সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি মানুষ সৃষ্টি করে তাদের কলমের মাধ্যমে পথনির্দেশিকা প্রদান করেন। দরুদ ও সালাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে মহান আল্লাহর বাণীগুলো যথাযথভাবে মানবমণ্ডলীর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন।সম্মানিত উপস্খিতি
সবচেয়ে ভাল কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। আর সবচেয়ে ভাল নিয়ম হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ম। আর (দ্বীনের ব্যাপারে) নতুন বিষয়গুলো (অর্থাৎ নতুন বিষয় সৃষ্টি করা) সবচেয়ে খারাপ। আর সব বিদআতই ভ্রান্তি। তোমাদের মুসলিম সমাজের দলভুক্ত হতে হবে, কেননা আল্লাহর সহায়তা এ দলেরই উপর হয়ে থাকে। আর যে তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে সে বিচ্ছিন্ন অবস্খায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” মহান আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার পরও যারা অনৈসলামী জীবন যাপন করতে চায় তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন: “যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐদিকেই ফেরাব যেদিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্ট অবস্খান।” (সূরা আন নিসা, ১১৫)সম্মানিত উপস্খিতি
মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর তাঁর উম্মী নবী প্রেরণ করে বিশেষ নিয়ামত প্রদান করেন, যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের উপর ঈমান আনেন। তিনি ইরশাদ করেন: “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর কিতাবসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।” (সূরা আল জুমআ, ২) নবীর নিরক্ষরতা কখনো তাঁর রিসালাতের ত্রুটির কারণ ঘটেনি বরং তা ছিল মহান আল্লাহরই নির্দেশনায়। এ মর্মে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন: “পাঠ করুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” (সূরা আল আলাক্ব, ১-৫)
নবী মুহাম্মাদ (স·) নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উম্মতদের সর্বদা লেখা-পড়া ও জ্ঞানার্জনের নির্দেশ প্রদান করতেন। কেননা তাঁর জ্ঞানের বাহন ‘কলমের' মহানত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মহান আল্লাহও কলমের শপথ করে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন। ইরশাদ হচ্ছে: “নূন-শপথ কলমের এবং বিষয়ের, যা তারা লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা আল কালাম, ১)
আল্লাহর পক্ষ থেকে কলমের শপথ করা কলমের গুরুত্ব ও মর্যাদারই ইঙ্গিতবহ, কেননা কলম দিয়েই অনেক গুরুত্ব বিষয়ের সূচনা করা হয়। কলম লেখার বাহন হওয়ায় ও তা মতান্তরে সৃষ্টির প্রথম হওয়ায় তার গুরুত্ব অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। মহানবী (স·) ইরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথম কলম সৃষ্টি করেন।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী)
কলমের গুরুত্ব এমন যে, তা মানুষের মনের কথা, তার বক্তৃতা ইত্যাদি সংরক্ষণ করে থাকে। কলমে লিপিবদ্ধ আইন সংরক্ষণ করা ও সে অনুপাতে দেশ পরিচালনা সহ সর্ব প্রকারের নিয়মকানুন ও বিধি-বিধান পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে কলমই হল অব্যক্ত মনের বহি:প্রকাশের মাধ্যম। কলমের লিখনের মধ্যেই সম্মান, মর্যাদাবোধ ও ব্যবসায়িক লেনদেন ও লাভ-লোকসানের প্রমাণকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। সে হিসেবে কলম ছাত্রের জন্য অতীব প্রয়োজন, এর মাধ্যমেই জ্ঞান বিজ্ঞান ও মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। কলমের লেখা না হলে কোন কোন জাতির ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হত না, ফলে সে জাতির অনেক প্রয়োজনীয় ইতিহাস থেকে বিশব বঞ্চিত হত। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তী জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি থেকে মাহরূম হত।
সম্মানিত মুসলিম মিল্লাত
আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের লিখনী ও রচনা শক্তির দিক থেকে অনেক ঊর্দ্ধে আরোহন করেন যাদের দিয়ে আমরা গর্ববোধ করে থাকি। তাঁদের মনীষী, কবি-সাহিত্যিক ও অলংকার শাস্ত্রবিদ ও দ্বীনের পথে আহ্বান কারীগণ অত্যন্ত উঁচুমানের অধিকারী ছিলেন। তাদের সুসাহিত্যিকগণ মানুষের মনের মণিকোঠায় এক মহান উল্লেখযোগ্য স্খান করেছিলেন। আর তাঁদের অতি উঁচুমানের সাহিত্যের কারণে খারাপ সাংবাদিকতা সে সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছিল। তেমনিভাবে তাঁদের সাহিত্যের কারণে সে যুগে অশ্লীল ও রুচীহীন সাহিত্য রচনার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম মিল্লাতের জন্য উন্নততর সাহিত্য রচনা, উপদেশ, ইসলামী বিধানের নীতিমালা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সম্বলিত বই-পত্র রচনা করা। তাঁদের লেখায় কোথাও আমরা অশ্লীলতা ও ধ্বংসাত্মক চিন্তা-চেতনার ইঙ্গিত পাই না। তাঁরা দূর থেকে কলমের মাধ্যমে ইসলামের যে খিদমত করে গেছেন অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রের শত্রুকে নিকটতম অবস্খানে পেয়েও তরবারীর শক্তি দিয়েও তা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে উঠে না। তাঁদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উমôাহ তথা সমগ্র বিশববাসীর জন্য সত্য উদঘাটন, তা প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা। তাদের কলমগুলো সাময়িক সময়ের জন্য ধার করে নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাঁরা সর্বদা উপরোক্ত কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখাকে তাঁদের জীবনের প্রধান ও একমাত্র মিশন বলে মনে করতেন।
