং তাদের পছন্দসই নয় তা নির্দ্বিধায় নাকচ করে দেন। তারা যা বিশ্বাস করেন তাকেই “সত্য” বলে ঘোষণা করেন এবং এর বিপরীত সবকিছু বাতিল। তারা কুরআন ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা অস্বীকার করে নিজেরাই এ সবের ব্যাখ্যাতা সাজেন। তারা কোনো বিজ্ঞ আলিম-ওলামার সাথে পরামর্শ করার ধার ধারেন না। তারা প্রত্যেক নিজেকে একেকজন ফকীহ, মুফাসসির, মুতাকাল্লিম ও দার্শনিক ভেবে বসেন।
এ ধরনের মুসলমান শাসক মনে করেন তাদের বিকল্প দ্বীতিয় ব্যক্তি নেই। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) থেকেও কিছু শেখার প্রয়োজন অনিভব করেন না। কুরআন ব্যাখ্যার জন্যে তিনি নিজেকেই যথেষ্ট মনে করেন। অথচ আল্লাহ্ বলেন: “রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে।” (৪:৮০)
অবশ্য এসব শাসক ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী শরীয়াহ প্রয়েগের অনুমতি দেন। রেডিও-টেলিভিশনে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার কিঞ্চিত সুযোগ দিয়ে থাকেন আর সংবাদপত্রে শুক্রবারের জন্যে একটি কালাম বরাদ্দ করেন। এখানে অলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধর্ম কেবল ব্যক্তি সত্তা ও স্রষ্টার সম্পর্কের মধ্যে সীমিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই হচ্ছে অধুনা মুসলিম শাসকদের বিশ্বাস অথাৎ আইন ছাড়া ঈমান, রাষ্ট্র ছাড়া দ্বীন, দাওয়াত ছাড়া ইবাদত এবং সত্যের আদেশ ও মিথ্যার নিষেধ ছাড়া জিহাদের ডাক। এখন কোনো নাগরিক যদি এদের বিরোধিতা কের ইসলামী জীবন বিধান চালুর ডাক দেয় তবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম ও রাজনীতি সংমিশ্রণের অভিযোগ আনা হয়। মোটকথা, শাসকদের কর্যকলাপ আল্লাহ্ , আল্লাহ্ র রাসূর ও তাঁর সাহাবীদের পথের বিপরীত। মুসলিম বিশ্ব এক চরম সন্ধিক্ষণে। অতএব, প্রকৃত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে তা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সমাজে স্থিতিশীলতা আসতে পারে না. পারে না জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, “আমরা নিকৃষ্টতম জাতি ছিলাম। কিন্তু ইসলাম দিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে স্মানিত করেছেন। যদি আমরা ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য পন্থায় মর্যাদা হাসিল করতে চাই তবে আল্লাহ্ আমাদের গোড়া কেটে দেবেন।” সুতরাং শারীয়াহ প্রয়োগ না করা পর্যন্ত আমাদের সমাজে চরমপন্থার বিস্তার ঘটবেই।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে, তরুণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আইভরি টাওয়ার থেকে তাদের উদ্দেশ্যে মুরব্বীসুলভ ভাষণ দিলে চলবে না। তাদের মনমানসিকতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কথা বলতে হয়। নইলে তারা কথা শুনতেই অস্বীকার করবে। তাদের শুধু দোষ দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, তাদের গুণগুলো উপেক্ষা করে দোষগুলোই প্রচার করা হয়।
তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে আরেকটি প্রবণতা রয়েছে। একটা গোষ্ঠীর কেউ একজন দোষ করলে তা সাধারণভাবে সকলের ওপর চাপানো হয়। তরুণদের বেলায় এটি আরো বেশী প্রযোজ্য। একজন তরুণ করলো কী করলো না, অমনি তা সকল তরুণদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া ঘটনা ভাল করে না জেনে হুট করে রায় দেয়ারও প্রবণতা আমাদের রয়েছে। ভাল করে না জেনে না শুনে সংখ্যালঘৃর দোষ সংখ্যাগুরুর ওপর চাপিয়ে দেয়া ন্যায় বিচার নয়। এজন্যে মুসলিম ফকীহরা রায় দিয়েছেন, সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয় তা সার্বিকভাবে প্রযোজ্য, কিন্তু এর বিপরীতটা নয় অর্থাৎ মুষ্টিময়ের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হতে পারে না। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজনের সামগ্রিক কর্মকান্ডের বিচার হতে পারে না। তার সামগ্রিক আচরণের মূল্যায়ন করেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। কারণ কুরআন বলছে: “যার (সৎকর্মের) পাল্লা ভারী, সেই মুক্তি পাবে।” (২৩:১০২)
চতুর্থ, নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে তরুণদের বিচার করা ঠিক নয়। তাদেরকে অনেক মানসিক রোগজনিত খামখেয়ালি বলে ভাবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে সন্দেহাতীত। আসলেই তাদের ঈমান ও আচরণে কোনো দ্বৈততা নেই। আমি অনেক মুসলিম দেশের অনেক তরুণের কথা জানি, তারা ঈমানী জযবায় সুদৃঢ় এবং আমলে-আচরণে সত্যনিষ্ঠ। সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ও মিথ্যার প্রতি তাদের র্ঘণাকে আমি প্রশংসাকরি। তারা সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ ও শারীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্যে কঠোর জিহাদে নিমগ্ন। এই তরুণদের সাথে মেলামেশা করে আমার স্থির বিশ্বাস জম্মেছে যে, আমাদের পোচলিত ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে তাদের চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য আছে। তারা এক নতুন উদ্দীপ্ত ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ যে ইসলাম আমাদের মতো জরাজীর্ণ নয়; তাদের ঈমান সতেজ, আমাদেরটা ঠন্ডা; তাদের সাধুতা সুদৃঢ়, আমাদেরটা করুণ। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ্ র ভয় সদাজাগ্রত- তাদের হৃদয় কুরআনের তিলাওয়াতে সদা স্পন্দিত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থাকে, দিনে রোযা রাখে, প্রত্যুষে আল্লহ্ র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এসব দেখে আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছে যে, ইনশাআল্লাহ্ ইসলাম আবার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্যেই আমি মিসরে বিভিন্ন উপলক্ষে ঘোষনা করেছি, এই তরুণ গোষ্টীই মিসরের প্রকৃত আশার আলো। যে কোনো বৈষয়িক সম্পদের চেয়ে এরা অধিক মূল্যবান।
তাই আমি বিশ্বাস করি, চরমপন্থার প্রতিকার অন্বেষণে আমাদের কথাবার্তায় আচরণে বারসাম্য, সুবিবেচনা ও উদারতা থাকতে হবে। এলোপাথাড়ি অতশয়োক্তি এই অদ্ভুত সমাধানের সহায়ক হবে না, করং এই প্রকণদা ত্রাস সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বড় কথা, সত্য ও প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত, বিচারের মানদন্ডকে দোদুল্যমান এবং সুস্থ চিন্তাকে দূষিত করে। ফলত কনো, তা অন্যায় কিংবা অন্তত অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য।
তাথাকথিত “ধর্মীয় চরমপন্থা” এবং সরকার ও তরুণদের মধ্যে সংঘাতের ফলে উদ্ভুত সংকট মুকাবিলার প্রক্ষিতে যা কিছু বলা বা লেখা হচ্ছে তা বাড়াবাড়ি ও অতিশয়োক্তি মুক্ত নয়। তরুণদের বিরুদ্ধে অনেক মানুষ অসদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত মনোভাব পোষন করে। ঐসব বক্তব্যে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদ আল দ্বীন ইবরাহীম ‘আল-আহরাম’ পত্রিকায় লিখেছেন: যারা এই প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তারা আসল সত্যের ধারে কাছেও নেই। তাদের যুক্তির কোনো সুনিদৃষ্ট ভিত্তিও নেই। তাদের বক্তব্যে অজ্ঞতা ও চরম অবিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যার প্রশ্নে এদের নিশ্চুপ থাকাই শ্রয় ছিলো, নতুবা বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে সমস্যার বিশ্লেষণ করা উচিত ছিলো। কিন্তু এই গুণ বৈশিষ্ট্য তো এদের মধ্যে নেই। এ ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ধর্মীয় ব্যাপারে এসব লোকের মুক্তকচ্ছ, শিথিল ও ঔদাসীন্যের চরমপন্থী মনোভাবই ধর্মীয চরমপন্থা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। মোটকথা, এক শ্রেনির লোকের চরম বিরাগ আরেক শ্রণিকে চরম অনুরাগী করেছে। যদা কোনো বিজ্ঞ প্রচেষ্টা উভয়পক্ষের মতভেদ দূর করে তাদেরকে একত্র করতে ব্যর্ত হয় তাহলে এটাই প্রমানিত হয় যে, সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টর জন্যে এক চরমপন্থা নির্মূলে আরেক চরমপন্থারই প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে একটি ধারণা পাওয়া যায়:
“যদি আল্লাহ্ তায়ালা একটি জনগোষ্টী দিয়ে আরেকটি জনগোষ্টিকে প্রতিহত না করতেন তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো; কিন্তু আল্লাহ্ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল।” (২ : ২৫১)
সুতরাং তরুণ মুসলমানদের প্রতি অভিযোগ অযৌক্তিক, যখন প্রতিপক্ষ চরমপন্থীরা ধর্ম ও নৈতিকতা বিগর্হিত জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে । যেসব তরুণ ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী তাদের জীবন গড়ে তুলতে প্রয়াসী তাদেরকে হেয় করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ অযৌক্তক ও অন্যায়। যেসব তরুণ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে, রোযা রাখছে, দাড়ি রাখছে, গিরার উপর কাপড় পরছে, হালাল হারাম বিবেচনা করছে, ধুমপান থেকে বিরত থাকছে তাদেরকে দোষ দেয়ার বা নিন্দা করার কী যুক্তি থাকতে পারে। অথচ আমরা নীরবে চোখের সামনে দেখি একদল লোক জীবনকে উপভোগ করে চলেছে নির্বিচারে। নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যের এই মানসপুত্ররা সম্পূর্ণ উচ্ছন্নে গেছে। অতএব ধর্মীয় “চরমপন্থার” বিরুদ্ধে “গেলো গেলো রব” তোলা আর “ধর্মহীন চরমপন্থা” র পক্ষে চোখ কান বুজে থাকা যুক্তির কোন্ মানদন্ডে সঙ্গত? মেয়েরা পর্দা করে চলাফেরা করলে উপহাসের পাত্রী হতে হয়; কিন্তু যখন আরেক দল মেয়ে রাস্তাঘাচে, সৈকতে, থিয়েটারে, সিনেমায় প্রায় উলঙ্গভাবে নিজেকে প্রদর্শন করে তখন তাকে “সংবিধানসম্মত ব্যক্তি স্বাধীনতা” ভোগ বলে পার পাওয়া কী উচিত? তাহলে কী ধরে নিতে হবে, সংবিধানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার জন্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আর সতীত্ব ও শালীনতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সমাজ যদি অনৈতিক ও ধর্মহীন তৎপরতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতো তাহলে আমাদের দেশে ধর্মীয় চরমপন্থা’র উদ্ভব হতো না, যদিও কোনো না কোনো কারণে চরমপন্থা বিরাজ করতে তাহলে এর প্রবাব হতো নগণ্য । আমাদের এটা স্বীকার করতে হবে ‘চরমপন্থা’ একটি বিশ্বজনীন ঘটনা; কিন্তু মজার ব্যাপার বিভিন্ন দেশে আন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপ বা সংগঠন থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে এ রকম চরম পদক্ষেপ নেয়া হয় না। কিন্তু যত দোষ কেবল মুসলমানদের বেলায়। তারা চরমপন্থী হলে তাদের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে চরম নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হয়। ইসরাঈলের চরমপন্থী ইহুদীরা মনে করে ঐ ভূমিতে তাদের ঈশী অধিকার রয়েছে এবং এই লক্ষ্যে তারা সকল রকম হিংস্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ খোদ ইসরাঈলের সৃষ্টিটাই অবৈধ এবং সন্ত্রাসী কাজ। লেবাননে খ্রীস্টান ফালাজির চরম সহিংস পন্থায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদের যবাই করছে, তাদের লাশ ক্ষতবিক্ষত করছে, গুপ্ত অঙ্গ কেটে তাদেরই মুখে পুরে দিচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মীয় বইপুস্তক পুড়িয়ে ফেলছে। খ্রীস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তোমার শত্রুকে ভালবাসো, তোমাকে যারা ঘৃণাকরে তাদের ভাল করো, কেউ তোমার ডান গালে চড় মারলে বাম গালও পেতে দাও।” (লুক ৬ : ২৭-২৯)।
এছাড়া আমরা অন্যান্য দেশ, যেমন সাইপ্রাস, ফিলিপাইন ও হিন্দুস্থানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্তাসী তৎপরতা দেখতে পাই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক খ্রীস্টানী সন্ত্রাস শুরু হয়েছে যাকে বলা যায় নতুন ক্রুসেড। প্রতি বছর হিন্দু চরমপন্থীরা মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। পরিহাসের বিষয়, হিন্দুরা প্রাণী হত্যাকে নির্দয় নিষ্ঠুর কাজ বলে মনে করে। এ জন্যে তাদের ধর্মে গরু যবাই নিষিদ্ধ। কিন্তু এরাই আবার ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে চলেছে বেধড়ক! একই কারণে তারা আবাদী জমিতে নাকি কীটনাশক ব্যবহার করে না। লাখ লাখ একর জমির ফসল তাই ইঁদুরের পেটে চলে যায়। তাদের দৃষ্টিতে এসব প্রাণীরও আত্মা আছে, তাই তাদের আঘাত করা যাবে না । তাদের দৃষ্টিতে বোধ হয় একমাত্র মুসলমান নামক প্রাণীরই আত্মা নেই!
একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে, বস্তুবাদ মানুষের চিন্তাও আচরণকে বিকৃত করে ছেলেছে। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের চরম উন্নতি হয়েছে, মানুষ চাঁদেও গেছে, গ্রহান্তরে আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু এসব বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি আত্মার উন্নতি হয়নি। ফলে মানুষ আজ মনের সুখ পাচ্ছে না। এক সমায় তারা মনে করেছিলো বস্তুগত আরাম-আয়েশ লাভ করতে পারলে মনের শান্তিও পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে বালি! তাদের মধ্যে চরম নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। হিপ্পি জাতীয় নানা গ্রুপ নিত্য নতুন গজাচ্ছে তাদের কাছে আধুনিক সভ্যতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তারা এখন প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চায়। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে : আমি কে? আমার লক্ষ্য কি? আমি কোথা থেকে এসেছি? এখন থেকে আমাকে কোথায় যেতে হবে? কিন্তু পাশ্চাত্যের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব নেই । এমনি নৈরাজ্যের প্রতিধ্বনি আমাদের দেশেও শোনা যায় এই প্রশ্নের জবাব নেই। এই প্রশ্নের জবাব পেতে গিয়ে কেউ চরম বিধর্মি হয়ে গেছে, আবার কেউবা সত্য পথের সন্ধান পেয়ে ইসলামের সুশীতল চায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সুখের বিষয়, বহু মুসলিম তরুণ সকল প্রশ্নের সছিক উত্তর ইসলামের মধৈই খুঁজে পেয়ে নিজেদের জীবনকে ইকামতে দ্বীনের জন্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত।
আজকের বিশ্বে চারদিকে হিংসা আর বিদ্রোহের বহ্নি। এর মাঝে শান্তি, নমনীয়তা ও ভারসাম্য প্রত্যাশা করা অসঙ্গত। উৎসাহী তরুণদের কাছ থেকে মিরব্বীদের মতো প্রজ্ঞা ও পরিণত চিন্তা আশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। মানুষ প্রাথমিকভাবে পরিবেশেই সৃষ্টি। গুপ্ত পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা, নির্যাতন ও গুপ্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা, সমালোচনা ও পারস্পরিক পরামর্শের অধিকার দিয়ে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হতে হবে। হযরত উমর (রা)-এর একটি কথায় আমরা এর নযীর পাই: “আল্লাহ্ তাদের রহম করুন যারা আমার ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দেয়।” তাই তিনি তাকে পরামর্শ দানে ও তার সমালোচনা করতে সকলকে উৎসাহ দিতেন। একদিন এক ব্যাক্তি হযরত উমর (রা) কে বলেন, “হে খলীফা, আল্লাহ্ কে ভয় করুন!” উমর (রা)-এর সঙ্গীরা ত্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু হযরত ওমর (রঅ) লোকটিকে নির্দ্বিধায় বলতে দিলেন এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “তোমরা যদি (এই লোকটির মতো) কথা না বলো তাহলে তাতে কল্যাণ নেই এবং আমাদের (শাসকদের) মধ্যেও কোনো কল্যাণ নেই যদি আমরা তোমাদের (পরামর্শ ও সমালৌচনা) না শুনি।” আরেকবার উমর (রা) শ্রোতাদের উদ্দেশ্য বললেন, “তোমাদের মধ্যে বিচ্যুতি দেখে তাহলে আমকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব তারই।” এ কথা শুনে একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আল্লাহর শপথ, আপনার মধ্যে আমরা যদি আমার মধ্যে বিচ্যুতি দেখি তাহলে এই তোলয়ার দিয়ে আপনাকে ঠিক করব। (অথাৎ বল প্রয়োগ)।” উমর (রা) রাগ না খুশী হয়ে বললেন: “আলহ্মদুলিল্লাহ, মুসলমানরা তলোয়ার দিয়ে উমরকে ঠিক পথে আনার জন্যে তৈরি আছে।” বস্তুত স্বাধীন পরিবেশ থাকলে নানা মতের উদ্ভব ঘটে এবং সেগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষসহ বিচক্ষণ ব্যাক্তিরা আলাপ-আলোচনা করে ভালটা গ্রহণ ও মন্দটা বর্জন করতে পারেন। ফলে অপ্রীতিকর মতভেদের আশাঙ্কাও তিরোহিত হয়।
অন্যথায় চরমপন্থী ভাবধারা গোপনে সুপ্ত বীজের মতো বাড়তে বাড়তে মহীরুহে পরিণত হয়। অবশেষে একদিন সহিংস তৎপরতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে সকলকে হতবাক করে দেয়। মন ও মেধা চরমপন্থী চিন্তাধারার উৎস। এর মুকাবিলায়ও মন ও মেধা প্রয়োজন। শক্তি প্রয়োগ করে এর মুকবিলা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। সতর্কতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল অবলম্বন করেই চরমপন্থী মনোভাব পাল্ঠাতে হবে। কিন্তু সাময়িক অভ্যুথ্থানের নেতৃবৃন্দ এখানেই ভুল করে বসেন। তারা তাদের গুপ্ত পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন চালান। এতে তারা সাময়িক সাফল্য অর্জন করেন বটে, কিন্তু চরমপন্থা দমনে শেষতক চরমভাবে ব্যর্থ হন। কেননা একটা চরমপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
অতএব, এই পর্যায়ে আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত ফিকাহর ভিত্তিতে যুক্তিগ্রাহ ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই ফিকহ শুধু ছোটখাট বিষয় নয়, বরং অপরিহার্য দিকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেবে এবং খন্ড ও অখন্ড, শাখা ও মূল, মূর্ত ও বিমূর্ত বিষয়গুলোর যথার্থ রূপভেদ ব্যাখ্যা করবে। এ ধরনের ফিকহর বিকাশ সহজ কাজ নয়। মানুষের ধ্যান-ধরণায় পরিবতর্ন তথা কোন্‌টি সঠিক, কোন্‌টি ভুলতা বিচারের মানসিকতা গড়ে তোলার জন্যে আন্তরিক প্রয়াস, পচন্ড ধৈর্য এবং আল্লাহ্ তায়ালার সাহায্য দরকার।
ক্ষমতাসীনরা মনে করে, রেডিও-টিভিকে কাজে লাগিয়ে তাদের ইচ্ছা মাফিক গণমানস পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু মানুষ এ ধরনের সরকারী প্রচার কৌশলে আস্থা আনতে পারে না। বিভিন্ন দেশের সরকার কিছু ওলামা ও বাগ্মীকে এই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে বন্দীদের চিন্তাধারা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা নিদুরুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র সরকারী প্রভাবমুক্ত হাক্কানী আলিমরাই এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। এসব মুক্ত হাক্কানী আলিম তাদের জ্ঞানের মৌলিকতা ও গভীরতার জন্যে যুব সামাজ তথা সাধারণ মানুষের আস্থা ও শ্যদ্ধাভাজন। কিন্তু এ জন্যে সন্ত্রাসমুক্ত স্বাভাবিক পরিবেশ দরকার। মুক্ত ও গঠনমূলক আলোচনা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সঠিক চিন্তার বিকাশ ঘটা সম্ভব। আদেশ-নিষেধ জারি করে রাতারাতি মনের রূপান্তর সম্বব নয়।
এ প্রসঙ্গে আমি যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে চাই তা হচ্ছে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসকে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস দিয়ে মুকাবিলার বিপদ অথাৎ একগুয়েমির সাথে একগুয়েমি, গোঁড়ামির সাথে গোঁড়ামি এবং অপকর্মের সাথে অপকর্মের মুকাবিলা। উদাহরণস্বরূপ পরস্পরের বিরূদ্ধে কুফরীর অভিযোগের কথা উল্লেখ করা যায়। এর সপক্ষে একটি হাদীসের কথা বলা হয়, “যে ব্যক্তি একজন মুসলমানকে কাফির বলে সে নিজেই কুযফরী করে।” কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যার ভুল, সন্দেহ বা ভূল সিদ্ধান্তের জন্যে একজন মুসলমানকে উক্ত হাদীসের আলোকে কাফির বলে অভিযুক্ত করা যায় না। হাদীস ও সাহাবীদের জীবন থেকে আমরা এর প্রমাণ পেতে পারি। হযরত আলী (রা) খারিজীদের কেবল নিন্দাই করেছেন কিন্তু কাফির বলেননি। খারিজীরা তাকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিল। তিনি তাদের নিয়তকে ভাল মনে করে তাদেরকে ইসলামের আওতার মধ্যেই রেখেছিলেন। তাই তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল খারিজীরা কাফির কিনা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, তারা কুফরঅ থেকে বেঁচে গেছে, তারা অথীতে আমাদের ভাই ছিল, আজ তারা ভূল করেছে। এর অর্থ আলখাওয়ারিজকে কাফির বা মুরতানিন না বলে বাগী বলে গণ্য করা যায়। এই ক্ষত্রে বুগাতের তাৎপর্য দাঁড়ায় ভুল ব্যাখ্যা ভিত্তিতে যে ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ মুসলিম ইমামের আনুগত্য করে না। এ ধরনের বাগীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ করা সমীচীন নয়, বরং সকল পন্থায় তাদেরকে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যদি তারা বিপর্যস্ত হয় তাহলে তাদের সাথে কর্কশ আচরণ-নির্যাতন করাও উচিত হবে না। কেননা তাদেরকে নির্মূল করা নয়, বরং ইসলামের আওতায় ফিরিয়ে আনাই সকল প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। অতএব তাদেরকে মুসলমান হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
হযরত আলী (রা)-এর আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ছিল নজিরবিহীন, সে অবস্থায় পৌঁছতে অনান্য দেশকে আরো বহু শত্বাদী অপেক্ষা করতে হয়েছেল। আলখাওয়ারিজ হযরত আলী (রা)-এর আপোস মীমাংসা নাবচ করেছিল এই দাবীতে যে, ‘সিদ্ধান্ত কেবল আল্লাহ্‌রই’। আলী (রা) তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, “বাতিলের স্বার্থে এটা সত্যের বিকৃতি।”তাদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও আলী (রা) বলিষ্ঠ ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন: “আমরা তোমাদেরকে মসজিদে নামায আদায়ে বাধা দেব না, গনমতের মাল থেকে বঞ্চিত করব না, তোমরা যুদ্ধ শুরু না করলে আমরা করব না।”আলী (রা) এমনিভাবে খারিজীদের অথাৎ বিরোধী দলকে সকল অধিকার দিয়েছিলেন অথচ তিনি জানতেন তারা পূর্ণরূপে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র সৈন্য, যে কোনো মুহূর্তে অস্ত্র ধারণে সক্ষম।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আলখাওয়ারিজকে (খারিজীদের) কাফির বলে চিহ্নিত না করা সম্পর্কে আলিমদেরও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, যদিও প্রামাণিক হাদীসে এরূপ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও তদেরকে হত্যা করার অনুমতি রয়েছে। এমাম শাওকানী ‘নায়লুল আওতারে’ লিখেছেন, অধিকাংশ সুন্নী ফকীহ মনে করেন, কালিমা পাঠ ও ইসলামের মূল আহকাম মেনে চলায় খারিজীরা মুসলমান। তারা অন্য মুসলমানকে কাফির বলে অভিহিত করে, তারা নিজেরাই নিজেদের ভুল ব্যাখ্যার ফাঁদে পড়ে। তাদের পাপ ঐ ভুলেরই পরিণতি। আল-খিতাবী বলেন যে, যতোক্ষণ তারা ইসলামের মূলনীতিগুলো মেনে চলে ততোক্ষণ তাদের কাফির বলা ডাবে না। তাদের সাথে আন্তঃবিবাহ, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি করা যেতে পারে বলে আলিমরা একমত হয়েছেন।
ইয়াদ বলেন, মুতাকাল্লিমুনদের জন্যে একটি এটি অত্যন্ত জটিল বিষয় ছিল। ফকীহ আবদুল হক এমাম আবু মা’লীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি একজন কাফিরকে এসলামের মধ্যে অথবা একজন মুসলমানকে এর আওতা থেকে বহিষ্কার করার মতো জটিল ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অস্বীকার করেন। কাজী আবু বকর আল-বাকিল্লানীও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলে তিনি জানান। তবে তিনি বলেন, আল-খাওয়ারিজ প্রকাশ্য কুফরী করেনি কিন্তু কুফরীর মতো কথাবার্তা বলেছে। আল-গাযালী (র) তার আত-তাফরিকাহ বাইনাল ইমাম ওয়াল জান্দাকাহ গ্রন্থে লিখেছেন, “কাউকে কাফির চিহ্নিত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। একজন মুসলমানের রক্তপাতের চেয়ে এক হাজার কাফিরের জীবন বাঁচানো অপেক্ষাকৃত কত মারাত্মক ভুল।”
ইবনে বাত্তাল (র) বলেছেন, অধিকাংশ আলিম আল-খাওয়ারিজকে ইসলামের আওতার বাইরে রাখেননি। নাওরাওয়ানের খারিজীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে আলী (রা) বলেছেন যে, তারা কুফরী এড়িয়ে গেছে। বাত্তাল তাদেরকে বুগাত বলে বিবেচনা করা যায় বলে মত প্রকাশ করেন। আলিমরা এ ব্যাপারে একমত যে, তাকফীর (কাউকে কাফির বলে চিহ্নিত করা) এমন একটি মারাত্মক বিষয় যা মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনতে পারে।মুসলিম মনীষীরা মূল প্রামাণিক সূত্র থেকে বিভিন্ন বিষয় সিদ্ধান্তে নেয়ার নির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ থেকে উসুল আল-ফিকাহ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিজ্ঞানের এই অতুলনীয় শাখা ইসলামের প্রামাণিক সূত্র থেকে আইন প্রণয়নের পদ্ধতিগত ভিত্তি নির্মাণ করেছে। এ জন্যে মুসলমানরা গর্ববোধ করতে পারে। এছাড়া উসুল থেকে কোনো নীতি সূত্র পাওয়া না গেলে উসুল আত-তাফসীর ও উসুল আল-হাদীসে তার সন্ধান পাওয়া যেতেপারে। শারীয়াহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য ঈমান, হাদীসের ব্যাখ্যা ও আইন সংক্রান্ত অসংখ্য বই পুস্তকের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে।
অতএব জ্ঞানের এসব সূত্রের বিদ্যমানতায় কুরআনের আয়াত ও হাদীসের মর্ম গভীরভাবে উপলদ্ধি করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে থাকতে পারে না। অগভীর ভাসাভাসা জ্ঞানের কোনো অবকাশ নেই। এই লক্ষ্যে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে:
প্রথম: ইসলামের সার্বিক সত্যের প্রেক্ষিতে সকল বিশেষ বিশেষ দিক বিবেচনা ব্যতিরেকে শারীয়াহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি পরিপক্ক হতে পারে না। কুরআনের একটি আয়াত অথবা একটি হাদীস অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে অন্য আরেকটি হাদীস হাদীস, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ, সাহাবীদের জীবন ও উসূল আত-তাফরীরে আলোকে। এছাড়া সার্বিক প্রেক্ষাপট ও শারীয়াহর উদ্দেশ্যকেও সামনে রাখতে হবে। অন্যথায় উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভ্রান্তির ফলে শরীয়তে পরস্পর বিরোধীতার আপদ দেখা দেবে। এ কারণে ইমাম আশ-শাতিবি (র) ইজতিহাদের ক্ষেত্রে দু’টি শর্ত আরোপ করেছেন: (ক) সামগ্রিক চৈতন্যে শরীয়ত অনুধাবন ও (খ) সেই উপলব্ধির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এই শর্ত পূরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে কুরআনের ও হাদীসের গভীর জ্ঞান এবং সেই সাথে কারণ, ঘটনাবলী, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রতিটি আয়াত ও হাদীসের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে হবে। এছাড়া চিরন্তন অপরিবর্তনীয় এবং সাময়িক চাহিদা পূরণ, প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্য, বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাবলী এবং পরিবর্তিত অবস্থায় এসবের পরিবর্তন ইত্যাদির রূপভেদ নির্ণয়ের ক্ষমতা থাকতে হবে।
একদিন আমি মহিলাদের ইসলামী পোশাক সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলাম। একজন শ্রোতা বললেন, কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী হিযাবের সাথে একটি অতিরিক্ত বহিরাবরণ থাকতে হবে। আমি জবাব দিলাম, হিযাব নিজেই একটি উদ্দেশ্য নয়, বরং শরীরের শরীয়ত নিষিদ্ধ অংশগুলো শালীনভাবে আবৃত করার উপায় মাত্র এই সময় ও স্থানভেদে এর ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিন্তু লোকটি অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করে বলল, কুরআন শরীফে পোশাক সুস্পষ্টত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা পরিবর্তনের অধিকার আমাদের নেই বলে সে কুরআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলো:
“হে নবী! আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও ঈমানদারদের নারীদের বলুন, যেন তারা তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে; ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৩৩:৫৯)
আমি বললাম, কুরআনুল করীমে কখনো কখনো ওহী নাযিলের সমসাময়িক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে উপায় ও পদ্ধতি বাতলে দেয়া হয়েছে। এর চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ অন্য কোনো উপায় উদ্ভাবিত হলে ঐটাই স্থায়ীভাবে মানতে হবে এমন ধরা বাঁধা তাৎপর্য ঐ আয়াতে নিহিত নেই। এর পক্ষে নিম্মোক্ত উদাহরণটিই যথেষ্ট: কুরআনুল করীম বলছে: “তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে, যাদেরকে তোমরা জান না, আল।রাহ জানেন।” (৮:৬০)
এই আয়াত নাযিলের সময় ঘোড়া ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাহলে এখন কি মুসলমানরা ট্যাংক, জঙ্গী বিমান, বোমা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে না? এটা যদি ঠিক না হয় তাহলে এই আলোকে মুসলিম মহিলারাও শ্লীলতার উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে কোনো বহিরাবরণ ব্যবহার করতে পারে।
আল-হাদীসকেও একইভাবে মূল্যায়ন করা যায়। আল-হাদীস ও শিক্ষায় জীবনের নানা ক্ষেত্রের প্রণালী-প্রক্রিয়া বিধৃত হয়েছে যার কতকাংশ আইন এবং অনেকাংশ আইন নয়; কিছু সাধারণ, কিছু নির্দিষ্ট, কিছু অপরিবর্তনীয়, কিছু পরিবতর্নীয়।পানাহার, পোশাক ইত্যাদি ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন আছে। আবার নির্দিষ্ট আইন নয় এমন সুন্নাহ ও রীতি-প্রথাও রয়েছে। যেমন- চামচের পরিবর্তে হাত দিয়ে খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময়ে হাত দিয়ে খাওয়া আরবদের সাধারণ জীবনযাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এর অর্থ এই নয় যে, চামচ ব্যবহার হারাম। কিন্তু সোনা- রূপোর তৈজসপত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একইভাবে ডান হাত ব্যবহারের অভিন্ন প্রথা প্রবর্তন এর উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “বিসমিল্লাহ বলো (খাওয়ার আগে) এবং ডান হাত দিয়ে খাও।” (অনুমোদিত হাদীস) আরেকটি হাদীসে তিনি বলেন, “তোমাদের বাম হাতে পানাহার করা উচিত নয়। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে।” (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময় চালুনি সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না। তাই বলে এটার ব্যবহার এখন বিদআত হতে পারে না।
অনেক তরূণ খাট ইজার বা ছওব পরিধানকে ইসলামের মৌলিক বিষয় মনে করে। তাদের প্রথম যুক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবারা এটা পরিধান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত হাদীসে গোড়ালির নিচে পর্যন্ত ইজার বা ছওব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদীসটি হচ্ছে: “গোড়ালির নিচে ইজার পরিধানকারী ব্যাক্তি দোযখে যাবে।” (বুখারী)
প্রথম যুক্তিটির ব্যাপারে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তাতে দেখা যায় তিনি যখন যেমন পেয়েছেন তেমনিই পরেছেন। তাকে কোর্তা, ঢিলে জামা এবং এজারও পরতে দেখা গেছে। তিনি এয়েমেন ও পারস্য থেকে প্রাপ্ত (কিনারে সিল্কের নক্‌শা করা) কাপড়ও পরেছেন। পাগড়ি ছাড়া বা পাগড়[ইসহ টুপিও পরেছেন।
ইমাম ইবনূল কাইয়েম (র) তাঁর আল-হাদী আন-নববী বইয়ে লিখেছেন: পোশাক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বোত্তম রীতি তাই যা তিনি নিজে ব্যবহার করেছেন, করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন।-তিনি উয়েমেনের পোশাক, সবুজ কাপড় চোপড়, জুব্বাহ, ফুলহাতা জামা এবং জুতা-স্যান্ডেলও পরেছেন। তিনি কখনো কখনো বাবরিও রেখেছেন।
তখন বস্ত্রকল অজ্ঞাত ছিল। ইয়েমেন, মিসর ও সিরিয়া থেকে কাপড় আমদানী করা হতো। এখন আমরা বিভিন্ন ধরনের অর্ন্তবাস ব্যবহার করি। তখন তা ছিল না। অতএব এসব নিয়ে অহেতুক শোরগোল কেন?
