হযরত মুহাম্মদ (সা·) ৫৭০ খিন্সষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমেনা। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইনতেকাল করেন। তাঁর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ (প্রশংসিত)। মাতা আমেনা তাঁকে ‘আহমদ' (চরম প্রশংসাকারী) বলে ডাকতেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা·) নিরক্ষর ছিলেন, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহই নেই। এমন কি খিন্সষ্টান লেখক মার্গোলিয়থকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, শিক্ষা বলতে যা বুঝায় মুহাম্মদ তা আদৌ প্রাপ্ত হন নাই। ইহা নিশ্চিত যে, শৈশবে তাকে লিখতে ও পড়তে শিক্ষা দেয়া হয় নাই। আরবের গোত্রসমূহের মধ্যে প্রচলিত ‘গাঁথা' গুলি মুখস্ত করে যে শিক্ষা লাভ হয়, সে শিক্ষাও তিনি প্রাপ্ত হন নাই।
কিন্তু দু'দিন পরে বিশেবর সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডারই এই নিরক্ষর বালকের পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ে ধন্য হলো। জ্ঞানের এমন তথ্য তিনি প্রচার করলেন, এমন অজ্ঞাতপূর্ব সত্য নিয়ে জগতের সম্মুখে উপস্খাপিত করলেন, যা দেখে জগত স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হলো। যুগে যুগে জ্ঞানের গবেষণা যতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে, সেই সকল অজ্ঞাতপূর্ব ও অচিন্তিত পূর্ব তথ্যের সত্যতা ও গুরুত্ব ততই অধিক উপলব্ধি হতে থাকবে। মহানবী (সা·)-এর হৃদয়ে কোথা হতে জ্ঞানের উন্মেষ হলো, মোস্তফা চরিতামৃত সাগরের মূল উৎস কোথা হতে আসল? অনন্ত জ্ঞানের সেই মহীয়ান মহাকেন্দন্স হতে পূর্ণ জ্যোতি: বিচ্ছুরিত হয়ে মহানবীর মোবারক হৃদয়কে বিকশিত ও উদ্ভাসিত করেছিল- এক কথায় এরই নাম নবুয়্যাত।
মহানবী (সা·)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর পরই ইসলামী শিক্ষা চালু করা হয় এবং তিনি এর শিক্ষক ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা·) হিজরতের পূর্বে আবদুল্লাহ, বিন উম্মে মাকতুম এবং মুসাইব বিন উমাইরকে মদীনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন এবং তাঁর হিজরতের পর মদিনা ইসলামী শিক্ষাকেন্দেন্স পরিণত হয়েছিল। মহানবীর (সা·) মক্কা জীবনে দারুল আরকামে মুসলমানগণ একত্রিত হতেন এবং কুরআন পাঠ শিক্ষা করতেন আর মহানবী (সা·) এর শিক্ষক ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, হিজরতের পূর্বে ‘দারুল আরকাম' ইসলামী শিক্ষার কেন্দন্স ছিল। হিজরতের পর মহানবী (সা·) মদিনায় একটি মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্খাপন করেন যা আজ পর্যন্ত মসজিদে নববী হিসেবে পরিচিত। মহানবী (সা·) ও তাঁর সাহাবীগণ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এখানেই আদায় করতেন এবং এই মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদন্সাসা ছিল যার নাম ‘সুফফাহ মাদন্সাসা'। প্রসিদ্ধ সাহাবীগণ উক্ত মাদন্সাসার ছাত্র ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত আবু হুরায়রা ও হযরত আবুজর গিফারী (রা·)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। সুফফার ছাত্রগণ এই মসজিদের এক কোণায় থাকতেন এবং রাতে মহানবী (সা·) তাদের মধ্য হতে কয়েকজনকে সম্পদশালী সাহাবাদের নিকট খাদ্যের জন্য পাঠিয়ে দিতেন এবং কয়েকজনকে তিনি তাঁর নিজের আহার্যে বসাতেন। ছাত্রগণ রাত্রিতে এখানেই ঘুমাতেন এবং দিনের বেলায় তাদের নির্ধারিত শিক্ষা ধর্ম বিষয়সহ অন্যান্য বিষয় শিক্ষা দিতেন।