আল্লাহর বান্দাগণ
কলমের সত্য উদঘাটন দ্বারা লেখকের মনের দৃঢ়তা ও মনোবল প্রকাশ পায়। এর মাধ্যমে মানবমণ্ডলীকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বান জানানোর প্রক্রিয়ায় হাজারো পথহারা মানুষের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার একটি যথার্থ ও সুন্দর পথ উন্মুক্ত হয়। অপরদিকে এ কলম দিয়েই আল্লাহর পথ থেকে মানুষের বিভ্রান্ত করাসহ নানা অপকর্ম সম্পন্ন করা যায়। তাই আপনাদের কলমের ব্যাপারে সাবধান থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ এদিকে ইঙ্গিত প্রদান করত ইরশাদ করেন: “তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অত:পর সেন্সাতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী। অত:পর সেন্সাতধারা স্ফীত ফেনারাশি উপরে নিয়ে আসে। এবং অলঙ্কার অথবা তৈজসপত্রের জন্যে যে বস্তুকে আগুনে উত্তপ্ত করে, তাতেও তেমনি ফেনারাশি থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন।” (সূরা আর রাদ, ১৭)
কলমের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমাদের মাঝে যে বিষয়টি ফুটে উঠে তা হল, এক ধরনের কলমবাজ তার মাধ্যমে মানুষদের অনৈতিকতা, বেহায়াপনা, অনৈসলামী চিন্তা-চেতনা মানব সমাজে প্রচার করে থাকে, অপরপক্ষে অন্য প্রকার কলমের মাধ্যমে সত্য-ন্যায়, দায়িত্বশীলতা, আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসা পাবার পথের ইঙ্গিতসহ আল্লাহর সমôুখে বান্দার জওয়াবদিহীতার অনুভূতি সৃষ্টিতে সহায়তা করে কামিল মুমিনের ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করত আল্লাহ ইরশাদ করেন: “হে নবী আপনি বলে দিন: অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য তোমাকে বিসôৃতি করে। অতএব, হে বুদ্ধিমানগণ, আল্লাহকে ভয় কর-যাতে তোমরা মুক্তি পাও।” (সূরা আল মায়িদা, ১০০)
মুমিনগণ
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, কলমের মত দু'ধারী তলোয়ার খুব কমই দেখা যায়। হিদায়াতপ্রাপ্ত মুমিন তা দিয়ে যেমন কল্যাণ ও ভাল কাজে আত্মনিয়োগ করত সফলতার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় তেমনি তা বিপদগামীদের বিষাক্ত সাপের মত একান্ত নিকটস্খদেরও ছোবল মারতে পরোয়া করে না। আধুনিককালে কলমের ব্যবহার এত অধিক পরিমাণে হচ্ছে যা পূর্বে কল্পনাও করা যেত না। এর ক্ষেত্রও অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাসূল (সা·)-এর একটি হাদীসও এদিকে ইঙ্গিত প্রদান করছে। তিনি ইরশাদ করেন, “কিয়ামতের পূর্বে যে জিনিসগুলো বেশি সংগঠিত হবে তন্মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এত বেশি বৃদ্ধি পাবে যে স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসায়িক কাজে সহায়তা করবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বেশি বেশি ছিন্ন করা হবে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি, সত্য সাক্ষ্য গোপন করা ও কলমের ব্যবহার অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়া।” (মুসনাদে আহমাদ)
একটি বিষয় সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যখন কোন জিনিস বা বিষয় বৃদ্ধি পায় তখন তার সমর্থক বা দাবীদারের সংখ্যাও বৃদ্ধি হতে দেখা যায়, কিন্তু তা যথাযথভাবে গ্রহণকারীদের সংখ্যা কমতে থাকে, তখন তাতে ভুল-ভ্রান্তির পরিমাণও বেশি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে কলমবাজদের মধ্য থেকে এমন কিছু আচরণ প্রকাশিত হতে দেখা যায় যা শালীনতা ও ভদন্সতার কোন সংজ্ঞায় পড়ে না। জনমানুষের অধিকার ও স্বার্থ খর্ব করতে তারা বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না। তারা মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোন কর্ম সম্পাদনেও ভ্রুক্ষেপ করে না। এসব আচরণ এক সময়ে এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছে যখন পরýপরে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি করে থাকে। তাই কলমের খারাপ ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে ইরশাদ করেন: “অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।” (সূরা আল ইনফিতার, ১৭)
মহান আল্লাহ আমাকে ও আপনাদের পবিত্র কুরআন থেকে বরকত ও উপকৃত হবার তওফিক দিন। আমার বর্ণনায় ভাল কিছু থাকলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে মনে করছি। আর ভুল করলে তা আমার নিজের পক্ষ থেকে। আমি আল্লাহর নিকট মাফ চাচ্ছি। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।
খতীব: শাইখ সাউদ ইবন ইব্রাহীম আশ-শুরাইম
ভাষান্তরে: ড· ওয়ালি উল্লাহ, সহযোগী অধ্যাপক, দাওয়া বিভাগ, দারুল ইহসান বিশববিদ্যালয়, ঢাকা