দ্বিতীয়: কুফফারের অনুকরণ সংক্রান্ত যুক্তি প্রশ্ন বলা যায়, আমাদেরকে আসলে কুফফারদের (অন্য ধর্মের অনুসারীদের) বৈশিষ্ট্য অনুসরণে নিষেধ করা হয়েছে; যেমন-ক্রস, ধর্মীয় পরিচ্ছদ, দর্মীয় আচার-সিরাত আল-মুসতাকিম মুখলিফাত আহলিল জাহীম” পুস্তকে এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এখন একজন মুসলমান যদি ইচ্ছাকৃত কুফফারকে অনুসরণ করে তবে তা দোষনীয়। কিন্তু কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনের তাকিদে করে তবে তা দোষনীয়। যেমন কোনো ফ্যক্টরী শ্রমিক বা ইঞ্জিনিয়ার কাজের সুবিধার্থে “ওভারঅল” পরলে দৌষের যথাসম্ভব নিজেস্ব বৈশিষ।ট্য ফুটিয়ে তোলা উচিত। সারকথা, খাটো ছওব পরা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক না হলে লম্বা কাপড় পরা নিষিদ্ধ নয়।
উপরের উদাহরণগুলো নির্ভেজাল ব্যাক্তিগত ব্যাপার। অথচ আমরা বৃহত্তর জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জটিল বিষয়গোলো নিয়ে এতো মাথা ঘামাই না যদিও তা গোটা উম্মাকে হুমকির মুখে ঠেলে দৈয়া এসব সমস্যা সমাধানে বরং আমাদেরকে ইসলামী আইনের গভিরে প্রবেশ করা উচিত।
আমাদের এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এখন আমরা এক জটিলতম জগতে বাস করছি। নানা মত ও আদর্শের নজিরবীহিন প্রসারের ফলে পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। সমাজে দুর্বল-শক্তিশালী, মহিলা-পুরুষ, সৎ ও সীমালংঘকারী ইত্যাদি রয়েছে। অতএব ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনরুজ্জাঈবনের আন্দলনের প্রতি মানুষকে আহবান জানানো এবং কোনো বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার সময় এই জটিল প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে। আল্লাহর রেজামন্দি প্রত্যাশী একজন মুসলমান ব্যক্তি জীবনে চরমপন্থী মত পোষণ কিংবা কঠোর নিয়মশৃখলার মনে চলতে পারে। গান-ব্দ্য, নাটক এসবের স্থান তার জীবন নেই। কিন্তু কোনো আধুনিক রাষ্ট্র টিভি, রেডিও, আলোকচিত্র, সংবাদপত্র বা সংবাদ মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট, ট্রিফিক, শিক্ষা ও আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে ছবি এখন অপরিহার্য। অপরাধ ও জালিয়াতি প্রতিরোধে এর ব্যবহার এখন ব্যাপক ও অত্যাবশ্যক। অতএব আধুনিক কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ কি টিভির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে? অথচ ফটোভিত্তিক বলে অনেকে এটাকে হারাম বলে মনে করেন।
সংক্ষেপে আমি যা বলতে চাই, নিছক ব্যক্তি জীবনে কড়াকড়ি সহনীয়; কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রের উপর তা চাপিয়ে দেয়াএ চিন্তা অবাস্তব। একানে রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর হাদীসটি আবার স্মতূব্য: “যে নামাযের ইমামতি করে তার উচিত নামায সংক্ষিপ্ত করা। কেননা জামাতে দুর্বল, বৃদ্ধ এবং ব্যস্ত লোকও থাকে।” (বুখারী)
একটি মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে অনেকে এটা স্বীকার করতে চান না যে, শরীয়তের সকল আহ্‌কাম সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আহ্‌কামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে এটাও তারা মানতে চান না। প্রথা, আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় আনুমানিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। এগুলো ইজতিহাদ সাপেক্ষ এবং স?ঠিক ইজতিহাদ থেকে উৎসারিত সিদ্ধান্তবলীতে মতানৈক্য ক্ষতিকর নয়, বরং এটি শরীয়তে নমনীয়ত ও ফিকাহর ব্যাপকতার প্রমাণ এবং উম্মার জন্যে আশীর্বাদ। এসব বিষয় সাহাবায়ে কিরাম (রা) এবং তাদের উত্তরর্সরীদের মধ্যেও মতভেদ ছিল। কিন্তু এগুলো কখনোই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি। অন্যদিকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত আহকাম কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত। এটা মুসলিম উম্মার মানসিক ও আচরণগত ঐক্যের প্রতীক। এগুলো থেকে বিচ্যূতি শুধু পাপ নয়, একজনকে কুফরীর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এছাড়া আরো কিছু আহকাম আছে যেগুলো প্রত্যাখ্যান করা আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করার নামান্তর। পক্ষান্তের এমন সব বিষয় আছে যেগুলো ব্যাখ্যা নিয়ে ফকীহরা মতভেদ করেছেন। যেমন, কেউ বাধ্য হয়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করলে, হত্যাকারী, না যে হত্যা করালো, কে শাস্তি পাবে? না-কি উভয়ে শাস্তি ভোগ করবে? এই জটিল প্রশ্নের বিভিন্ন মিজহাবের ফীকহ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেবল ইমাম আহমদ (র)-এর হাম্বলী মাজহাবেই এ ব্যাপারে এতো মতভেদ রয়েছে যে, তারা এ নিয়ে ১২ খন্ডের বই লিখেছেন। বইটির নাম: আল-ইনসাফ ফীর রাজিহ মিনাল ইখতিলাফ।
এই প্রেক্ষিতে মুসলিম তরুণদেরকে মতানৈক্য ও মতৈক্যের বিষয়গুলো এবং মতানৈক্য নিরসনের মনদন্ড সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। এই লক্ষ্যে আমাদের আলিম ও উলামার কাছ থেকে প্রাপ্ত মতভেদ নীতি বা আদাব আল-ইখতিলাফের সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। তাহলে আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে উদার ও পরমতসহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষা লঅভ করতে পারব। ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখেও আমরা কিভাবে মতভেদ করতে পারি? প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, প্রান্তিক বিষয়ে মতনৈক্য স্বাভাবিক। সুস্পষ্ট আহকাম ও অস্পষ্ট আহকাম সৃষ্টির পেছনেও ঐশী প্রজ্ঞা রয়েছে। অস্পষ্ট আহকাম ও বিভিন্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ মতভেদেরও সম্ভ।আবনা থাকে। এটাও আল্লাহ্‌ তায়ালার আর্শীবাদ, বিশেষ করে সেই সব আলিমের উপর যারা মজহাব নির্বিশেষে একটি বিষয়ের সকল দিক বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এরূপ বিশিষ্ট আয়েম্মোর সারিতে যারা রয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য: উবনে দাকীক আল ঈদ, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে কাছীর, ইবনে হাজার আল আছকালানী, আল দাহলাবী, আশ-শাওকানী, আল-সানানী (র) বলতেন: “আমি কখনোই কামনা করিনি যে, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতনৈক্য না থাক। তাদের মতনৈক্য রহমতস্বরূপ।”
এমনকি রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) -এর জীবদ্দশায়ও একটি বিষয়ের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যেতো। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) এগুলো অনুমোদন করতেন এবং তিনি ব্যক্তি বিশেষ বা গ্রুপকে দোষী বলে চিহ্নিত করতেন না। জঙ্গে আহযাবের পর রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করে সে যেন বানু কুরাইজায় (বসতা) না পৌঁছা পর্যন্ত সালাতুল আসর আদায় না করে।” (বুখারী ও মুসলিম) কতিপয় সাহাবী এটাকে অসম্ভব মনে করে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই সালাত আদায় করে নিলেন। অন্যরা অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থ গ্রহণকারীরা বানু কুরাইজার পৌঁছে নামায পড়লেন। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-কে এটা জানানো হল, তিনি উভয় পক্ষের কাজ অনুমোদন করলেন যদিও একপক্ষ ভুল করেছিল। এ থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি, নিরেট প্রমাণের ভিত্তিতে প্রণীত ব্যাখ্যাকেই মেনে চললে তাতে পাপ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
দুভার্গজনকভাবে আজকার একদল লোক আছেন যারা দাবী করেন তারাই সকল সত্যের আধার এবং সব প্রশ্নের জবাব তাদের কাছেই আছে এবং অন্যের উপর তা চাপি’য়ে দদিতে চান। তারা মনে করে তারা সকল মাযহাব ও মতভেদ নির্মূল করে এক আঘাতেই সকলকে একই প্লাটফর্মে হাযির করতে সক্ষম। তারা এ কথা বেমালুম ভুলে যান যে তাদের সিদ্ধান্তটাও অনুমান নির্ভর এবং তা ভুল বা শুদ্ধ উভয়ই হতে পারে। মোটকথা কোনো মানুষ অথবা কোনো আলিম অভ্রান্ত নন। একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার হচ্ছে, তার ইজতিহাদের জন্যে তিনি পুরস্কার পাবেন ভুল বা শুদ্ধ যাই হোক। অবশ্য তার নিয়ত সৎ থাকতে হবে। সুতরাং উপরোল্লিখিত ব্যক্তিরা একটা অতিরিক্ত মাহযাব সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই আশা করত পারেন না! এটা অদ্ভুত যে, তারা মাহযাবের অনুসৃতি অনুমোদন করেন না, কিন্তু অন্যকে নিজেদের নতুন মাহযাব অনুসরণে প্রলুবাধ করেন। তারা চান তাদের সৃষ্ট ‘একমাত্র’ মাহযাব সকলেই মেনে নিক। একবার এই ‘একমাত্র’ মাহযাবের একজন অনুসারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: কেন সকল মুসলমান একটি মাত্র ফিকহী মতের অনুসারী হতে পারেন না? আমি জবাবে বললাম যে, মৌলসূত্রের ভিত্তিতে সকলের ঐকমত্য চাই। তা হতে হবে প্রামাণিক, অভিন্ন ও নির্বিরোধ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য । এর বিরোধিতায় আর কোনো মৌলসূত্র উথ্থাপিত হতে পারবে না এবং পূর্বোল্লিখিত তিনটি বিষয়ে সকল আয়েম্মায়ে হাদীসের মতৈক্য থাকতে হবে। সংক্ষেপে, এই বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর “রাফআল মালাম আনিল আয়েম্মাইল আলাম,শাহ ওয়ালীউল্লঅহ দেহলভীর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ও আল-ইনসাফ ফী আসবাবিল ইখতিলাফ এবং শেখ আলী আল-খলীফার আসবাব ইখতিলাফীল ফুকাহা” গ্রন্থে যেসব শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে তা পূরণ করতে হবে। এখন আসুন আমরা নিচের হাদীসগুলো পর্যালোচনা করি:
১. যে নারী সোনার হার পরবে তাকে কিয়াতমের দিনে অনুরূপ একটি আগুনের তৈরি হার পরানো হবে এবং যে নারী সোনার দুল পরবে তাকে কিয়ামতের দিন অনুরূপ একটি আগুনের তৈরি দুল পরানো হবে। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
২. কেউ যদি তার প্রিয়জনকে কিয়ামতের দিন আগুনের দুল পরাতে চায় তবে সে যেন তাকে সোনার দুল পরেত দেয় এবং কেউ যদি তার প্রিয়জনকে কিয়ামতের দিন আগুনের বালা পরাতে চায় সে যেন তাকে সোনার বালা পরতে দেয়। কিন্তু তোমারা পছন্দ মতো রূপা ব্যবহার করতে পারো। (আবু দাউদ)

৩.ছওবান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর কন্যা ফাতিমাকে (রা) সোনার চেন পরার জন্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এতে সাড়া দিয়ে তিনি সেটা বিক্রি করে একটি গোলাম খরিদ করলেন এবং তাকে আযাদ করে দিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ কথা জানানো হলো তখন তিনি বললেন, আলহামদু লিল্লাহ! তিনি ফাতিমাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে নিলেন।
ফকীহরা এসব হাদীস সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন: কেউ কেউ এগুলোর এনসান (হাদীসের বর্ণনা সূত্র) দূর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং নিষিদ্ধ করার জন্যে অপর্যাপ্ত বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ ইসনাদকে সঠিক বললেও অন্য সূত্র থেকে প্রমাণ করেছেন যে, মেয়েরা সোনার অলংকার ব্যবহার করতে পারে। আর-বায়হাকী ও অনান্য ফকীহ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন বলে লিখেছেন এবং একে স্বীকৃত প্রচলন বলে ফিকায় মেনে নেয়া হয়েছে।
অন্য ফকীহরা অন্য হাদীসের ভিত্তিতে, যারা মজুদ সোনার যাকাত আদায় করেননি, তাদের ক্ষেত্রে এই হাদীস প্রযোজ্য বলে রায় দিয়েছেন। এই অন্য হাদীসগুলো আবার সমালোচনার উর্ধ্ব নয়। আবার, মহিলাদের গহণার যাকাত সম্পর্কেও বিভিন্ন মাযহাবে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ আবার যুক্তি দেখিয়েছেন, যেসব মহিলা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অহংকারবশত সোনার অলঙ্কার পরে এই হাদীসে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আন নাসাঈ এই বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ কতিপয় হাদীস উল্লেখ করে “বাবুল কারাহিয়াহ লি নিসা এজার আলহালি জাহাব” শীষর্ক পস্তুক রচনা করেছেন। অনান্য ফকীহ বলেছেন, অহংকারবশত অতিরিক্ত সোনা ব্যবহার প্রশ্নের হাদীস জড়িত।
আধুনিক কালে শেখ নাসিরুদ্দীন আর-আলবানী (র) গত ১৪শত বছরেএ সকল মাযহাবের রায় বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, হাদীসগুলোর ইসনাদ শুধু প্রমাণিকই নয়, এগুলো অন্য হাদীস দ্বারা বাতিলও হয়নি। সুতরাং গলার হার ও কানের দুল পরা নিষিদ্দ।
অতএব মতনৈক্যের যে দুর্বার স্রোত এগিয়ে চলছে তা কি বালির বাধ দিয়ে রুখা সম্ভব? প্রশ্নের জবাব অতি পরিষ্কার: “মতাভেদের অসংখ্য স্রোতধারা প্রবাহিত হতেই থাকবে, কিন্তু তা আমাদেরকে নিসজ্জিত করতে পারেবে না ইনশাআল্লাহ।” আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন: “প্রত্যেকেরই একটা দিক আছে, যার দিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়।” (২:১৪৮)
এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই আধুনিক কালে একজন মাত্র ধর্মীয় নেতা মতভেদের নীতি ও তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ইমাম হাসান আল-বান্না (র)। মুসলিম উম্মাহর সংগতি লক্ষ্যে নিবেদিত হয়েও তিনি তার অনুসারীদের এর নূন্যতম মর্ম উপলব্ধি করাতে পেরেছিলৈন এবং ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে ঐক্যমত সৃষ্টি তাদেরকে এক প্লাটফর্মে সমবেত করার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মতভেদের অনিবার্যতা সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন। তার বিখ্যাত উসুল আল-ইশরুন গ্রন্থ থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়। এ বিষয়টি তিনি দক্ষতার সাথে তার বিভিন্ন বাণীতে তুলে ধরেছেন। ‘আমাদের দাওয়াত’ শীষর্ক বাণীতে তিনি বলেন যে, তার আহবান সর্বসাধারণের প্রতি , কোনো বিশেষ গ্রুপের প্রতি নয় এবং কোনো বিশেষ চিন্তাধারার প্রতিও নয়। দ্বীনের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করাই আমাদের কাম্যঅ এজন্যে বৃহত্তর কল্যাণে সকল প্রচেষ্টা সম্মিলিত খাতে প্রবাহিত করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা মতৈক্য চাই, খামখেয়ালী নয়। কারণ সকল দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী ভ্রান্তিপূর্ণ মতভেদ। আমরা বিশ্বাস করি বিজয় অর্জনের জন্যে ভালবাসা একটি বড় উপাদান অতএব ব্যার্থতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে এমন বিষয় পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি লিখেছেন:
“নানা কারণে ছোটখাট ধর্মীয় বিষয়ে মতভেদ অনিবার্য। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারনগুলো হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির মাত্রা ও জ্হানের গভীরতার তারতম্য, বহুবিদ বাস্তব ঘটনা ও থথ্যের পারস্পারিক সম্পর্কে এবং ভাষায় অন্তর্নিহিত দ্ব্যর্থতা। এসব কারণে মূলসূত্রের ব্যাখ্যার বিভিন্নতার দরুন মতভেদের উদ্ভব অপরিহার্য।
ইসলামী বিশ্বের কোনো অংশে জ্ঞানের উৎসের প্রাচুর্য আবার অনান্য জায়গায় দুষ্পাপ্যতাও একটি বড় কারণ। এমাম মালিক (র) আবু জাফরকে (র) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীরা বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়েপড়েছিলেন, প্রত্যেকের কাছে জ্হান সঞ্চিত ছিল। তুমি যদি একটিমত অনুসরণে জবরদস্তি করো তাহলে ফিতনা সৃষ্টি করবে।”
পরিবেশগত পার্থকও রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ইরাক ও মিসরের বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া দিতেন। উভয় ক্ষেত্রে তিনি যা সত্য বলে রা’বীর প্রতি ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি মতপার্থক্যের আরেকটি কারণ। একজন রা’বীকে একজন এমাম নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেন, আরেকজন তাতে সংশয় প্রকাশ করেন।
এসব কারণে আমরা বিশ্বাস করি, ধর্মীয় গৌণ বিষয়ে সর্বসম্মত মত অসম্ভব নয়, দ্বীনের প্রকৃতির সাথে অসংতিপূর্ণ। কেননা এরূপ দাবী কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি জন্ম দেবে। আর এটা ইসলামের সরলতা, নমনীয়তা ও উদারতার পরিপন্থী। নিঃসন্দেহে এই মূল্যবোধগুলোর কারণেই ইসলাম যুগের দাবী মেটাতে সক্ষম।
অধিকন্তু, যেহেতুঋ আমরা সকলে ইসলামের সুবিস্তৃত কাঠিমোর আওতাধীন তাই গৌণ বিষয়ে মতভেদ আমাদের পারস্পারিক ভালবাসা ও সহযোগিতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। আমরা যদি মুসলমান হই তাহলে আমরা কি মুসলমান ভাইদের পোষণ করে যাওয়ার সম্ভাব্য প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ গড়তে পারি না? অন্তত এ প্রশ্নে তো একমত হতে পারি।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীরা ফতোয়ায় মতভেদ পোষণ করেছেন কিন্তু তা অনৈক্য সৃষ্টি করেনি। সালাহ ও বনু কুরাইজার ঘটনাটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তারা আমাদের চেয়ে ভালভাবে জানা সত্ত্বেও যদি মতভেদ করে থাকেন তাহলে এটা কি অবাঞ্ছিত নয় যে, আমরা তুচ্ছ ব্যাপারে বিদ্বেষবশত মতনৈক্যে লিপ্ত হই? যদি আমাদের ইমামগণ বিভিন্ন বিষয়ে মতদ্বৈততা পোষণ করেন তাহলে আমাদেরও তা হতে পারে। যদি প্রাত্যহিক আযানের মতো প্রতিষ্ঠিত গৌণ বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে তাহলে অন্যান্য জটিল বিষয়ের কি দৃশ্য হবে?
আমাদেরকে এটাও স্মরণ রাখতে হয় যে, খিলাফত আমলে বিরোধীয় বিষয়গুলো খলিফার কাছে পেশ করা হতো। এখন যেহেতু খলীফা নেই সেহেতু এমন নির্ভরযোগ্য সূত্র বা ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যেন সেখানে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান করা যায়; নতুবা মতবিরোধ আরেকটি মতবিরোধের জন্ম দবে। পরিশেষে ,আমাদের ভ্রাতাগণ এসব বিষয়ে পূর্ণ সচেতন এবং তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও উদারতা থাকা আবশ্যক। তারা বিশ্বাস করেন প্রতিটি গ্রুপের দাওয়াতের মধ্যে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা উপাদান থাকতে পারে। তারা সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সত্যকে গ্রহণ করেন এবং যারা ভুল উপলব্ধি করেন, তাহলে খুব ভালো, আর যদি না করেন তবুও তাঁরা আমেদর মুসলিম ভাই। আমরা আল্লাহর কাছে সঠিক পথের দিশা চাই!”