বদরের যুদ্ধে মহানবী (সা·) কতিপয় কুরাইশবাসীকে এই শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন যে, তাঁরা প্রত্যেকে মদিনার মুসলমানদের ১০ জন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখাবেন। পুরুষদের শিক্ষার পাশাপাশি মহানবী (সা·) নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে নারীদের নিকট বক্তৃতা প্রদান করতেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আবু দাউদ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা·)-এর স্ত্রী হযরত হাফসা (রা·) জনৈক মহিলার নিকট লিখন পদ্ধতি শিক্ষা করতেন। অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, মহানবীর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা·) ২২১০টি হাদীস মুখস্ত করেছিলেন।
শিক্ষকদের বেতন
মহানবী (সা·)-এর সময়ে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কোন বেতন ছিল না। আবু দাউদ শরীফে উবাদা বিন ছামিত থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, তিনি সুফফাহ মাদন্সাসার শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি কুরআন ও লিখন পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। তাঁর একজন ছাত্র তাঁকে একটি ধনুক উপহার দিয়েছিলেন। মহানবী (সা·) তাঁকে এটা গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। এই হাদীস থেকে অনুমান করা যায় যে, সেকালে শিক্ষাদানের জন্য বর্তমান সময়ের মত কোন পারিশন্সমিক দেয়া হতো না।
পাঠ্য তালিকা
মাওলানা আবদুস সাত্তার তারীখে মাদন্সাসা আলীয়া গ্রন্থে বলেছেন যে, মহানবী (সা·)-এর সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য তালিকায় কুরআন, হাদীস, অংক, ফারায়েজ, বংশ তালিকা এবং তাজবীদ ছিল। কেহ যদি কোন বিষয়ে দক্ষ থাকতেন তাহলে তাঁকে উক্ত বিষয় পড়ানোর জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হতো। মহানবীর (সা·) জীবনের শেষের দিকে যখন মুসলিম সামন্সাজ্যের পরিধি বেড়ে যায় তখন শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রথমত: মহানবী (সা·) শিক্ষিত সাহাবাদের মধ্য হতে কয়েকজনকে আরবের বাইরে প্রেরণ করেন। দ্বিতীয়ত: প্রত্যেক প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে তাদের নিজ এলাকার জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্খা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হত। পাঠ্য তালিকার অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, প্রাথমিক শিক্ষায় কুরআন পাঠ বাধ্যতামূলক ছিল। অত:পর শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে অন্য বিষয়ের পঠন পাঠনে অগ্রসর হতো। মহানবী (সা·) তাঁর সাহাবাদেরকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করতেন। ভাষা শিক্ষায় তাঁরা শুধু আরবীকেই প্রাধান্য দিতেন না বরং আরব দেশের বাইরের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তাঁরা অন্যান্য ভাষাও শিখতেন।
শিক্ষা হিসেবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা·) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রাথমিক ধারণার শেষ প্রান্তে এসে আমরা বলতে পারি যে, মহানবী (সা·)-এর সময়ে আধুনিককালের মত কোন শিক্ষা ব্যবস্খা ছিল না। কিন্তু তিনি নিজে উম্মী (নিরক্ষর) হয়েও শিক্ষার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন তা অনন্তকাল পর্যন্ত মানুষকে প্রেরণা দিতে থাকবে। মহানবী (সা·)-এর সময়ে কোন দ্বৈত শিক্ষা ব্যবস্খা ছিল না, শুধু এক ধরনের শিক্ষা প্রচলিত ছিল যেখানে ধর্মীয় এবং বিজ্ঞানের বিষয়সমূহ পড়ানো হতো। আমাদের নিকট এমন কোন তথ্য উপাত্ত নেই যে, মহানবী (সা·) শৈশবকাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শিখেছিলেন। তবু তিনি নিজেই নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “আল্লাহর রাসূলের ভেতর তোমাদের জন্য সুন্দর আদর্শ রয়েছে।” উল্লেখিত আয়াত আল্লাহর রাসূলের ভেতর মানব সমাজের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তেমনি আল্লাহর রাসূল (সা·) নিজের পবিত্র জবানেও এ কথার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।”