ফিকাহর মতভেদ সংক্রান্ত একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। রমযান মাসে একদিন তিনি মিসরের একটি ছোট গ্রামে বক্তৃতার দাওয়াত পান। সেকানে দু’দল লোক তারাবীর নামাযের সংখ্যা নিয়ে বাকবিতণ্ডা করছিল। একদল বলল, উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর দৃষ্টান্ত অনুযায়ী ২০ রাকাত। আরেক দল ৮ রাকাতের উপর জোর দিচ্ছিল। তাদের যুক্তি ছিল রাসূলুল্লাহ (সা) কখনো আট রাকাতের বেশি তারাবীহ পড়েননি। উভয় পক্ষ একে অপরকে বিদাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করল। পরিস্থিতি এক পর্যায়ে হাতাহাতির উপক্রম হলো। তারা আল-বান্না (র)-এর কাছে বিষয়টি পেশ করল। তিনি প্রথম প্রশ্ন করলেন: তারাবীহ কী ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান? জবাব এলো: সুন্নাত, পালন করলে সওয়াব, না করলে গুনাহ। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন: মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কী মত? তারা জবাব দিল: বাধ্যতামূলক এবং ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয়। কখন আল-বান্না (র) বললেন: তাহলে শরীয়তের দ্রষ্টিতে ফরয অথবা সুন্নতের মধ্যে কোন্‌টি পরিত্যাগ করা যুক্তিযুক্ত? অতঃপর তিনি বললেন: আপনারা যদি ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য চান তাহলে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নিজেদের বিশ্বাস মোতাবেক তারাবীহর নামায পড়ুন। তর্ক করার চেয়ে এটাই উত্তম।
ঘটনাটি আমি কিছু লোকের কাছে বর্ণনা করলে তারা বললেন, আল-বান্নার পদক্ষেপ সত্য এড়িয়ে যাওয়ার শামিল। তিনি সুন্নাত ও বিদাতের পার্থক্য নিরূপণ করেননি। আমি বললাম, এ বিষয়ে মত বিরোধের অবকাশ আছে। আমি নিজে যদিও তারাবীহর নামায আট রাকাত পড়ি, কিন্তু যারা বিশ রাকাত পড়ে তাদেরকে বিদাতীর দায়ে অভিযুক্ত করি না। তারা অনমনীয়তা ব্যক্ত করে বলল, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া মুসলমানদের কর্তব্য। আমি যুক্তি দেখালাম, এটা হালাল ও হারামের ব্যাপারে সত্য; কিন্তু ফিকহী মাসলার ক্ষেত্রে নয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ আছে, অতএব প্রত্যেক পছন্দ অনুযায়ী একটি মত বেছে নিতে পারেন, কিন্তু এ ব্যাপারে গোঁড়ামি অনাবশ্যক।
অনেক বিজ্ঞ আলিম এটি স্বীকার করেছেন। হাম্বালী কিতাব ‘শারহে গায়াত আল-মুনতাহা’য় বলা হয়েছে:
কেউ যখন ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত নাকচ করে তখন সে মুজতাহিদুনের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত এরূপ করে, যাদেরকে আল্লাহ্‌ ভুল বা শুদ্ধ পরিশ্রম সাপেক্ষ সিদ্ধান্তের জন্যে পুরস্কৃত করবেন। তাদেরকে অনুসরণ গুণাহ হবে না। কেনা তারা যে ইজতিহাদে পৌঁছেছেন তা আল্লাহ্‌র নির্ধারিত পথ ধরেই এগিয়েছে; ফলে তা শরীয়তের অংশ হয়ে যায়। একটি উদাহরণ, প্রয়োজনে মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমতি আছে, কিন্তু ইচ্ছাকৃত খাওয়া নিষিদ্ধ। দুটোই সুপ্রতিষ্ঠিত ফিকহী সিদ্ধান্ত।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) তাঁর ‘আল-ফাতাওয়াল মিসরীয়া’ বইয়ে বলেছেন, ঐক্যের কথা বিবেচনা করাই সঠিক পথ। অবশ্য সম্প্রতীতি ও সখ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পছন্দনীয় জিনিস পরিহার করাও সংগত। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্থাপিত ভিত্তির উপর কা’বা নির্মাণ পরিত্যাগ করেছিলেন*। ইমাম আহমদ (র)-এর মতো ইমামগণ ঐক্য রক্ষার স্বার্থে পছন্দনীয় বিষয় পরিহার করে মতৈক্যের বিষয় মেনে নেয়ার পক্ষপাতী।
ইবনে তাইমিয়া ৯র) কা’বা নির্মাণ সংক্রান্ত নিম্মোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আয়েশা (রা)-কে বলেন: তোমাদের জনসাধারণ সম্প্রতি যদি জিহিলিয়ার মধ্রে না থাকতো তআহলে আমি (হযরত) ইবারাহীম (আ)-এর ভিত্তির উপর কা’বা পুনঃনির্মাণ করতাম। ইবনুল কাইয়েম সালাতুল ফজরে কুনুতের বিষয়টিও তুলেছেন। কেউ এটাকে বিদাত বলেন আর কেউ এটা দুর্দিনে আমল করার পক্ষে। তিনি তাঁর বই ‘যাদুল মাদে’ বলেছেন, আপকালে এটা আমল করা রাসূলের সুন্নাত। হাদীস বিশারদরাও এটা সুন্নাত জেনে আমল করেছেন; আর যারা এটাকে রাসূলের সুন্নাত বলে জানতে পারেননি তারা এটাকে আমল করেননি। ইবনুল কাইয়েম লিখেছেন: “নামাযে রুকু থেকে ওঠার পর আল্লাহর রহমত কামনা ও তাঁর শুকরিয়া আদায়ের উপযুক্ত মুহূর্ত।”
রাসূলুল্লাহ (সা) এই অবস্থায় দু’টি কাজেই করেছেন। এ সময় ইমামের সশব্দে দোয়া পাঠ গ্রহণযোগ্য যাতে মোক্তাদিরা শুনতে পায়। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) ও ইবনে আব্বাস (রা) ও এরূপ করতেন যাতে মানুষ সুন্নাহ জানতে পারে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা) শব্দে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করতেন এবং ইবনে আব্বাস (রা) জানাযার নামাযেও এরূপ করতেন। এগুলো গ্রহণযোগ্য মতভেদ সাপেক্ষ কাজ। যারা এরূপ করেন বা যারা করেন না কেউই দোষণীয় নন। যেমন নামাযে হাত তোলা, কিরান ও তামাত্তুর বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলের সুন্নাত তুলে ধরা। কোন্‌টি জায়েয, কোন্‌টি নাজায়েয তা চিহ্নিত করার চেষ্টা আমি করিনি, বরং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বোৎকৃষ্ট সুন্নাত তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্যঅ আমরা যদি বলি রাসূলুল্লাহ (সা)-নেই, তার অর্থ এই নয় যে, তিনি অন্যকে ও ব্যাপারে নিয়মিত করতে বলেছেন কিংবা কেউ পালন করলে তা রিদ্দাহর পর্যায়ভুক্ত হবে।
এক মাযহাবের অনুসারী অন্য মাযহাবের ইমামের পেছনে নামাযও আদায় করতে পারে; যদিও ঐ মুক্তাদি মনে করে যে, এতে তার মাযহাবে তা সিদ্ধ। এবনে তাইমিয়াহ (র) ‘আল-ফাওয়াকিহুল আদিদাহ’ পুস্তকে লিখেছেন: সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন এবং চার ইমামের রীতি অনুসারে পরস্পরের পেছনে নামায পড়া সিদ্ধ বলে মুসলমানরা সর্বসম্মত। যে এটাকে অগ্রাহ করে সে বিপথে চালিত মুবতাদী এবং কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিছু্যত হয়।
কোনো কোনো সাহাবী ও তাবিঈন জোরে বাসমালাহ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু অন্যরা করেননি, এতদসত্ত্বেও তারা পরস্পরের পেছনে নামায আদায় করে?ছেন। আবু হানিফা (র) ও তার অনুসারীরাও তাই করেছেন। শাফিঈরা মদীনায় মালিকীদের পেছনে নামায পড়তেছিলেন। কারণ, ইমাম মালিক (র) ফতোয়া দিয়েছিলেন এই অবস্থায় নতুন করে অযু করার দররকার নেই।
অবশ্য ইমাম আহমদ আবনে হাম্বল (র) শরীর বা নাক থেকে রক্ষক্ষরণহলে অবশ্যই গোসর করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোন মুসল্লী যদি ইমামের শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে দেখে তাহলে তার পেছনে সে নামায গড়ে যাবে কিনা এ প্রশ্নে ইমাম হাম্বাল (র) বলেন: “সাঈদ আবনে মুসাইয়াবের ও মালিকের (র) পেছনে নামায না পড়া অচিন্ত্যনীয়। অতঃপর তিনি দু’টো বিবেচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন:
(ক) ইমামের কোনো আচরণ সালাতকে বাতিল করলেও তা যদি মোক্তাদির দৃষ্টি এড়ায় তাহলে মোক্তাদিকে নামায চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী ওলামা ও চার ইমাম একমত। (খ) কিন্তু ইমাম নাপাক হতে পারেন এমন কিছু যদি করেন আর সে ব্যাপারে মোক্তাদি যদি নিশ্চিত হয় তবে সে তার মর্জি মাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেননা এ ব্যাপারে ব্যাপক মোনৈক্য রয়েছে। আমাদের পূর্ববর্তী বুযর্গদের মতে এরূপ ইমামের পেছনে নামায পড়া জায়েয। মালিকী মাযহাবও তাই মনে করে; কিন্তু শাফিঈ ও আবু হানিফা (র) ভিন্ন মত পোষণ করেন। আহমদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এই মতের প্রতিই সমর্থন পাওয়া যায়। (আল ফাওয়াকিহ আলাআদিদা; কারাজাতি, ফতোয়া মুয়াসিরাহ।)
২.জ্ঞান, মূল্যবোধ ও কর্ম
শরীয়তী কাজ ও কর্তব্যের মূল্য উপলব্ধিতে ফিকাহর জ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর আদেশ ও নিষেধের মানদন্ডে এসব কাজ ও কর্তব্যের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই জ্হান বিবিধ ও সাদৃশ্যের মধ্যেকার বিভ্রান্তি প্রতিরোধ করে। জীবনের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের আলোকে ইসলাম প্রতিটি কর্মের মূল্যমান নির্ধারণ করে দিয়েছে।
মুস্তাহাব (প্রশংসনীয়) কাজগুলো না করলে শাস্তি নেই, কিন্তু করলে পুরস্কার আছে। আবার এমন বিষয় আছে যা রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বদা করেছেন, পরিহার করেননি; কিন্তু অন্যকে করার জন্যে সুস্পষ্ট আদেশ দেননি। এগুলো যে বাধ্যতামূলক নয় তা প্রমাণ করার সাহাবায়ে কিরাম এসব কাজের কিছু কিছু করেননি। মাযহাবগুলোর মত অনুযায়ী মুস্তাহাবের আদেশ আছে; কিন্তু সুস্পষ্টভাবে নয়। ফরয দ্বর্থহীনভাবে বাধ্যতামূলক, করলে সওয়াব, উপেক্ষা করলে গুনাহ। আর পালন না করলে ফিস্‌ক, পাপকার্য। আর বিশ্বাস না করলে কুফরী। ফরয দু’ভাগে বিভক্ত। ফরযে কিফায়াহ (সমষ্টিক কর্তব্য) ও ফরযে আইন (ব্যাক্তিগত কর্তব্য)। ব্যাক্তিগত কর্তব্য প্রত্যেক মুসলমানকে পালন করতে হবে। আর সমষ্টিক কর্তব্য কেউ করলেই চলবে, অন্যরা না করলে গুনাহ নেই। ব্যাক্তিগত কর্তব্যের শ্রেণী বিভাগ আছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফারাইয যা ঈমানের মৌলিক অঙ্গ, যেমন শাহাদাহ অথাৎ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ মোন্তোফা (সা) তাঁর রাসূল এবং কর্মে প্রতিফলন হচ্ছে সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জের মাধ্যমে। আরো কম গুরুত্বপূর্ণ ফারাইয আছে, কিন্তু এগুলোও বাধ্যতামূলক। ফরযে কিফায়ার চেয়ে ফরযে আইনের গুরুত্ব অধিক। পিতার প্রতি সদাচার ফরযে আইন যা জিহাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, জিহাদ ফরযে কিফায়াহ। পিতার অনুমতি ছাড়া পুত্র জিহাদে অংশ নিতে পারবে না। এ সম্পর্কে প্রামাণিক হাদীস আছে। আবার ব্যাক্তিগত অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ফরযে আইনের ওপর সামাজিক অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত ফরযে কিফায়াহ অগ্রাধিকার পাবে। মুসলিম ভূখন্ড আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরযে আইন। তখন পিতার অধিকার গৌণ হয়ে যায়। এমনিভাবে ওয়াজিবের ওপর ফরয, সুন্নাতের ওপর ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের ওপর সুন্নাতের অগ্রাধিকার রয়েছে। একইভাবে ইসলাম ব্যাক্তিগত আত্মীয়তার ওপর সামাজিক দায়িত্ব এবং এক ব্যাক্তির জন্যে উপকারী কাজের ওপর একাধিক ব্যক্তির উপকার হতে পারে এমন কাজে অগ্রাধিকার দেয়। নফল এবাদত, দান খয়রাতের চেয়ে দু’পক্ষের মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসার প্রতিও ইবাদত ইসলাম অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। একজন শাসককে তার নফল ইবাদতের চেয়ে তার সুবিচারের জন্যে বেশি পুরস্কার দেয়া হবে। অবক্ষয়ের যুগে মুসলমানরা যেসব ভুল করেছিলো সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেয়া হলো:
১. তারা উম্মার স্বাসংশ্লিষ্ট বৈজ্হানিক শিল্প ও সামরিক ক্ষেত্রে উদ্ভাবন ও উৎকর্ষ অর্জনের প্রচেষ্ঠা উপেক্ষা করেছে। এছাড়া ইজতিহাদ, আহকাম ও দাওয়া এবং স্বৈরশাসনের বিরোধিতা উপেক্ষা করেছে।
২. তারা ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধের মতো ব্যাক্তিগত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেনি।
৩.তারা কোনো মৌল বিশ্বাসকে কম গুরুত্ব দিয়ে অপর একটিকে বেশি পালন করেছে। তারা রমযানের নামাযের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অজন্যে নামাযীর চেয়ে রোযাদারের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে আবার কেউ কখনো সিজদাই করেনি। অনেকে যাকাতের চেয়েসালাতের বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যদিও আল্লাহ তায়ালা কুরআনে একত্রে বাইশ বার এ দু’টো কাজের আদেশ দিয়েছেন। এজন্যে সাহাবায়ে কিরাম বলতেন, “যাকাত ছাড়া সালাত বাতিল।” আর হযরত আবু বকর (রা) তো যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
৪. পরযসমূহ ও ওয়াজিবাতের চেয়ে নাওয়াফিলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সূফীদের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। তারা নানা আচার-অনুষ্ঠান, যিকর ও তাসবীহর ওপর মনোযোগ দিয়েছেন; সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচার প্রতিরোধের মতো সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেননি।
৫. তারা জিহাদ,ফিকাহ, আপোস-মীমাংসা, সৎকর্মে সহযোগিতা ইত্যাদির মতো সামাজিক দায়িত্ব অগ্রাহ করে ব্যাক্তিগত ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থেকেছেন।
৬. শেষত, অধিকাংশ মানুষ ঈমান, তাওহীদ, নৈতিক উৎকর্ষের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল ইত্যাদি মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে গৌণ বিষয়ে ওপর অযথা গুরুত্ব দিয়েছেন।
নিষিদ্ধ বিষয়গুলোরও শ্রেণীভেদআছে: যেমন, মাকরূহাত (ঘৃণা) কিন্তু গুনাহ নেই। যেগুলো ঘৃণা কিন্তু স্পষ্টবাবে নিষিদ্ধ নয়, এসব হালালের চেয়ে হারামের কাছাকাছি। মুতাশবিহাত (অস্পষ্ট বা নিগূঢ়) সেগুলোই যা অল্প লোকের কাছে জ্ঞাত এবং অজ্ঞতাবশত করে ফেলা হয়। এগুলো হারাম। সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ বিষয়গুলো কুরআন ও সুন্নায় বিস্তারিত বণূনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা কেন খাও না (গোশত) যাতে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়েছে যখন তিনি নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন?” (৬:১১৯)
এই নিষেধাজ্হা দু’ভাগে বিভক্ত: ছোট ও বড়। ছোট বিষয়গুলো অপসৃত হয় সালাত, সিয়াম ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে। কুরআনুল করীম থেকে আমরা জানি, “সুকৃতি দুষ্কৃতিকে অপরিসারিত করে।” (১১:১১৪)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত থেকে আমরা জানি, নিয়মিত সালাত ও সিয়াম আদায় করলে এরন মাঝখানের ছোট
ছোট গুনাহ মাফ হয়ে যায়। অবশ্য বড় পাপ কেবল খালেস তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে কবীরা গুনাহ হচ্ছে শিরক-আল্লাহর সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করা। এ গুনাহর কখনো মাফ নেই। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ মাফ করেন না, এছাড়া অনান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে মাফ করে দেন, যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।” (৪:৪৮)
অতঃপর হাদীসে উল্লেখিত পাপগুলো হচ্ছে: পিতামাতার অবাধ্যতা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, যাদু, খুন, সুদ, এতীমের সম্পদ আত্মসাৎ এবং মিথ্যা সাক্ষ্য করে সতী মুসলিম মহিলাদের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ।
নিম্মোক্ত বিষয়গুলো থেকে ত্রুটি ও বিভ্রান্তি দেখা দেয়:
ক. মানুষের মধ্যে মুহাররামাতের চেয়ে মাকরূহাত ও মুতাশাবিহাতের প্রতি বাধা দেয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে ওয়াজিবাতকে উপেক্ষা করা হয়। সুস্পষ্ট হারামের পরিবর্তে মতভেদের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি ব্যগ্রতা।
খ. অনেক লোক ভাগ্য গণনা , যাদু, মাযারকে নামাযের স্থান হিসেবে ব্যবহার, মৃতদের উদ্দেশ্য পশু উৎসর্গ, মৃতদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা ইত্যাদি কবীরা গুনাহর পরিবর্তে ছগীরা গুনাহ প্রতিরোধে বেশি ব্যস্ত। অথচ কবীরা গুনাহগুলো তাওহীদী চেতনাকে দূষিত করে।
একইভাবে বিভিন্ন মুসলমানের আচরণও বিভিন্ন। কোনো কোনো ধার্মিক যুবক জ্ঞান, ঈমান ও শক্তির ব্যাপারে অন্য সকলকে এমন চোখে দেখে যেন তারা সবাই সমান। সুতরাং তারা সাধারণ ও জ্ঞানী-গুণী মানুষের মধ্যেও পার্থক্য করতে পারে না। এছাড়া পুরানো মুসলমান ও ন্ওমুসলিম এবং প্রাকৃতিক ভিন্নতার দিকে লক্ষ্য রেখেই শ্রমসাধ্য ও সহজবোধ্য, ফারাইয ও নাওয়াফিল, বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক অধিকারী করলাম আমার বান্দদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরবে আমি মনোনীত করেছি; তবে তাদের মধ্যে কেউ নিজের ওপর যুলুম করে, কেউ মধ্যপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। এটাই মহাঅনুগ্রহ।” (৩৫: ৩২)
এ প্রসঙ্গে ‘যে ব্যাক্তি ভুল করেছে’ বলতে ‘যে নিষিদ্ধ কাজ এড়িয়ে গেছে এবং ‘যার ফরয কর্তব্য পালন অসম্পূর্ণ’ বোঝানো হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি মধ্যমপন্থা অনুসরণ করে’ বলতে ‘যে কেবল অবশ্য পালনীয় কাজ সম্পন্ন করে এবং নিষেধাজ্ঞা পরিহার করে’ এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যে ব্যক্তি সৎকর্মে অত্যন্ত অগ্রণী বলতে ‘যে ব্যক্তি বাধ্যতামূলক ্ও অনুমোদিত কর্তব্য পালন করে এবং নিষিদ্ধ কাজ’ কেবল পরিহার করে না সকল ধরনের বাজে ও নিন্দনীয় কাজ থেকে বিনত থাকে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। উপরিউক্ত ধরনের সকল লোকই ইসলামী উম্মাহর অর্ন্তভুক্ত যাদেরকে আল্লাহ্‌ কিতাব দিয়েছেন। এই দৃষ্টিতে কেউ ভুল করলেই তাকে ফিসকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা ঠিক হবে না অথবা মতভেদ আছে এমন আমল দেখলেই তাকে হারাম ফতোয়া দেয়াও যুক্তিযুক্ত নয়। যেসব তরুণ মুসলমান এরূপ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে, কুরআন স্পষ্টভাবে ছোট ও বড় গুনাহর পার্থক্য রেখা টেনে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহর। যারা খারাপ কাজ করে তাদেকে তিনি দেন মন্দ ফল আর যারা ভাল কাজ করে তাদেরকে দেন উত্তমপুরস্কার, তারাই বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে, ছোটখাট অপরাধ করলেও। তোমার প্রতিপালকের ক্ষমা অপরিসীম।” (৫৩:৩১-৩২)
ছোটখাট ত্রুটির প্রতি সহনীয় দৃষ্টভঙ্গির ব্যাখ্যা একটি আরবী শব্দ ‘লামাম’-এ (ছোট ত্রুটি) পাওয়া যায়। লামামের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে।্আল-হাফিজ ইবনে কাছির (র) সূরা আন-নিসার ২৫৫-২৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন: ‘আলমুহসিমুনন’ শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে যারা কবীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজ পরিহার করে অথাৎ বড় বড় নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করে। এরূপ লোক যদি ছোটখাট ভুল করে বসে, আল্লাহ্‌ তাকে মাফ করবেন এবং রক্ষা করবেন; যেমন তিনি আরেকটি আয়াতে ওয়াদা করেছেন:
“তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্রে যা গুরুতর তা হতে বিরত খাকলে তোমাদের লঘু পাপগুলো মোচন করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে দাখিল করব।” (৪:৩১)
তিনি আরো বলেন, “...যারা কবীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজ পরিহার করে, কেবল ছোটখাট ভুল (করে)” এখানে ছোটখাট ত্রুটিকে (লামাম) সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে, কেননা এগুলো ছগীরা গুনাহ ও লজ্জাকর কাজের উপ-শ্রেণীভুক্ত।
ইবনে কাছির (র)-এর পরে বলেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আবু হুরায়রাহ (রা) থেকে নিম্মোক্ত হাদীস শোনার পরেই কেবল লামেমের (ছোট খাট ত্রুটি) বিষয়টি আমি উপলব্ধি করেছি: ‘আল্লাহ্‌ পাক আদমের পুত্রের (মানুষ) জন্যে ব্যভিচারের অংশ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন যা সে অনিবার্যভাবেই করবে। চোখের যিনা হচ্ছে একদৃষ্টে সেই বস্তু দেখা যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; জিহবার যিনা হচ্ছে উচ্চারণ; অন্তরে কামনা-বাসনার উদ্ভব এবং গোপন অংগের মাধ্যমে যার আস্বাদন অথবা প্রত্যাখ্যান।”
তাই আবু মাসউদ (রা) ও আবু হুরায়রাহ (রা) বলেন, “লামামমের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে: ‘স্থির দৃষ্টিতে তাকানো, চোখের ইশারা, চুম্বন এবং প্রকৃতপক্ষে ব্যভিচার করা ছাড়াই যৌন সঙ্গমের নিকটবতর্তী হওয়া।”
লামামের অন্য ব্যাখ্যাও ইবনে আব্বাস (রা) দিয়েছেন: লজ্জাকর কাজ বটে কিন্তু এর জন্যে অনুতপ্ত হয়। তিনি পদ্যাকারে একটি হাদীসের উদ্ধৃত দেন যার রূপান্তর করলে দাঁড়ায়, “হে আল্লাহ, আপনার ক্ষমা সীমাহীন, কেননা আপনার বান্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে ছোটখাট ভুল করে না।” (ইবনে কাছির)
আবু হুরায়রাহ (রা) ও আল হাসান (রা) যুক্তি দেখান: গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করেই যে ভুল করা হয় তাই লামাম এবং যা ঘন ঘন করা হয় না। উপরিউক্ত আলোচনার তাৎপর্য দাঁড়ায়: যারা নিয়মিত কবীরা গুনাহ করে না তাদের জন্যে ইসলামের অঙ্গন বিস্তৃত; কেননা যারা অনুতপ্ত তাদের জন্যে আল্লাহর দয়া প্রশস্ত।
যারা নিয়মিত ফরয কাজ আদায় করে, তাদের নগণ্য ভুলগুলোকে উপেক্ষা করা যায় কিভাবে, তার একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টন্ত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাওয়া যায়। বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) যখন মিসরে ছিলেন তখন তার কাছে কিছু লোক গিয়ে বললো, অনেকেই আলকুরআনের শিক্ষা মেনে চলছে না এবং তারা এ ব্যাপারে খলীফা উমর (রা) তখন তাদেরকে মদীনায় উমর (রা)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং সফরের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। উমর (রা) তখন ঐ লোকেদের সাথে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে বললেন। বৈঠকে তার নিকটতম লোকটিকে উমর (রা) ব/ররেন, “সত্যি করে বলো, তুমি কি গোটা কুরআন পড়েছে?” লোকটি ইতিবাচক জবাব দিল। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নিজে কি এর শিক্ষা কড়াকড়িভাবে মেনে চলো যেন তোমার হৃদয় ও কাজকর্ম পরিশুদ্ধ হয়?” লোকটি প্রতিটির জবাবে নেতিবাচক জবাব দিলো। উমর (রা) তখন বললেন, “তুমি কি (নিষিদ্ধ বিষয় ও বস্তুর) দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকানোর ব্যাপারে, মুখে উচ্চারণ ও বস্তুর জীবনের আচরণে এ রশিক্ষাগুলো কড়াকড়িভাবে মেনে চলেছ?” লোকটি প্রতিটির জবাবে নেতিবাচক জবাব দিলো। উমর (রা) তখন গ্রুপের প্রত্যেকলোককে এই প্রশ্ন করলে প্রত্যেকে নেতিবাচক জবাব দিল।
এরপর উমর (রা) বললেন, “তাহলে তোমরা কি করে খলীফার কাছে দাবী করতে পার যে, তোমরা যেভাবে আল্লাহর কিতাবকে বুঝেছ তাই মানুষকে মানতে বাধ্য করি যা তোমরা নিজেরাই করতে ব্যর্থ হয়েছ বলে স্বীকার করলে? আমাদের প্রভু জানেন যে, আমরা প্রত্যেকে কিছু না কিছু খারাপ কাজ করে ফেলি।” অতঃপর তিনি কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন, “তোমরা যদি জঘন্যতম কাজগুলো থেকে বিরত থাকো তাহলে আমি তোমাদের সকল খারাপ কাজকে বিদূরিত করবো এবং মহান মর্যাদার তোরণে তোমাদের প্রবেশ করাবো।” (৪:৩১)
লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে উমর (রা) বললেন, “মদীনার বাসিন্দারা কি জানে তোমরা কি জন্যে একানে এসেছ?” তারা নেতিবাচক জবাব দিলে তিনি বললেন, “তারা যদি জানত তাহলে তোমাদেরকে আমি (শাস্তি দিয়ে) দৃষ্টান্ত বানাতাম।” (ইবনে কাছীর)
কুরআনুল করীমের গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উমর (রা) তাৎক্ষণিকভাবে সরেজমিনে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দিলেন এবং এভাবে অহঙ্কারও গোঁড়ামির গোড়া কেটে দিলেন। এ ব্যাপারে তিনি যদি এতোটুকু দুর্বলতা দেখাতেন তাহলে সুদূরপ্রসারী মারাত্মক ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিলো।
৩. অন্যের প্রতি সহৃদয় অনুভূতি
ব্যক্তিগতভাবে মানুষের ক্ষমতার তারতম্য এবং জীবনের রূঢ় বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর থাকে। অন্তর্দৃষ্টি ও ফিকহের জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যের এই বাস্তবতার প্রতিও পরস্পরের সহৃদয় অনুভূতি থাকা আবশ্যক। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সকলের কাছ থেক হযরত হামযাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (রা) মতো শাহাদাতের শৌর্য প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। এটি এমন মহৎ গুণ, গভীরতম নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায় ছাড়া যার প্রকৃত মর্ম খুব কম লোকই অনুধাবন করতে পারে।
কেউ কেউ শান্তভাবে সত্যের পক্ষে কথা বলে তৃপ্তিবোধ করে; অন্যেরা তাদের ধারনণা অনুযায়ী বিরাজমান মারাত্মক অবস্থার প্রেক্ষিতে নীরব থাকই নিরাপদ মনে করে। আবার অনেকে মনে করেন আগা নয়, গোড়া থেক সংস্কার কাজ চালাতে হবে। এজন্যে তারা ব্যাক্তি বিশেষের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তারা মনে করে, এসব লোকের দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃত ও পরিশুদ্ধ করতে পারলে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এটা বলাবাহুল্য, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্মূল করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর ভিত্তিতে একটি ইসলামী সঙগঠনের নেতৃত্বে সম্মলিত সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্য শরীয়ত এক মুন্‌কার থেকে যেন আরেকটি বড় মুনকারের সৃষ্টি না হয় সেজন্যে অনেক ক্ষেত্রে নীরবতাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল করীমে হযরত মূসার (আ)-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। মূসা (আ:) -কে তার স্থলাভিষুক্ত করে যান। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরপরই ইসরাঈলীরা সামেরিদের পরামর্শে একটি সোনার গো-মূর্তি বানিয়ে পূজো করতে শুরু করে। এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে হারুন (আ)-এর বক্তব্য শুনতেও তারা অস্বীকার করে। কুর্আন বলছে:
“হারুন তাদেরকে আগেই বলেছিলেন, হে আমার স্বজাতি! তোমাদেরকে এর দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের দয়াময়; সুতরাং তোমরা আমাকে অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল। তারা বলেছিলো: আমাদের কাছে মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা পূজা হতে কিছুতেই বিরত হব না।” (২০:৯০-৯১)
তাদের অনমনীয়তা দেখে হারুন (আ) নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মূসা (আ) ফিরে এসে ক্রোধে ও দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে হারুন (আ)-কে রূঢ়ভাবে তিরস্কার করলেন। কুরআনের বর্ণনা, “মুসা বলল, ও হারুন! তুমি যখন দেখলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছ তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল- আমার অনুসরণ করা হতে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে!” (২০:৯২-৯৩)
হারুন (আ) জবাব দিলেন : “হে আমার সাহোদর! আমার দাড়ি ও চুল ধরে টেনে না; আমি আশংকা করেছিলাম যে, তুমি বলবে, তুমি বনী ইসরাঈলেদের মধ্যে বিভদ সৃষ্টি করেছে এবং তুমি বলবে, তুমি আমার কথা পালনে যত্নবান হওনি।” (২০ : ৯৪) সুতরাং দেখা যাচ্ছে সামাজি ঐক্য ও সম্প্রীতির স্বার্থে হারুন (আ) হযরত মূসা (আ) ফিরে না আসা পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করেছেন। এই ঘটনার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীসের সাজুয্য লক্ষ্যণীয়। তিনি বলেছিলেন, তাঁর অনুসারীরা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে কা’বা নির্মাণ থেকে বিরত থেকেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনান্য আদেশ থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়্। যেমন যদি অত্যাচারী-অনাচারী শাসককে হটিহটিয়ে সৎ ব্যাক্তির সরকার কায়েমের ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসকের অবিচার সহ্য করার কথা আছে। কেননা প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহ্ত্তর ফিতনার সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত বা সামাজিক স্থিতিশীরতা যেন বিনষ্ট না হয় অথাৎ বাস্তব ফল ছাড়া কেবল অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই কাম্য। অন্যথায় পরিস্থিতি এমনও হতে পারে যে, কুফরী অথবা রিদ্দাহর দিকেও মোড় নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “যতোক্ষণ না তুমি প্রকাশ্য কুফরী প্রত্যক্ষ কর যার পক্ষে তোমার কাছে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে প্রমাণ আছে।” ((বুখারী, মুসলিম)
দু’টি দৃষ্টান্ত অনিশ্চিত সাফল্যের মুখে ঐক্য বজায় রাখার ওপর আলোকপাত করেছে। পক্ষান্তরে ইসলামী শিক্ষা পালনে ক্ষেত্রে যেসব ভাববাদী মুসলমান চরম পূর্ণতা দেখতে চায় অযথা যারা একেবারে বর্জন করতে চায় তাদের উভয়ের জন্যে এই ঘটনাগুলো শিক্ষণীয়। এদের কাছে কোনো মধ্যপন্থা নেই। ভাববাদীরা মুন্‌কার উচ্ছেদ শক্তি প্রয়োগকেই শেষ হাতিয়ার মনে করেন। তারা অন্য দু’টি পথ অর্থাৎ কথা ও হৃদয় দিয়ে প্রতিরোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। মোটকথা, প্রতিটি উপায় প্রয়োগ নির্ভর করে ব্যাক্তির ক্ষমতা ও পরিস্থিতির ওপর। আশ-শরীয়াহ বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করার ওপর এতো দূর গুরুত্ব দিয়েছে যে, নিরূপায় অবস্থায় হারামও হালাল হয়ে যায় এবং ওয়াজিব স্থগিত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এবিষয়ে বুদ্ধিসীপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন:
“আল্লাহ্‌ তা#য়ালা কুরআনুল করীমে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে, তিনি ক্ষমতার বাইয়ে অতিরিক্ত বোঝা মানুষের ওপর চাপাতে চান না।” তিনি বলেন, “আল্লাহ্‌ কারো ওপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।” (২:২৮৬) “আমরা কাউকেই তার সাধ্যাতীত অর্পণ করি না।” (৭:৪২)
“কাউকেই তার সাধ্যতীত কার্যভার দেয়া হয় না এবং আল্লাহ যাকে যে সামর্থ দিয়েছেন তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপন না।” (৬৪:১৬) ঈমানদারই তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছে: “হে প্রভু, আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন আমাদের ওপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না। হে প্রভু! এমন ভার আমাদের ওপর অর্পণ করবেন না যা বহন করার শক্তি ্আমাদের নেই।” (২:২৮৬)
আল্লাহ্‌ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন। এসব আয়াত প্রমাণ করেছে যে, তিনি মানুষের ওপর এমন বোঝা চাপান না যা সে বহন করতে পারবে না। এটা নিশ্চিত যে, জাহমিয়া, কাদিরিয়া ও মুতাযিলা দর্শনের সাথে এর কোনো সংগতি নেই। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে যে, যদি কোনো শাসক, ইমাম, বুদ্ধিজীবি, ফকীহ অথবা মুফতী আল্লাহ্‌র খালেস ভয়ে তার সাধ্য অনুযায়ী যে ইজতিহাদ করবে তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তার কাছ থেকে এটাই চেয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। এর বিপরীত কাদিয়রা ও মুতাযিলারা যে ধারণা পোষণ করে তা বাতিল।
কাফিরদের বেলায়ও একই বিষয় প্রযোজ্য। যারা কুফরীর দেশে রাসূলের দাওয়াত পেয়ে তাঁকে রাসূল বলে স্বীকার করলেন এবং তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওহীকে বিশ্বাস করে যথাসাধ্য আনুগত্য করলেন-যেমন নাজ্জাশী ও অন্যান্য, কিন্তু ইসলামের ভূখন্ডে যেতে না পরার দরুন শরীয়তকে সামগ্রিকভাবে মানতে পারলেন না; কারণ তাদেরকে দেশত্যাগের অনুতি দেয়া হয়নি অথবা প্রকাশ্যে আমলের সুযোগ পাননি এবং তাদেরকে সমগ্র শরীযাহ শিক্ষা দেয়ার মতো লোক ছিল না। এমন সকল মানুষের জন্যে আল্লাহ জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরূপ আরো উদাহরণ আছে। আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের লোকদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিলো তাদের সম্পর্কে বলছেন: “এবং তোমাদের কাছে পূর্বে ইউসুফ এসেছিলেন স্পষ্ট নিদের্শন সহকারে, কিন্তু তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন তাতে তোমরা বার বার সন্দেহ পোষন করতে । অবশেষে তিনি যখন ইন্তিকাল করলেন তখন তোমরা বলেছিলে, তারপরে আল্লাহ্‌ আর কাউকে রাসূল করে পাঠিবেন না।” (৪০-৩৪)
নাজ্জাশী খৃস্টানদের রাজা ছিলেন; কিন্তু তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বললে তারা অস্বীকার করলো। কেবল মুষ্টিমেয় লোক তাকে অনুসরণ করেছিলো। তিনি যখন মারা গেলেন তখন তার জানাযা পড়ারও কেউ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় তার জানাযা পড়েন এবং উপস্থিত সকলকে বলেন, “আবিসিনিয়ায় তোমাদের মধ্যেকার একজন সৎ কমর্মশীল ভাই মারা গেছেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
যদিও নাজ্জাশী ইসলামের অনেক শিক্ষা মানতে পারেননি, দেশত্যাগ করেননি, জিহাদে অংশ নেননি অথবা হজ্জ্‌ও করেননি। এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সিয়াম অথবা যাকাতের কতর্তব্য পালন করতে পারেননি; কেননা তার ঈমানের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জনগণ তার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আমরা জানি, তিনি আল-কুরআনের বিধানও প্রয়োগকরেননি, যদিও আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে আহলে কিতাবরা চাইলে তাঁর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করার আদেশ দিয়েছিলেন। আবার আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূলকে এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন, “আহলে কিতাবরা যেন তাকে ওহীর অংশ বিশেষ খথেকেও বিচ্যুত করার জন্যে প্রলুব্ধ করতে না পারে।” কঠোর ন্যায়পরায়ণতার জন্যে উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-কে অনেক বিড়াম্বনা সইতে হয়েছে। এজন্যে তাকে বিষ প্রয়োগও করা হয়েছিলো বলে জানা যায়। কিন্তু নাজ্জাশী এবং তার মতো অন্যরা এখন জান্নাতে শান্তিতে আছেন যদিও তারা শরীয়তকে পূর্ণরূপে পালন ও প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি, বরং তাই করেছেন যা তাদের কাছে প্রযোজ্য মনে হয়েছে। (মাজমুয়া আল ফাতওয়া)
৪. আল্লাহর সৃষ্টি রীতির জ্ঞান
ইসলাম যুক্তি ও অনুসন্ধিৎসার ধর্ম। এ কারণে পর্যায়ক্রম, সহিষ্ণুতা ও ক্রমিক পূণর্ণতার তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। মানূষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দ্রুতির প্রবণতা অন্তর্নিহিত। অবশ্য এটি আমাদের যুগেরও বৈশষ্ট্য। এজন্যে আজ ফসল বুনে কালই তা কাটতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্‌র সৃষ্টিরীতি অনুযায়ী এরূপ দ্রুতির কোনো অবকাশ নেই। গাছ থেকে ফল আহরণ করতে হলে এর পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করতে দিতে হবে। মানুষের সৃষ্টি ত এর প্রকৃষ।ট নজীর। কুরআন বলছে:
“অতঃপর আমি শুক্রকে পরিণত করি রক্তপিণ্ড, তারপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি মাংসপিণ্ডে, তারপর মাংসপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে, পরে অস্থিপঞ্জরকে মাংসে আবৃত করে দিই; অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্‌ কত মহান!” (২৩-১৪)
এমনিভাবে মানুষও শিশু থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাপ্তবয়স্ক পরিণত হয়। একইভাবে আল্লাহ্‌র সুনান অনুযায়ী মানুষের জীবনেও বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌র দ্বীন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে অবশেষে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। তখন এই আয়াত নাযিল হয়েছে:
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, এই ইসলামকেই তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।” (৫:৩) বিষয়টি অন্তত্য সহজ সরল; কিন্তু চারদিকের অবস্থা দেখে উৎসাহী তরুণরা এতোই বিক্ষুব্ধ যে, এই জ্ঞান তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তারা রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে সব সমস্যার সমাধানকরে ফোলতে চায়। তারা তাদের সম্মুখবর্তী বাধা-বিপত্তিকে লঘু দৃষ্টিতে দেখতে চায়। বস্তুত তাদের এই উভয় সংকটকে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যায়। এক ব্যক্তি আবু শিরিন (র) - কে একটি স্বপ্নের তাবির বলার অনুরোধ করেছিলো। সে স্বপ্ন দেখেছিলো যে, সে শুকনো জমিতে সাঁতার দিচ্ছে, ডানা ছাড়াই উড়ছে।” ইবনে শিরিন (র) তাকে বললেন, তিনিও এমন অনেক স্বপ্ন ও আকাংখা পোষণ করেন। হযরত আলী (রা) তার পুত্রকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “...ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা থেকে সাবধান, এগুলো হচ্ছে আহাম্মকের উপকরণ।” অতএব এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিপরীত বাস্তবতাকে কেবল ইচ্ছার হাতায়ার দিয়ে পাল্টানো যাবে না। প্রসঙ্গত একিট অমূল্য বইয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: ‘হাত্তা ইয়ুগাইয়িরু মা বিআনফুসিহিম’ (যতোক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়) । এটি লিখেছেন সিরীয় মনীষী জাওদাত সাঈদ (র) বইটিতে আত্মা ও সমাজের পরিবর্তন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে কুরআনের এই আয়াত : “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোনো জাতার অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (১৩ : ১১)
এবং ‘কারণ, আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়কে প্রদত্ত সৌভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ না তারা নিজেরাই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়।” (৮ : ৫৩)
বইটির ভূমিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে : “মুসলিম তরুণদের মধ্যে অনেকেরই ইসলামের জন্য জান ও মাল কুরবানীর দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয় সংখ্যক তরুন জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় অথবা দুর্বোধ্য সত্যকে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে অধ্যয়নে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ঈমান ও আমল তথা বর্ণনা ও বাস্তবের শ্রণীবিভাগ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয় এমন সমস্যা সৃষ্টি করে যার বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যপূর্ণ সমাধান না হলে গঠনমূলক সংস্কার অসম্ভব। ইসলামী বিশ্ব এখনো গবেষণা ও লেখনীর র্মম উদ্ধার করেত পারছে না । কারণ তারা এখনো মনে করে যে, ‘মসির চেয় অসি শক্তিশালী।’ এজন্যেই আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা স্তবিরতায় পর্যবসিত হয়েছে। ‘ঝাঁপ দেয়ার আগে চিন্তা করার কথা আমরা ভুলেই গেচি। ফলত উপরিউক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। এসবের মধ্যেকার পারস্পরিক সমন্বয় ও শৃংখলার বিষয়টি আমারা অধ্যায়ন বা উপলব্ধির চেষ্টা করছি না।
তদুপরি মুসলিম বিশ্বে ঈমানের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা এখানে সতক”র্ পর্যালেচনা করছি না। এটার অর্থ এই নয় যে, মুসলমানদের ইমান ও ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান নেই। আমরা বরং মানসিক অবস্থার কথা বলতে চাই যা অবশ্যই মনের গহীন থেকে পরিবর্তন করতে হবে। আর ঐ পরিবর্তনই কেবল সৃষ্টিতে সক্ষম।
আত্মত্যাগ ও সাদকার প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি না করে এখনো বিশ্বাস করা হয় যে, ঐ দু’টো সবচেয়ে মহত্তম পুণ্য। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশলের অনুপস্থতিতে কেবল কুরবানী করলেই এর লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না । অবুঝ বিশ্বাস তরুণ মনে জানমাল কুরবানীর আবেগ সৃষ্টি করে বটে, এর তাৎপর্য অধ্যয়ন ও উপলব্ধির চেতনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ বা চাপ থেকে কুরবানীর প্ররণা আসে; কিন্তু জ্ঞানের অন্বেষার জন্যে দাকার অবিশ্রান্ত অধ্যবসায়, চৈতন্য, অন্তদৃষ্টি ও সমীক্ষার মানসিকতা। আর এটিই পরিশেষে নিশ্চত সাফল্যের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল করে।
অবশ্য কোনো কোনো তরুণ বিভিন্ন বিভাগে অধঘ্যয়ন-পঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেও শেষাবধি একঘেঁয়ে ক্লান্তি অনুভব করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং জ্ঞান-গবেষণা হিমাগারে আশ্রয় নেয়। আমাদেরকে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই জড়তা ও স্থাবিরতার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতা ছাড়াই দ্রুত পরিবর্তন সাধনের প্রবণতা অবান্তর। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া উলব্ধি এক জিনিস, আমাদের নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা অন্য জিনিস। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আল কুরআনের এই শিক্ষার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনে সমস্যার অন্তস্থল হিসেবে খুদী বা অহমকে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাইরের অসদাচরণ বা অনাচার নয়। কুরআনুল করীমে সম্পদের যে কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে তার মূল কথা হলো এটাই। এই সহজ সরল সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং এই তখন নৈরাশ্য, বৈরাগ্য ও স্বৈরাচারী দর্শনের উদ্ভব ঘটে।
অতএব মারাত্মক স্বআরোপিত অবিচার হচ্ছে মানুষ, মহাজগত ও সমাজের অন্ত র্নিহিত অনুষঙ্গ অনুধাবনে ব্যর্থতা। ফলত কোন্‌ অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করলে মানুষ আল্লাহ্‌র সুনান (রীতি) অনুযায়ী মানবীয় ও প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম উপায়ে আহরণ করতে সক্ষম, তার বিচার করতে ভুল করে সে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে। এই দৃষ্টিতে, সমস্যার সম্মুখীন হলে দু’টি মানসিকতার উদ্ভব হয়। প্রথমত, এটা বিশ্বাস করা যে, সমস্যাটি নির্দিষ্ট ধারায় নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হওয়া যে, এটি রহস্যময় ও অতিপ্রাকৃতিক, অতএব কোনো রীতি দ্বারা ্এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। এই দুই চরম মানসিকতার মাঝে বহুবিধ মধ্যবর্তী দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যা মানুষের অনুসৃত পন্থা, আচার-আচরণ ও ফলাফল থেকে আঁচ করা যায়।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মুসলমানদের জীবন নির্বাহে ব্যর্থতা একটি সমস্যা যা সহজেই অনুমেয়। এটি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির কোন্‌টি মুসলমানদের পোষণ করা উচিত? বস্তুত এরূপ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সচেতনতা সৃষ্টি করলেই মুসলমানরা সমস্যার সমাধানে কোন্‌ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং কোন্‌টি পরিহার করবে তা নির্ণয়ে সহায়ক হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুই দৃষ্টিভঙ্গি গুলিয়ে গিয়ে প্রতিটিই অবান্তর হয়ে গেছে। সুতরাং এর সমাধান বহুলাংশে নির্ভর করে পরিচ্ছন্ন অন্তর্দৃষ্টি উপর।”
সুনান ও সাফল্যের শর্তে
নিচে আমার ও একজন তরুণ মুসলমানদের মধ্যকার সংলাপ তুলে দিলাম। আমি কি তার প্রশ্নের জবাব দিই।
প্রশ্ন: আমরা কি সত্যের অনুসরণ করছি এবং আমাদের বিরোধীরা কি বাতিলের অনুসরণ করছে?
উত্তর: জী, হ্যা।
প্রশ্ন: আমাদের প্রভু কি ওয়াদা করেননি বাতিলের ওপর হক এবং কুফরির ওপর ঈমানের বিজয় হবে?
উত্তর: অবশ্যই, আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
প্রশ্ন: তাহলে আমরা কিসের জন্যে অপেক্ষা করছি? আমরা বাতিলের বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ ঘোষণা করি না?
উত্তর: আমাদের ধর্ম শিক্ষা দেয় বিজয়ের জন্য শর্ত ও সুনান আছে। এটা আমাদের মানতে হবে। এই বিবেচনা না থাকলে রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কী যুগে প্রথমেই পৌত্তলিকতার বারুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। মূর্তি-অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও কা’বায় সালাত আদায় করা তাঁর পক্ষে অসহনীয় মনে হতো। প্রশ্ন: এই সুনান ও শর্ত কি?
উত্তর: প্রথমত, কেবল হক বলেই হক আল্লাহ্‌ বিজয়ী করেন না। তিনি সৎকর্মশীল লোকদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই বিজয় দান করেন। কুরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে: “তিনিই তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাঁদের পরস্পরের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করেছেন।” (৮:৬২-৬৩)
প্রশ্ন: কোথায় সেই ফেরেশতা যাঁরা হকের পক্ষে ও বাতিলের বিরুদ্ধে সাহায্যে করেছিলেন-যেমন তাঁরা বদর, খন্দক ও হুয়ানের যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন?
উত্তর: আল্লাহ যখন ইচ্ছে করবেন তখন ফেরেশতারা মুমিনদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তাঁরা শূন্যের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন না। দুনিয়ায় হকের জন্য সংগ্রামরত সত্যিকার প্রয়োজন হবে এবং যাদেরকে শক্তিশালী করার জন্যে আল্লাহ্‌র সাহায্যের প্রয়োজন হবে। বদরের যুদ্ধের সময় নাযিলকৃত আয়াত থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়: “স্মরণ করো, তোমাদের প্রভু ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন: আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং মুমিনদের অবিচলিত রাখ। যারা কুফরি করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো। (৮:১২)
প্রশ্ন: সত্যিকার ঈমানদার আছে কি? তাতেই কি বিজয় নিশ্চিত হবে?
উত্তর: তাদেরকে যথাসাধ্য ইসলামের প্রচার চালিয়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যাএ শত্রুর শক্তি সাথে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। একজনের পক্ষে একশ’ বা হাজারেরর বিরুদ্ধে লড়াই করা অযৌক্তিক হবে। কুরআনুল করীমে যে ভারসাম্যের কতা বলা হয়েছে তাতে একজন সত্যিকার মুমিন দশ জনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে:
“হে নবি! ঈমানদারদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন। তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন ধৈর্যশীল থাকে তারা দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন থাকলে এক হাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে।” (৮:৬৬) প্রশ্ন: কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ সদা সতর্ক, তারা অন্তর্ঘাতী কৌশলে উৎকর্ষতা লাভ করেছে।
উত্তর: এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, এমন একটি অপরিহার্যশর্ত আছে যা ছাড়া বিজয় সুনাশ্চিত হতে পারে না। তা হচ্ছে, বিপদ ও কষ্টে সহিষ্ণুতা ও উস্কানির মুখে দৃঢ়তা। রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-কে বলেন, “সহিষ্ণুতা বিজয়ের একটি পূর্ব শর্ত।”
আল্লাহ্‌ পাক স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এই উপদেশ দিয়েছেন: “তোমার ওপর যে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তুমি তা অনুসরণ করো এবং তুমি ধৈর্য ধারণ করো যে পর্যন্ত না আল্লাহ্‌র বিধান আসে এবং আল্লঅহ্‌ই সর্বোত্তম বিধানকর্তা।” (১০:১০৯) অন্য আরকেটি আয়াতে বলা হয়েছে, “ধৈর্য ধারণ করো, তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহ্‌রই সাহায্যঅ তাদের দরুন দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়ো না। আল্লাহ্‌ তাদেকই সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ক্ষমাশীল।” (১৬:১২৭-১২৮)
আল্লাহ্‌ আরো বলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চই আল্লহ্‌র ওয়াদা সত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয় তারা যেন তোমাকে বিচলিত না করতে পারে।” (৩০-৬০) আল্লাহবলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রসূলগণ।” (৪৬-৩৫)
এবং আল্লাহ্‌ আরো বলেন: ধৈর্য ধারণ কর তোমার প্রভুর আদেশের অপেক্ষায়। তুমি আমার চোখের সামেনই আছ। তুমি তোমার প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তুমি শয্যা ত্যাগ কর। (৪৬:৩৫)
প্রশ্ন: কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাফল্য ছাড়া আমরা দীর্ঘদিন কি ধৈর্য ধারণ করতে পারব?
উত্তর: কিন্তু আপনারা কি ইতিমধ্যে একটি অজ্ঞ লোককেও শিখ্ষা দেবেন না, কাউকে কি সৎপথে আনবেন না অথবা কাউকে কি তওবায় অনুপ্রাণিত করবেন না? যখন সে ইতাবচক জবাব দিলো তখন আমি বললাম, এটাই হচ্ছে আমাদের বিরাট সাফল্য যা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “আল্লহ্‌ যদি একটি লোককেও তোমার চেয়েও অনেক উত্তম।” তাছাড়া আমাদের কাছে দাওয়াত পৌছানোর ব্যাপারেই কৈফিয়ত চাওয়া হবে, আমরা নিজেরা তাতে সফল হলাম কিনা তা নয়। আমাদেরকে অবশ্যই ভালবাসার বীজ বপণ করতে হবে এবং আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করতে হবে যাতে উত্তম ফসল পাওয়া যায়। আল-কুরআন সবর্ত্রই আমাদের পথ-প্রদর্শক: “এবং বলো, তোমরা আমল করতে থাক। আল্লাহ্‌ তো তোমাদের কর্যকলাপ লক্ষ্য করবেন এবং তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও করবে এবং তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট, অতঃপর তিনি তোমরা যা করতে তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।” (৯:১০৫)
মুসলিম তরুণদের প্রতি উপদেশ
‘আলউম্মাহ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধে আমি মুসলিম তরুণ পুনর্জাাগরণের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। তাতে আমি পরিশেষে দু’টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি।
প্রথম: এই পুনর্জাগরণ একটি স্বাভাবিক ও সুস্থ চেতনার ইঙ্গিতবাহী। এর মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি ও মূলের দিকে অর্থাৎ ইসলামের দিকে ফিরে যাচ্ছি। ইসরামই হচ্ছে আমাদের জীবনে প্রথম ও শেষ। এখানেই আমরা বিপদে আশ্রয় নিই, এখানে থেকেই আমরা শক্তি সঞ্চয় করি।
আমাদের সমাজ পূর্ব ও পশ্চিমের কাছ থেকে ধার মতবাদ দিয়ে সমস্যা মাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উন্নতিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এখন আমাদের জনগণ ইসলামের অনিবার্য সমাধানে বিশ্বাস করে অথাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী শারীয়াহর বাস্তবায়ন চায়। অতএব এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মুসলিম তরুণদের সাহস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয়: আমাদের কিছু কিছু তরুণের মধ্যে যে গোঁড়ামি রয়েছে তা হিংসা ও হুমকি দিয়ে পরিশুদ্ধ করা যাবে না। আল্লাহ্‌র দ্বীনের প্রতি এদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে সদিচ্ছা ও আন্তরনিকতা নিয়ে তাদের সাথে মেলামেশা করে তাদের মন-মানসিকতা উপলব্ধি করা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্রান্ত ধারনা দূর করতে উদ্যোগী হওয়া।
আমি কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম তরুণদের এ ব্যাপারে অনেক উপদেশ দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈমানদারদের একে অপরের সাথে সর্বদা পরামর্শ করা উচিত এবং ধৈর্যের সাথে সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং অসৎ ও অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত থাকা। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে পুরস্কার লাভের জন্যে এটি আবশ্যকীয় শর্ত। নিচে আমি আরো কিছু উপদেশ দিচ্ছি:
আমরা বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের যুগে বাস করছি। জ্ঞানের একটি শাখায় ব্যুৎপত্তির মানে আরেকটি শাখায়ও পারদর্শী হওয়া নয়। যেমন একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ করা যায় না অথবা একজন চিকিৎসকের সাথে আইনের পরামর্শ চাওয়া হাস্যকর। অতএব শারীয়ারহর জ্ঞানও সকলের সমান মনে করা ভুল। এটা ঠিক যে, ধর্মীয় জ্ঞানের শ্রেণী বিশেষের একচোটিয়া অধিকার ইসলাম স্বীকার করে না, যেমন খৃস্টানদের যাজক গোষ্ঠী রয়েছে বা হিন্দুদের ব্রাহ্মণবর্গ। কিন্তু ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানের জ্ঞানে বিশেষজ্ঞদের অস্তিত স্বীকার করে যারা কোনোভাবেই একটি বিশেষ গোষ্ঠী, শ্রেণী আ উত্তরাধিকারসূত্রে বংশগত নয়। বাস্তব কারণেই ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কুরআন বলেছে: “সকর মুমিনকে এক সাথে অভিযানে বের হওয়া উচিত নয়, তাদের প্রতিটি দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্হান অনুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়।” (৯:১২২)
কুরআন ও সুন্নাহর যেসব বিষয়ে আমাদের জ্হান নেই তা বিজ্ঞ ও অবিজ্ঞ লোকদের কাছ থেকে শিখতে বলেছে: “তোমার পূর্বে আমি ওহীসহ মানুষই পাঠিয়েছিলাম, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো।” (২১:৭)
এবং “যখন শান্তি অথবা শঙ্কার কোন সংবাদ তাদের কাছে আসে তখন তারা তা প্রচার করে থাকে। যদি তারা তা রাসূল অথবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত।” (৪:৮৩)
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেন, “সর্বজ্ঞের ন্যায় তোমাকে কেউই অবহিত করতে পারে না।” (৩৫:১৪)
রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জানানো হলো যে, একজন আহত ব্যক্তিকে এই ফতোয়া দেয়া হয়েছে যে, অযু ও নামাযের আগে তার গোটা শরীর ধুয়ে ফেলতে হবে, যার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে।তখন তিনি বললেন: “তারা তার মৃত্যু ঘটিয়েছে, আল্লাহ্‌ তাদেরও মৃত্যু ঘটান। সঠিক জানা না থাকলে তাদের কি জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল না?”এটা খুব বেদনাদায়ক যে, কোনো কোনো লোক অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও জটিল বিষয়েও য়তোয়া দিতে অভ্যস্ত যা অতীত বর্তমান আলিমদের ফতোয়ার বিরোধী। তারা আগের আলিমদেরকে অজ্ঞ বলতেও কসুর করে না। তারা দাবী করে ইজতিহাদের দরজা সকলের জন্যে খোলা। এটা সত্য, কিন্তু ইজতিহাদের কতকগুলো শর্ত আছে যা এদের মধ্যে নেই। আমাদের পূর্ববর্তীরা তো অনেক বিজ্ঞ লোককেও সতর্ক বিবেচনা ছাড়া তাড়াতাড়ি ফতোয়া দেয়ার জন্যে সমালোচনা করেছেন। তারা বলেন, “কিছু কিছু লোক এত দ্রুত ফতোয়া দেয় অথচ তা হযরত উমার (রা)-এর কাছে পেশ করা হলে তিনি বদরের যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী সকলের সাথে পরামর্শ করতেন এবং তারা আরো বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ফতোয়া দেয়ার ব্যাপারে দুঃসাহসী (পাপ করে) দোযখে যাওয়ার ব্যাপারেও।” গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা জটিল বিষয়ে বিজ্হ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করতেন। যেসব ফতোয়া মৌনভাবে দেয়া হতো ইসলামের প্রাথমিক যুগে সেগুলোকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেয়া হতো। কারো কাছে ফতোয়া চাওয়া হলে তারা পারত পক্ষে বিরত থাকতেন। আবার কেউ কেউ জানেন না বলে এড়িয়ে যেতেন।
উতবান ইবনে মুসলিম (রা) বলেন যে, একবার তিনি ৩০ মাস উমর (রা)-এর সং্গী ছিলেন। সে সময় উমর (রা)-কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং তিনি প্রায়শ বলতেন যে, তিনি জানেন না। ইবনে আবু লায়লা (রা) ১২০ জন সাহাবীর, (এঁদের মধ্যে অধিকাংশই আনসার), সম্পর্কে বলেছেন, “তাঁদের মধ্যে একজনকে জিজ্হেস করা হলে তিনি আরেকজনকে দেখিয়ে দিতেন, তিনিও আরেকজনকে দেখিয়ে দিতেন, তিনিও আরেকজনকে, এভাবে পালাক্রমে চলতো যতক্ষণ না প্রশ্নকর্তা আবার প্রথম ব্যক্তির কাছেই ফিরে যেতো।”
আতা ইবনে আস সাবির (র) বলেন যে, তিনি তার সমসাময়িক অনেককে ফতোয়া দিতে গিয়ে কাঁপতে দেখেছেন। তবিয়ুনদের মধ্যে সাঈদ ইবনে আল মুসাইয়েব (র) - কে কচিৎ ফতোয়া দিতে দেখা গেছে অথচ তিনি ফিকাহতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। যদি তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে থাকেন এবং তাদেরকেও রক্ষা করতে যদি তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে থাকেন এবং তাদেরকেও রক্ষা করতে যারা সেই ফতোয়া অনুসরণ করবে। মাযহাব চুষ্টয়ের ইমামগণও অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কোনো ব্যাপারে নিশ্চিত না হলে তারাও বলতেন যে, জানি না। ইমাম মালেক (র) বিশেষভাবে সতর্ক ছিলেন। তিনি বলেন, “কাউকে কোনে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তার ‘জান্নাত ও জাহান্নম’ সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত এবং জবাব দেয়ার আগে নিজের পারলৌকিক মুক্তি সর্ম্পকে ভাবা উচিত। ইবনে আল কাসিম (র) ইমাম মালিক (র) -কে বলতে শুনেছেন, “আমি একটা বিষয়ে দশ বছর ধরে গবেষণা করছি কিন্তু এখনো মনঃস্থির করতে পরিনি।” এবনে আবু হাসান (র) বলেন, “মালিককে ২১ টি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “তিনি মাত্র দু’টির ফতোয়া দিয়েছিলেন। তারপর বার বার বলেন, ‘আল্লাহ্‌ ছাড়া কোনো সাধ্য রবা ক্ষমতা নেই।” জ্ঞানের অম্বেষা থেকে তরুণদের নিরুৎসায়িত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করা আমাদের জন্যে ফরয। আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে তাদের জ্হান যতোই হোক, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে তারা বাধ্য। আশ-শারীয়াহর জ্হানে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও উসুল আছে যা জানা ও বোঝার সময় বা উপায় এই তরুণদের নেই।আমি বলতে চাই যারা কলেজে ভালো লেখাপড়া করে তাদেরকে সেটা ছেড়ে দিয়ে আশ-শারীয়ায় বিশেষজ্ঞ হতে হবে এমন প্রবণতা আমি অনুমোদন করি না। আরেকটি বিষয় বুঝতে হবে, এখন বিজ্হানে দক্ষতা অর্জনের জোর প্রতিযোগিতা চলছে। কোনো মুসলমান যদি আল্লাহ্‌র জন্যে বিজ্হানে বুৎপত্তি অজর্নের সাধনায় নিম্গ্ন হয় সে আসলেই ইবাদত ও জিহাদে অংশ নেয়।
এখানে স্মর্তব্য, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে ওহী নাযিল হওয়ার কালে তাঁর সাহাবীদের
বিভিন্ন পেশা ছিল। তিনি তাদেরকে নিজ নিজ পেশা ত্যাগ করে আসলাম অধ্যয়নের তাগিদ দেননি; অবশ্য তারা বাদে যাদেরকে এরূপ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কিংবা যাঁদের এ ব্যাপারে স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। আমার ভয় হয় অনেক হয়তো জনপ্রিয়তা বা নেতৃত্ব লাভের খায়েশ শরীয়ার জ্হানে দখল চাইতে পারে। মানুষকে প্রলুব্ধ করার জন্যে শয়তানের বহু রাস্তা আছে। অতএব আমাদের চিন্তা, উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আত্মপ্রতারণার ফাঁদে পড়ে আমরা স্বচ্ছ চিন্তাকে যেন আচ্ছন্ন করে না ফেলি। আমাদেরকে সবর্দা কুরআনের এই আয়াত স্মরণ করা উচিত: “কেউ আল্লাহ্‌কে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করলে সে পথে পরিচালিত হবে।”(৩:১০১)
যেহেতু জ্হানের প্রতিটি শাখা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচিতি লাভ করে, অতএব তরুণদেরকে সৎ ও গভীর জ্হানের অধিকারী আলিম ও ফকীহদের কাঝ থেকে ধর্মীয় জ্হান হাসিলের উপদেশ দিচ্ছি। তাদের দেয়া ব্যাখ্যা ছাড়া সুন্নাহর ধর্মীয় জ্হানের প্রধান উৎস-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে অশ্রদ্ধা করা মূর্খতা ও ঔদ্ধত্য কুরআন-হাদীসে পারদর্শী হতে চান তাদের ইসলামী শিক্ষার ওপর নির্ভর করা যঅয় না। একইভাবে যারা উলামা ও ফুকাহার সিদ্ধান্তকে প্রধান অবলম্বন বানায়, কুরআন ও হাদীসকে উপেক্ষা করে, তাদের জ্হানের অবস্থাও হৃদয়বিদারক!
আবার অনেক আলিম আছেন যারা সরাসরি কুরআন হাদীসে অধ্যয়ন করেননি, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস, দর্শন ও পূঁজিবাদ সম্পর্কে বিশেজ্ঞ। কিন্তু এরা অন্যকে শলিয়াহ শিক্ষা দেয়া অথবা ফতোয়া দেয়ার যোগ্য নন, কারণ তারা তাদের ভাষণে-বিবরণে প্রয়শ সত্যের সাথে পুরান, বিশুদ্ধকে শুদ্ধ, সারকে তারা নিজেরাও বোঝান না। এছাড়া যার আমল নেই তার শিক্ষা বা নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার নেই। সততা, সাধুতা ও আল্লাহ্‌র ভীতি হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানের ফল। কুরআনুল কারীম বলছে, “আল্লাহ্‌র বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাকে ভয় করে।” (৩৫:২৮)
এরূপ সাধুতা ও আল্লাহ্‌র ভয় একজন আলিমকে মূর্খতাসুলভ কাজ এবং শাসক অথবা সরকারের সেবাদাস হওয়া থেকে বিরত রাখে।
বিজ্হানের তৃতীয় বৈশিষ।ট্য হচ্চে ভারসাম্য। এটা ইসলামেরই অনুপম বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যনকভাবে দু’টি প্রান্তিক প্রবণতা আমাদের রয়েছে: চরমপন্থা, শিরক, অবহেলা, গোঁড়ামি কিংবা বিচ্ছিন্নতা। আল-হাসান আল-বসরী (র) সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, “চরমপন্থী উদাসীনদেন কার্যকলাপের দরুন দমৃ হারিয়ে যাবে।” প্রথম পক্ষ মাযহাব মানকবে কিন্তু ইজতিহাদের দরজা রুদ্ধ করে দেবে। দ্বীতিয় পক্ষ মাযহাব অস্বীকার করে তার সকল নীতি খন্ডনে প্রয়াসী হবে। এছাড়া আরেক দল কুরআন-হাদীসের আক্ষরিক অর্থ মেনে চলতে চায়। যা হোক দুই চরমের মাঝে আসল ইসলাম হারিয়ে যায়। অতএব আমাদের দরকান আরসাম্যময় সাধু ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ফকীহ যারা সুচিন্তিতভাবে যুগের চাহিদাকে সামনে রেখে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রায় দেবেন যা সাধারণ মানুষের জন্যে কল্যাণকর হবে। ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরী বলেন, “সুস্পষ্ট যুক্তির ভিত্তিতে কোনো কিছুকে বৈধ করা জ্ঞানের পরিচায়ক, আর গোঁড়ামি তো যে কেউ নিষদ্ধ ঘোষণা করতে পারে।”
মুসলিম তরুণদেরকে গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি পরিহার করতে হবে। একজন মুসলিম ঈমানে-আমলে সতর্ক হবে; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ধর্মীয় সহজ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে ধর্মকে স্রেফ একটি কঠোর সতর্কবাণীতে পরিণতকরবে। কুরআন, সুন্নাহ, রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন; কেননা বাড়াবাড়ি আমলের বিষয়গুলোকে ঈমানদারদের জন্যে কষ্ঠকর করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সিয়াম, পাকসাফ, বিবাহ ও কিয়াস সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো লক্ষণীয়: “আর্লাহ্‌ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কঠিন তা চান না।” (২:১৮৫)
“আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে কষ্ঠ দিতে চান না।” (৫:৬)
“আল্লাহ্‌ তোমাদের ভয়ের লঘু করতে চান, মানুষ সুষ্টগতভাবেই দুর্বল।” (৪:২৮) “হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে। মুক্ত ব্যক্তির বদলে মুক্ত ব্যক্তি, ক্রীতদাসের পরিবর্তে ক্রীতদাস ও নারীর পরিবর্তে নারী। কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কীছুটা ক্ষমা করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার প্রাপ্য আদায় বিধেয়। এটা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ভার লাঘব ও অনুগ্রহ।”(২:১৭৮)
রাসূলের সুন্নায়ও নমনীয়তা ও ভারসাম্যের পক্ষে ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে: “ধর্মে বাড়াবাড়ি থেকে সাবধান। তোমাদের পূর্বের (জনগোষ্ঠী) বাড়াবাড়ির জন্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। ” (আহমদ, নাসাঈ,ইবনে মাজা) তারা ধ্বংস হয়েছ যারা চুল ছেঁড়াছেঁড়িতে লিপ্ত এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এ হাদীসটি তিনবার উচ্চারণ করেন। (মুসলিম)
এছাড়া আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, “একবার এক বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করেছিল। লোকজন তাকে মারতে গেল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে আদেশ দিলেন, “তাকে ছেড় দাও (প্রস্রাবের জায়গায়) এক বালতি অথবা এক গামলা পানি ঢেলে দাও। তোমাদেরকে সব কিছু সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠিন করার জন্য নয়।” (বুখারী)
এটা সত্য যে, রাসুলূল্লাহ (সা) সব সময় দ’টির মধ্যে সহকটিকে বেছে নিতেন যদি তা পাপ না হয়। যকন জানতে পারেন যে, মুয়াজ (রা) নামায গীর্ঘায়িত করেন, তখন তিনি মুয়াজ (রা) -কে বলেন, “হে মুয়াজক! তুমি কি মানুষকে পরীক্ষা করছ?” (বখারী)
রাসূলুল্লাহ (সা) একথা তিনবার বললেন, “কেউ যদি কঠোরতার মাধ্যমে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহী হয় তবে সে করতে পারে, কিন্তু অন্যকে বাধ্য করতে পারে না। এটা করতে গিয়ে সে অবচেতনভাবে অন্যকে ধর্ম থেকে সরিয়েও দিতে পারে।” রাসূলুল্লাহ (সা) - এর ওপরেই জোর দিয়েছেন। এজন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) একাকী নামায দীর্ঘয়িত করতেন, কিন্তু ইমামাতির সময় সংক্ষিপ্ত করতেন। এ সংক্রান্ত একটি হাদীস ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মুসলিম (র) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইমামতির সময় কুরআনের চোট ছোট আয়াত পড়তেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সহিষ্ণুতার নির্দশন হিসেবে একাদিক্রমে রোযা রাখার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু লোকেরা তাঁকে বলল, “আপনি এরূপ করেন”। তিনি বলেন, “আমি তোমাদের মতো নই, আমার ঘুমের মধ্যে আমার প্রভু আমাকে কাদ্য ও পানীয় দান করেন।” ধর্মীয় বিষয়গুলো সহজরূপে তুলে ধরা এখন আগের চেয়েও বেশি প্রয়োজন। আমরা যে যুগে বাস করছি, সে যুগটি পাপপূর্ণ বস্তুবাদে নিমজ্জিত। এর মধ্যে ধর্মপালন দুঃসাধ্য বটে। এজন্যেই ফুকাহা কঠোরতার পরিবর্তে নমনীয়তার সুপারিশ করেছেন। দাওয়াতী কাজে কি পদ্ধতি আবলম্বন করা দরকার তা আগেই উল্লেখ করেছি। কুরআন বলছে: “তুমি মানুষকে তোমার প্রভুর পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সদ্ভাবে।” (১৬:১২৫)
স্পষ্টত উক্ত আয়াতে শুধু মধুর কথা নয় সদয় অভিব্যক্তি কথাও বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যে প্রথমে মতানৌক্যে নয়, মতৈনক্যের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করতে হবে। আলকুরআন বলছে: “তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়োনা, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যেসীমাংঘনকারী এবং বলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী। (২৯:৪৬)
কোনো মতানৈক্যের বিষয় থেকে গেলে তা আল্লাহ্‌ স্বয়ং বিচার করবেন, “যদি তারা তোমার সাথে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয় তবে বলো: “তোমরা যা কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবহিত। তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ কিয়ামতের দিনে আল্লাহ্‌ পাক সে বিষয়ে তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।” (২২:৬৮-৬৯)
এই যদি অমুসলমানদের সাথে আচরণের পদ্ধতি হয় তাহলে মুসলমানদের সাথে মুসলমানদের কথাবার্তা কি রকম হওয়া উচিত। আমরা তো অনেক সময় আচার-আচরণে ‘আন্তরিক’ ও কর্কশে’র তফাতও ভুলে যাই। প্রকৃত দাইয়াকে মধুর ভাষণ ও সদয় অভিব্যক্তি দিয়ে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এমন প্রমাণ আছে যে, কর্কশ আচরণের ফলে আসল বিষয় বিকৃত বা বিলীন হয়ে গেছে। এগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। এজন্যেই বলা হয়েছে: “যে ভঅল পথের আদেশ করে সে যেন তা ঠিক পথে করে।’
ইমাম গাজ্জালী(র) তাঁর ‘আমরু বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং নিষেধ করে খারাপ কাজ থেকে তার ধৈর্য, সহানুভূতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকতে হবে।‘ প্রসঙ্গত তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। একবার এক ব্যক্তি খলীফা আল-মামুনের দরবারে এসে কর্কশ ভাষায় পাপ পূর্ণ্য বিষয়ক পরামর্শ দান শুরু করল। ফিকাহ সম্পর্কে আল-মামুনের ভাল জ্ঞান ছিল। তিনি লোকটিকে বললেন, “ভদ্রভাবে কথা বলো। স্মরণ করো আল্লাহ্‌ তোমার চেয়েও ভাল লোককে আমার চেয়েও একজন খারাপ শাসকের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তাকে নম্রভাবে কথা বলার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি মূসা (আ) ও হারুন (আ)-কে যারা তোমার ভাল ফিরাউনের- যে আমার চেয়েও খারাপ ছিল-কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন: ‘তোমরা দু’জন ফিরাউনের কাছে যাও, সে সকল সীমালংঘন করেছে, কিন্তু তার সাথে নম্রভাবে কথা বলো। হয়তোবা সে হুঁশিয়ারির প্রতি কর্ণপাত করবে অথবা (আল্লাহ্‌কে) ভয় করবে।” (২০:৪৩-৪৪)
এভাবে মামুন তর্কে জয়ী হলেন। আল্লাহ্‌ পাক মূসা (আ)-কে ভদ্র ভাষায় ফিরাউনের কাছ দাওয়াত পেশ করার শিক্ষা দিয়েছন।
মূসা (আ) ও ফিরাউনের মধ্যেকার সংলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ফিরাউনের ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সত্ত্বেও মূসা (আ) অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দাওয়াত পেশ করৈছেন। সূরা আশশূরায় এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন ও সুন্নহ অধ্যয়ন করলেও দেখা, মায়া, নম্রতা-সেখানে কর্কশতা ও কঠোরতার কোনো অবকাশ নেই। তাই কুরআন বলছে: “এখন তোমাদের মধ্য বেদনাদায়ক এবং তিনি তোমাদের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাশীল।” (৯:১২৮)
সাহাবীদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কুরআন বলছে : “আল্লাহ্‌র দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছে, তুমি যদি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতে তাহলে তারা আশপাশ থেকে সরে যেতো।” (৩: ১৫৯)
একদিন একদল ইহুদী এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সম্ভাষণ জানাল, “আস সামু আলাইকুম” যার আক্ষরিক অর্থ ‘আপনার মৃত্যু হোক’। হযরত আয়েশা (রা) ক্রুদ্ধ হয়ে জবাব দিলেন, “আলাইকুমুস সামু ওয়া আলানাহ” অথাৎ “তোমাদেরও মৃত্যু হোক, অভিশপ্ত হও তোমরা।” কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) কেবর বললেন, ওয়া আলাইকুম (তোমাদের ওপরেও)” তারপর আয়েশা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, “যে সকল বিষয়ে দয়া করুণা করে আল্লাহ্‌ তাকে ভালবাসেন।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত) তিনি আরো বললেন, দয়া সব কিছু সুন্দর করে। হিংসা সেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ করে।” (মুসলিম)
জুবায়ের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন: “যে কোমলতা থেকে বঞ্চিত সে সকল ভাল থেকে বঞ্চিত।” (মুসলিম) সকল ভাল থেকে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী থাকতে পারে! আশা করা যায়, উপরের উদ্ধৃতিগুলো আমাদের বাড়াবাড়ি পরিহার করে প্রজ্ঞার পথে চালিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। আমি আরো কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই:
ক. মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য অবশ্যই পালন করতে হবে। মাতাপিতা, ভাইবোন, কারো সাথেই এই অজুহাতে কর্কশ ব্যবহার করা যাবে না যে, তারা ধর্মের সীমালংঘনকরছে। তারা যদি এরূপ করেও তবুও তাদের সম্মান-স্নেহ পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে: “তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমাদর কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেন না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে এবং যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর।” (৩১ “ ১৫)
অনুরূপভাবে পিতা ইবরাহীম (আ)-এর আচরণ থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কুরআনে এর বর্ণনা আছে। পিতাকে সত্য পথে আনার জন্য তিনি পিতার রূঢ়তা সত্ত্বেও তাকে কোমলতার সাথে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাহলে মুসলমান পিতামাতাদের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে?