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্নমুখী ও বিচিত্রধর্মী যে অসংখ্য চলার পথ রয়েছে- আর এ চলার পথের উভয় পাশের্ব রয়েছে বহু অন্ধকার গলি, এতটুকু অসাবধান হলে যেখানে হোঁচট খেতে হয়, এমনকি চরম সর্বনাশও হতে পারে, সেই চলার পথের দিশা একমাত্র মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা·)-এর শিক্ষার ভেতর রয়েছে। একজন মানুষকে জীবনের যাত্রাপথে যতগুলি স্তরই পাড়ি দিতে হোক সকলের জন্যই মহানবী (সা·)-এর শিক্ষা রয়েছে। আর এ শিক্ষাকে অনাগতকালের মানুষের জন্য বিশেষ করে উম্মতে মুহাম্মদীর সকল সদস্যের জন্য সংরক্ষণের স্বার্থেই একদল সাহাবী নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন। মহানবী (সা·) পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহ আপনাকে পৃথিবীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন।”
মহানবী (সা·) শুধুমাত্র ইসলাম প্রচারকই ছিলেন না বরং তিনি মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল বিষয়ের পথ প্রদর্শক ছিলেন। তিনি মানবতার শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক, রাষ্টন্স প্রধান, আইন রচয়িতা, সেনা প্রধান ও গণতন্ত্রের পুরোধা ইত্যাদি গুণে গুণানিবত ছিলেন।
আমরা জানি শিক্ষা হলো কোন বিষয়ের পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও গবেষণার নাম। আবার এই শিক্ষাই হলো কোন বিষয় বা বস্তুকে গভীরভাবে অনুশীলনের প্রক্রিয়া, এরই সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের উৎকর্ষ সাধনে তাঁর প্রয়োগের প্রক্রিয়া। ইসলামের আকর যে মহামূল্যবান কুরআন তার শুরু হয়েছে এমনিভাবে। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা·) এ সম্পর্কে কী বলেছেন, সেদিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব ধর্ম হিসেবে ইসলাম জ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে কত আগ্রহী, কত উদ্যোগী। মহানবী (সা·) সপ্তম শতকের প্রারম্ভে বলেন, “জ্ঞানের অনুসন্ধানে যিনি পথে বের হলেন, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতের পথকে সহজ করে দিলেন।”
মহানবী (সা·) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি শুধু এবাদতকারী তার উপর জ্ঞানীর শেন্সষ্ঠত্ব হচ্ছে সমস্ত তারকার উপর পূর্ণ চন্দেন্সর শেন্সষ্ঠত্ব সদৃশ।” জ্ঞান অনেবষণের উপর সর্বাধিক জোর দিয়ে মহানবী (সা·) বলেন, “জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য অবশ্য করণীয় বা ফরজ।”
মোট কথা, ইসলামে রয়েছে জ্ঞানানুসন্ধানের জন্যে বিশেষ তাগিদ। এই তাগিদ শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত তা বিস্তৃত, নর-নারী সম্প্রদায় নির্বিশেষে। এই কারণে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা·) সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল সকলকে সমিôলিত করার লক্ষ্যে মসজিদ নির্মাণ এবং মসজিদকেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে বেছে নিয়ে জ্ঞান চর্চার উৎকর্ষ কেন্দে রূপান্তরিত করেন। মধ্যযুগে ইউরোপে গিল্ড তৈরী হয় নির্বাচিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে কিছু কলা-কৌশল জ্ঞান দানের জন্যে। তার বহু পূর্বেই মদিনা রাষ্টেন্স প্রতিষ্ঠিত হয় বহুসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এসব প্রতিষ্ঠানে বিনা ব্যয়ে সমাজের সর্বস্তরের ব্যক্তিবর্গ সুযোগ লাভ করতেন স্বাক্ষরতার। সুযোগ লাভ করতেন জ্ঞান চর্চার, সমস্যা পর্যালোচনার। শিক্ষক হিসেবে মহানবী (সা·) ছিলেন দয়া ও ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। ক্ষমা ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান ভূষণ। চরম শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করে দয়ার্দন্সতার মহান দৃষ্টান্ত স্খাপন করেছেন। মহান আল্লাহর বাণী: “আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হলেন। আপনি যদি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় সম্পন্ন হতেন, তবে তারা আপনার চারপাশ থেকে দূরে সরে পড়তো।” মহানবী (সা·) নিজেও মানবতার প্রতি অনুগ্রহের জন্য আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন: “জমিনবাসীর প্রতি তুমি দয়া কর, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দয়া করবেন।” মহানবী (সা·) অন্যত্র আরো বলেন: “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না।” অপর এক হাদীসে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের একটি বিপদ উদ্ধার করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের বিপদসমূহ হতে তার বিপদ উদ্ধার করে দেবেন।”
ইসলামের মহান দাওয়াত প্রচারের উদ্দেশ্যে তায়েফ গমনের পর তথাকার অধিবাসীরা মহানবীকে প্রস্তর নিক্ষেপে ভূ-লুণ্ঠিত করলো। হাদীসের ভাষ্যমতে, “হযরত জিব্রাইল (আ·) বহু ফিরিশতাসহ নাযিল হলেন তাদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু মহানবী (সা·) বললেন: “এদেরকে মেরে ফেলনা, কেননা এদের ঔরসে তো মুমিনও জন্মিতে পারে।” ওহুদ প্রান্তরে দাঁত মুবারক শহীদ হওয়ার পরও বদ দুয়া'র স্খলে বরঞ্চ বলেছিলেন: “হে আল্লাহ আমার জাতিকে ক্ষমা করুন, কারণ তারা জানেনা।” মহানবী (সা·)-এর অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষণীয় আদর্শের কারণে রাশিয়ার প্রখ্যাত দার্শনিক স্টানলি লেনপুল তাঁর “স্টাডিজ ইন মস্ক” নামক প্রবন্ধে বলেন: “মুহাম্মদ (সা·) ছিলেন নগন্য ও পতিতদের ক্ষমাশীল আশন্সয়দাতা। তিনি তাঁর ছোট চাকরকেও কখনো তিরস্কার করেননি। তিনি ছিলেন সবচাইতে মিষ্টভাষী এবং আলোচনায় ছিলেন মনোরম ও হৃদয়গ্রাহী।” একটি পরিবারে ছোট-বড় উভয়ের সমাবেশ থাকে। সে ক্ষুদন্সায়তন সমাবেশকে সুশৃংখল রাখার জন্য প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের পারýপরিক স্নেহ ও শন্সদ্ধাবোধ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক মহানবী (সা·)-এর বাণী নিম্নরূপ:
“যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” মহানবী (সা·) প্রবর্তিত রাজনৈতিক মতাদর্শ বা শিক্ষা সর্বকালের সর্বপ্রকার লোকদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি একজন অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী, অসাধারণ কূটনীতিবিদ, দক্ষ সমরনায়ক এবং সফল সংগঠক হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সকল প্রকার জুলুম, নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়ন ও পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে, ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্খা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মহানবী (সা·)-এর রাজনৈতিক দর্শন।
মানবতার শিক্ষক মহানবী (সা·)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার বাস্তব উদাহরণ মদিনা সনদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ। মদিনা সনদের ফলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে মদিনার ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিকসহ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে পারýপরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্টেন্সর সূচনা করেন। পরবর্তীতে যা মদিনা ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মানবতার মহান শিক্ষক মহানবী (সা·) সংখ্যালঘু অমুসলিমদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে সমাজে শান্তি ও মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন কায়েম করেছিলেন। পাশ্চাত্য সমাজ বিজ্ঞানী বলেন বিশ্বের সকল ধর্মের মধ্যে কেবলমাত্র মুহাম্মদ (সা·)-এর আদর্শই সকল প্রকার বর্ণ বৈষম্য থেকে মুক্ত। এখানে ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মুসলিমকে পরিপূর্ণ সামাজিক সমতার ভিত্তিতে তার ভ্রাতৃত্ব সংঘে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। ইসলামকে মানব ইতিহাসের সর্বশেন্সষ্ঠ বিপ্লবরূপে অমুসলিমরাও স্বীকৃতি প্রদান করেছে। মহানবী (সা·)-এর শিক্ষা ও আদর্শকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা যদি সমকালীন সমস্যাসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলোকে মৌলিক হিসেবে চিহ্নিত করি যেমন- রাজনৈতিক দ্বন্দব, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্খানের অভাব, মিথ্যা অপ-প্রচার, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হীন মনোবৃত্তি, সভ্যতার অন্তরালে পৈশাচিকতার নগ্ন থাবা, কথা ও কাজের গরমিল, তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশন্সয়, অন্যের অস্তিত্ব অস্বীকার, সন্ত্রাসীদের প্রশন্সয়দান, অপেক্ষাকৃত সৎদের নির্যাতন, দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমন, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব, গণতন্ত্রের অপপ্রয়োগ, প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদানের অনীহা, বর্ণ বৈষম্য ও শেন্সণী সংঘাত, অন্যের অধিকারে নগ্ন হস্তক্ষেপ, নিরপেক্ষ বিচারের অভাব, দুর্বল দেশ ও জাতির উপর সামন্সাজ্যবাদের অশুভ থাবা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ এবং বিশব বেহায়াপনার লালন।
তাহলে উপরিউক্ত সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, মানবতার শিক্ষক মহানবী (সা·) ছিলেন সর্বকালের শেন্সষ্ঠ আদর্শ। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত যে জীবনাদর্শ রেখে গেছেন তা বর্তমান সমস্যা জর্জরিত বিশেবর সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান। এ ঘোষণা শুধু মুসলমানদেরই নয়। বিশেবর অমুসলিম মনীষীদের পারিবারিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্টন্সীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের বিভিন্ন শাখায় রাসূল (সা·) যে আদর্শ রেখে গেছেন তা চির অম্লান। তিনি কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি থেকে সমাজ ও জাতিকে মুক্ত করেছিলেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেন। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সুদ, ঘুষ, অবৈধ ব্যবসা, কালোবাজারি ও মজুতদারী প্রথার বিলোপ সাধন করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্খা। একইভাবে মহানবী (সা·)-এর রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা বর্তমান বিশেবর রাজনৈতিক অস্খিরতাকে করতে পারে দূরীভূত। রাষ্টন্স পরিচালনা, আইন প্রণয়ন ও অন্যান্য ব্যবস্খায় তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন তা নিখুঁতভাবে সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের সামাজিক বিশৃংখলার এ দিনে, রাজনৈতিক অস্খিরতার এ ক্ষণে এবং অর্থনৈতিক পরাধীনতার এ যুগে সকল সমস্যার সমাধান হবেই। তাই আমরা আহ্বান জানাই আসুন, সমস্যা বিজড়িত বিশেব ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তি আনয়নে মানবতার শিক্ষক হিসেবে মহানবী (সা·)-এর আদর্শ অনুসরণ ও সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করে সফলতা অর্জ করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তৌফিক দিন। আমীন। (সা·)
ড· মো: আবদুল করিম