খ. সকল মানুষ এক, ইসলাম এই শিক্ষা দেয়। কিন্তু এ সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকা উচিত নয়। মানুষে মানুলে অনেক ফার্থক্য আছে। তার মধ্যে বয়স একটি। এজন্যে শিষ্টতা ও সম্মানের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, শাসকের অধিকারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যবক সম্মান করবে বৃদ্ধকে, ইসলাম এই শিক্ষা দেয়। এ সম্পর্কে অনেক হাদীস আছে। যেমন: “বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতি সম্মান আল্লাহ্‌র গৌরব।” (আবু দাউদ)
এবং “যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ, বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান ও জ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আমার (উম্মতভুক্ত) নয়।” (আহমদ, তাবরানী, হাকিম)
গ. যারা দাওয়াতী কাজে অভিজ্ঞ, এক সময় খুব সক্রিয় ছিলেন, কোনো কারণে এখন ঝিমিয়ে পড়েছেন তাদের প্রতি সদয় দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে তাদের নিন্দামুখের হওয়া উচিত নয়। এটাও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ। হাতিব ইবনে আবু বালতাহ (রা) -এর ঘটনা থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যায়। তিনি মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর সরবরাহের বিনিময়ে মক্কায় অবস্থিত তাঁর পরিবার-পরিজনকে রক্ষার অনুরোধ করে পৌত্তলিক কুরায়েশদের কাছে বার্তা পাঠান। বার্তাটি ধরা পড়লে হাতিব স্বীকার করেন। তখন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) তার বিশ্বাসঘাতকতায় এতোই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন যে, তিনি তার শিরচ্ছেদ করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অনুরোধ করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, “তুমি কিভাবে জানো, আল্লাহ্‌ সম্ভবত বদরের যুদ্ধে অংশগহণকারীদের ভাল কাজ দেখেছেন এবং তাদেরকে বলেছেন: “তোমরা যা খুশী তাই করো। কেননা আমি মাফ করে দিয়েছি তোমাদেরকে (তোমাদের অতীত-ভবিষ্যতের পাপকে)।” প্রাথমিক যুগে হাতিবের ইসলাম গ্রহণ, বদরের যুদ্ধে তার শৌর্যবীর্যের কথা স্মরণ করে রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ক্ষমা মঞ্জুর করলেন। এভাবে তিনি বদরের যোদ্ধাদের বিশেষ মর্যদা সম্পর্কেও সচেতন করে দিলেন।
ঘ. আমি মুসলিম তরুণদেরকে দিবাস্বপ্ন ও অবাস্তব ভাববাদিতা পরিহার করার উপদেশ দিচ্ছি। তাদেরকে ধূলোর ধরণীতে নেমে বড় বড় শহরের বস্তি ও গ্রামের নিপীড়ত মানুষের সাথে মিশতে হবে। এখানেই নির্ভেজাল পুণ্য, সরলতা ও পবিত্রতার উৎস নিহিত আছে। এসব মানুষ অভাবের তীক্ষ্ণ খোঁচায় দিশেহারা হয় না। এখানে সমাজ পরিবর্তন, পুনর্গঠন ও আন্দোলনের বিপুল উপাদান ছড়িয়ে আছে। এদের সাথে মেলামেশা করে তাদের অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করে এবং তাদের খারাপ দিকগুলো বর্জন ও সুকৃতির বিকাশে উদ্যেগী হতে হবে। এজন্যে সংঘবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রয়াস চাই। নিপীড়িতদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা এবং তাদেরকে সঠিক পথে এনে জিহাদের কাতারে শামিল করার প্রচেষ্টাও ইবাদাহর মধ্যে গন্য। ইসলামে দাতব্য কাজে উৎসাহ দেয়া হয়, এটি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
আবু হুরায়রাহ (রা) একটি হাদীসে বলেন: “মানুষের প্রতিটি সন্ধির জন্যে সাদাকাহ তার কাছ থেএক প্রাপ্য, প্রতিদিন যখন সূর্য ওঠে। দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেয়াও সাদাকাহ, পশুর পিঠে চড়তে কাউকে সাহায্য করা অথবা মাল তুলে দেয়াও সাদাকহর অন্তর্ভুক্ত এবং একটি মধুর বচনও সাদাকাহ এবং কল্যণের দিকে প্রতিটি পদক্ষেপ একটি সাদাকাহ, পথ থেকে ক্ষতিকর জিনিস সরানোও সাদাকহ।” (সকল প্রামান্য সূত্রে সমর্থিত)
ইবনে আব্বাস (রা) আরেকটি হাদীসে বলেন, “প্রতিদিন একিট মানুষের প্রতিটি সন্ধির জন্যে তার কাছ থেকে প্রাপ্য।” শ্রোতাদের একজন বলল, “এটা আমাদের জন্যে কুবই কঠিন।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাদের বাল কাজের আদেশ, কারাপ ও অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বারণ একটি সালাহ, দরিদ্রের জন্যে সাহায্য একটি সালাহ, রাস্তা থেকে ময়লা সরানোরও একটি সালাহ ও সালাহর পথে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ একটি সালাহ।” (ইবনে খুজায়মা)
বুরায়দা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “মানুষের ৩৬০ টি অস্থি-সন্ধি আছে। তাকে অবশ্যই প্রতিটির জন্যে সাদাকাহ দিতে হবে।” তারা (সাহাবীরা) বললেন, “হে নবী, এটা কার পক্ষে সম্ভব?” তারা মনে করেছিলেন যে, এটা অর্থনৈতিক সাদাকাহ। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বললেন, “মসজিদে শ্ফেম্মার ওপরে কেউ যদি মাটি চাপা দেয় তাও সাদাকাহ, পথ থেকে বাধা সরানোও সাদাকাহ।” (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে খুজায়মা, ইবনে হাব্বান)
এ রকম তথ্য আরো বহু হাদীসে আছে। অন্ধ, বোবা, দুর্বলের ও দুস্থের প্রতি দয়া প্রদর্শনের উপদেশ রয়েছে এবং এসব কাজকে সাদাকাহ ও ইবদাহ বলে গণ্য করা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুসলমান সর্বদা পুণ্য কাজের উৎস হিসেবে বিরাজমান। এভাবে অন্যেরও উপকার করছে, নিচের মধ্যেও সদগুণের বিকাশ ঘটাচ্ছে, সেই সাথে অসৎবৃত্তি অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থেকে নিরাপদ থাকছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “সেই ব্যক্তি রহমতপ্রাপ্ত যাকে আল্লাহ্ সৎকর্মের চাবি এবং অসৎকর্মের তালা বানিয়েছেন।” (ইবনে মাজা)
অবশ্য অনেক ভাববাদী মনে করতে পারেন এতে দাওয়াতী কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি মনে করি সামাজিক সম্পর্কটাই একটা বাস্তব দাওয়াহ। এই দাওয়াহ মানুষ আপন পরিবেশে পেয়ে থাকে । ইসলাম কেবল বুলি নয়। দাওয়াহ অর্থ মানুষের সমস্যার সাথে একাত্ম হওয়া, এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। ইমাম হাসান আল বান্নাহ (র) এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বলে ইসলামী আন্দোলনের সমাজ সেবা বিভাগ খুলেছিলেন সর্বত্র। তিনি মনে করতেন মুসলমানকে যেমন সালাতের শাধ্যমে ইবদতের তগিদ দেয়া হয়েছে তেমনি তাগিদ রয়েছে দাতব্য কাজেরও। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে: “হে বিশ্ববাসিগণ, তোমরা রুকু কর, সিজদা কর এবং তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকাজ কর যাতে সফলকাম হতে পার এবং জিহাদ কর আল্লাহ্‌র পথে যেভাবে করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি।” (২২ : ৭৭-৭৮)
উপরিউক্ত আয়াত মুসলিম জীবনের ত্রিমুখী ভূমিকার সংজ্ঞা দিয়েছে। আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক হচ্ছে ইবাদতের মাধ্যমে তার সেবা; সামাজিক ভূমিকা হচ্ছে দাতব্য কাজের মাধ্যমে সমাজের সেবা; বাতিল শক্তির সাথে সম্পর্ক হচ্ছে তার বিরুদ্ধে জিহাদ চালানো। এরপরেও হয়তো ভাববাধীরা আগে ভাগে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার কথাই বলবে এই যুক্তিতে যে, এটা হয়ে গেলে তো সব সমস্যারই সমাধান অটোমেটিক হয়ে যাচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো সমগ্র উম্মাহর দায়িত্ব। এজন্যে তো সময় ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। এই প্রিয়তম উদ্দেশ্য অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত তো আমাদেরকে সমাজের সেবা ও উন্নতির চেষ্টাও করতে হবে । এই তৎপরতা একাদারে ভবিষ্যত বংশধরদের গঠন, প্রস্তুতি ও উম্মাকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতারও পরীক্ষা। এটা হচ্ছে এই রকম যে, একজনের এক্ষুণি চিকিৎসা দরকার, কিন্তু একজন ইসলামী ডাক্তার ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলামী হাসপাতাল ছাড়া রোগীর চিকিৎসা করতে নারাজ। অতএব ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম না হওয়া পর্যন্ত সমাজ বা মানবতার সেবা কিংবা কোনো বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা স্থাগিত রাখার যুক্তি হাস্যকর।
কাঙ্খিত ইসলামী রাষ্ট্রর রূপ সম্পর্কে আমার ধারণা: একটি জলপাই ও খেজুর গাছের বাগান ফল উৎপাদনমুখী কাজের চেষ্টা না করে জলপাই ও খেজুর ফলনের আশায় বসে থাকবে, এটা কি যুক্তিসঙ্গত? তাকে জীবিকার্জনের জন্যে অন্য কাজও করতে হবে, সেই সাথে কাঙ্খিত ফলের জন্যে জলপাই ও খেজুর গাছেরও যত্ন নিতে হবে।
ঙ. তরুণদের প্রতি আমার সর্বশেষ পিতৃস্নেহসুলভ উপদেশ হচ্ছে: হতাশার শৃংখল থেকে নিজেদের মুক্ত করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে নির্মল ও সচ্চরিতের নমুনা হোন। অবশ্য এই আশাবাদের জন্যে আরো কয়েকটি বষয়ে সচেতন র্দৃষ্টি দিতে হবে: প্রথম : মানুষ ফেরেশতা নয়। পিতা আদম (আ) -এর মতো তারাও ভুল করতে পারে। আল-কুরআন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, “আমি তো আগেই আদমের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, আমি তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাইনি।” (২০ : ১১৫)
মানুষের ভ্রান্তি প্রবণতা ও প্রবৃত্তির প্রতি প্রলোভন স্বীকার করে নিলে আমরা অন্যের ভুলত্রুটির প্রতি সহনীয় ও সহৃদয় মনোভাব পোষণের পাশাপাশি তাদেরকে আল্লাহ্‌র ক্ষমারও আশা করতে পারব। আল্লাহ্ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা) - কে উদ্দেশ্য করে বলছেন: “বল, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ্ সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৩৯ : ৫৩)
উক্ত আয়াতে ‘আমার’ বান্দা বলার মাধ্যমে বান্দাদের জন্যে আল্লাহ্‌র উদ্বেগ ও দয়ার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় : এটা বোঝা আবশ্যক যে, মানুষের মনের গহীনে কী আছে তা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ আর জানেন না। অতএব তার বক্তব্যের আলোকে তাকে বিচার করতে হবে। তাই কেউ যদি কালিমা পাঠ করে তাহলে তাকে মুসলমান হিসেবেই গণ্য করা উচিত। এটাও রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাহ। তিনি বলেন “আমি আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি (আল্লাহ্‌র দ্বারা ) সেই সব লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যতোক্ষণ না তারা স্বীকার করবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহ্‌র রাসূল এবং সুচারুরূপে নামায পড়াবে, যাকাত দেবে। তারা সকলে যদি এরুপ করে তারা আমার কাচ থেকে (ইসলামী আইন প্রদত্ত শাস্তির বিধান ব্যতীত) জীবন ও সমাজ রক্ষাকরে এবং আল্লাহ্ তাদের হিসাব নেবেন।”
এ কারণেই তিনি মুনাফিকুনকে শাস্তি দেননি অথচ তিনি নিশ্চত ছিলেন যে, তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত করছে। তাদেরকে হত্যা করার পরামর্শ এলে তিনি বলেন: “আমি ভয় করি লোকে বলবে যে, মুহাম্মদ (সা) তাঁর সাহাবীদের হত্যা করে।”
তৃতীয়: আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর বিশ্বাস করে, সে যতো খারাপ করুক একেবারেই জন্মগতভাবে ভালোশূন্য হতে পারে না। বড় ধরনের পাপ করলে সে একেবারে ঈমানশূন্য হয়ে যায় না যতোক্ষণ না সে ইচ্ছাকৃত আল্লাহ্ কে অস্বীকার করে ও তাঁর আদেশ অবজ্ঞা করে। রাসূলুল্লাহ (সা) পাপাচারীকে চিকিৎসার দৃষ্টিতে দেখতেন যমন রোগীকে দেখা হয়। পুলিশের মতো তিনি অপরাধীকে দেখতেন না। ইনশাআল্লাহ নিচের ঘটনা থেকে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে :
একজন কোরায়শী যুবক একদিন রাসূল্লাহ (সা)- এর কাছে এসে ব্যভিচারের অনুমতি চাইল। সাহাবীরা ক্রদ্ধ হয়ে তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) -এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। শান্ত সমাহিত চিত্তে তিনি যুবকটিকে তার আরো কাছে আসতে বললেন। তারপর বললেন, “তুমি কি তোমার মায়ের জন্যে এটা (ব্যভিচার) মেনে নেবে?” যুবকটি জবাব দিল, “না।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “(অন্য) লোকেরাও এটা তাদের জন্যে অনুমোদন করবে না।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বারবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে তার কন্যা, বোন ও চাচীর জন্যে অনুমোদন করবে কিনা? প্রতিবারই যুবক বলল, “না।” এবং প্রতিবারই রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “(অন্য) লোকেরাও এটা তাদের জন্য অনুমোদন করবে না।” তারপর তিনি যুবকটির হাত ধরে বললেন, “আল্লাহ্ তার (তরুণের পাপ মার্জনা করুন, তার অন্তর পবিত্র করুন এবং তাকে সহিষ্ণু করুন (তার এই কামনার বিরুদ্ধে)।” (আহমদ, তাবরানী) এই সহৃদয় অনুবুতি সুস্পষ্ট সদিচ্ছা ও মানুষের জন্মগত সুমতির প্রতি আস্থার পরিচায়ক যা মানুষের খারাপ বৃত্তিগুলোকে বিদূরিত করতে সক্ষম। আর খারাপ প্রবৃত্তি ক্ষনস্থায়ী। সুতরাং তিনি ধৈর্যের ও যুক্তির সাতে তার সাথে আলাপ করে তার ভুল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। চরমপন্থীরা যুক্তি দেখাতে পারে যে, যুবকটি যেহেতু ব্যভিচার করেনি তাই তার প্রতি উদারতা দেখানো হয়েছে । তাহলে আরো একটি উদাহরণ দেখা যাক : এক মহিলা ব্যভিচারিণী গর্ববতী হয়ে রাসূলূল্লাহর (সা) - এর কাছে এসে দোষ স্বীকার করে তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে পাপমুক্ত করার জন্যে বারবার চাপ দিতে লাগলো। তাকে পাথর মারার সময় খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) তাকে অবভিশাপ দিচ্ছিলেন । তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন, “খালিদ নম্র হও। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, সে এমন অনুশোচনা করেছে যে, এমনকি একজন দোষী খাজনা আদায়কারীও যদি অনুতপ্ত হতো তবে তাকেও ক্ষমা করা হতো।” (মুসলিম ও অন্যান্য)
কেউ কেউ যুক্তি দেখাবেন মহিলাটি পাপ করেই অনুতাপ করেছে। তাহলে আরো একটি উদাহরণ দিচ্ছি: রাসূলুল্লাহ (সা)- এর জীবদ্দশায় একজন মদ্যপায়ীকে বার বার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আনা হলো এবং বার বার তাকে শাস্তি দেয়া হলো, কিন্তু সে নেশা করতেই তাকলো। একদিন যখন তাকে একই অভিযোগে আবার হাযির করে তাকে বেত্রাঘাত করা হলো তখন এক ব্যক্তি বললো, “আল্লাহ তাকে অবিশপ্ত করুন! কতোবার তাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে আনা হলো?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তাকে অভিশাপ দিও না, আল্লাহ্‌র শপথ, আমি জানি সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে ভালবাসে। রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, “তোমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য কোর না।” রাসূরুল্লাহ (সা) তাদেরকে অবিশাপ দেয়া থেকে বারণ করলেন এ কারণে যে, এতে ঐ মানুষটি এবং তার মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ও রেষারেষি সৃষ্টি করতে পারে কারণ-তার পাপ তাকে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি। উপরিউক্ত ঘটনাবলী গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারব যে, মানুষের অন্তর্নিহিত সুকৃতির প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। অতএব যেসব চরমপন্থীরা কেউ ভুল করলেই তাকে নির্বিচারে কুফর-শিরকের ফতোয়া দেয়, তা তাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি একদা বলেছিলেন : “অন্ধকারকে অভিশাপ দেয়ার পরিবর্তে রাস্তায় একটি মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করো।”
এই হচ্ছে আমার প্রিয় তরুণ মুসলমানদের প্রতি উপদেশ। আমার উদ্দেশ্য কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হযরত শুয়াইব (আ) -এর ভায়ায় : ‘আমি আমার সাধ্য মতো সংস্কার করতে চাই। আল্লাহর মদদেই কিন্তু কাজসম্পন্ন হয়; আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী। (১১ : ৮৮)
পরিভষা সঙ্কেত
১. কিসা : সমতার আইন।
২. আস-সাহীহ : ছয়টি সহীহ হাদীস সংকলনের যে কোন একটি।