নবী (সাঃ)- ০৬।

বনু কুরায়জার ধ্বংস
ইতঃপূর্বে বিবৃত হয়েছে যে, হযরত (স) মদীনায় আসার পর ইহুদীদের বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। প্রথম দিকে কিছুদিন ইহুদীরা সে সব চুক্তির ওপর অটল থাকলেও অত্যল্প দিনের মধ্যেই তারা বেপরোয়া ভাবে চুক্তি ভঙ্গ করতে লাগলো। এর ফলে তাদের বনু নযীর গোত্রকে মদীনার থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছিলো; কিন্তু বনু কুরায়জা আবার চুক্তি সম্পাদন করেলো এবং হযরত (স) তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে আপন কিল্লায় থাকার অনুমতি দিলেন।
কিন্তু খন্দক যুদ্ধের সময় ইহুদী গোত্রসমূহ বনু কুরায়জাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিলো এবং তারাও এ যুদ্ধে শত্রু পক্ষে যোগদান করলো। তারা হযরত (স)-এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কোনোই মর্যাদা রাখলো না। তাই খন্দকের ঘনঘটা কেটে যাবার পরই হযরত (স) সর্বপ্রথম বনু কুরায়জার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং তাদেরকে এ বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে যথোচিত শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের অপরাধ ছিলো বনু নযীরের অপরাধের চেয়েও মারাত্নক। কেননা তারা এরূপ এক সংকটাবস্থায় বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যখন গোটা আরব জনগোষ্ঠী মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং দৃশ্যত তাদের টিকে থাকবার আর কোনো উপায় ছিলো না। তারা মুসলমানদের সাথে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে চুক্তি নির্মমভাবে লংঘন করে তারা মুসলমানদের নাস্তানাবুদ করার উদ্দেশ্যে শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলালো। এভাবে নিজেদের আচরণ দ্বারাই বনু কুরাইয়জা এটা প্রমাণ করে দিয়েছিলো যে, তারা মুসলমানদেতর পক্ষে প্রকাশ্য শত্রুর চেয়েও বেশি মারাত্নক ।
তাই যুদ্ধের পর হযরত (স) তাদের কিল্লা অবরোধ করলেন। অবরোধ প্রায় এক মাসকাল অব্যাহত থাকলো। অবশেষেষ বাধ্য হয়ে তারা আত্নসমর্পণ করলো। অতঃপর তাদের ধর্মগ্রন্থ তওরাতের বিধি মুতাবেক এই মর্মে ফয়সালা করা হলো যে, তাদের সমস্ত যুদ্ধোপযোগী লোককে হত্যা করা হবে এবং বাকী লোকদের বন্দী করে রাখা হবে। এছাড়া তাদের সমস্ত মালপত্র বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই ফয়সালা অনুসারে প্রায় চারশ লোককে হত্যা করা হলো। এর মধ্যে একজন মহিলাও ছিলো। তার অপরাধ ছিলো এই যে, সে কিল্লার প্রাচীরের ওপর থেকে পাথর ফেলে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিলো।
হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি
কা’বা ছিলো ইসলামের মূল কেন্দ্র। এটি আল্লাহর নির্দেমানুক্রমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) নির্মাণ করেছিলেন। মুসলমানরা ইসলামের এই কেন্দ্রস্থল থেকে বেরোবার পর ছয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছিলো। পরন্ত হ্‌জ্জ ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তারা এটি পালন করতে পারছিলো না। তাই কা’বা শরীফ জিয়ারত ও হজ্জ উদযাপন করার জন্যে মুসলমানদের মনে তীব্র বাসনা জাগলো।
কা’বা জিয়ারতের জন্যে সফর
আরবরা সাধারণত তামাম বছরব্যাপী যুদ্ধে মেতে থাকতো। কিন্তু হজ্জ উপলক্ষে লোকেরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে কা’বা পর্যন্ত যাতায়াত করতে এবং নিশ্চিন্তে আল্লাহর ঘরের জিয়ারত সম্পন্ন করতে পারে, এজন্যে চার মাসকাল তারা যুদ্ধ বন্ধ রাখতো। ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে হযরত (স) কা’বা জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নিলেন। এহেন সৌভাগ্য লাভের জন্যে বহু আনসার ও মুহাজির প্রতীক্ষা করছিলো। তাই চৌদ্দ শ’ মুসলমান হযরত (স)-এর সহগামী হলেন। যুল হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা কুরবানীর প্রাথমিক রীতিসমূহ পালন করলেন। এভাবে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, মুসলমানদের উদ্দেশ্য শুধু কা’বা শরীফ জিয়ারত করা, কোনোরূপ যুদ্ধ বা আক্রমণের অভিসন্ধি নেই। তবুও কুরাইশদের অভিপ্রায় জেনে আসবার জন্যে হযরত (স) এক ব্যক্তিকে মক্কায় প্রেরণ করলেন। সে এই মর্মে খবর নিয়ে এলো যে, কুরাইশরা সমস্ত গোত্রকে একত্রিত করে মুহাম্মদ (স)-এর মক্কায় প্রবেশকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন কি, তারা মক্কার বাইরে এক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করতেও শুরু করেছে এবং মুকাবিলার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে।
কুরাইশদের সঙ্গে আলোচনা
এই সংবাদ জানার পরও হযরত (স) সামনে অগ্রসর হলেন এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করলেন। এ জায়গাটি মক্কা থেকে এক মঞ্জিল দূরে অবস্থিত।৪৫ এখানকার খোজায়া গোত্রের প্রধান হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হয়ে বললো : ‘কুরাইশরা লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।’ হযরত (স) বললেন : ‘তাদেরকে গিয়ে বলো যে, আমরা শুধু হজ্জের নিয়্যাতে এসেছি, লড়াই করার জন্য নয়। কাজেই আমাদেরকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার সুযোগ দেয়া উচিত।’ কুরাইশদের কাছে যখন এই পয়গাম গিয়ে পৌঁছলো, তখন কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলে উঠলো : ‘মুহাম্মদের পয়গাম শোনার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।’ কিন্তু চিন্তাশীল লোকদের ভেতর থেকে ওরওয়া নামক এক ব্যক্তি বললো : ‘না, তোমরা আমার উপর নির্ভর করো; আমি গিয়ে মুহাম্মদ (স)-এর সঙ্গে কথা বলছি।’
ওরওয়া হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হলো বটে, কিন্তু কোনো বিষয়েই মীমাংসা হলো না। ইতোমধ্যে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্যে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলো এবং তারা মুসলমানদের হাতে বন্দীও হলো; কিন্তু হযরত (স) তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। এর পর সন্ধির আলোচনা চালানোর জন্যে হযরত উসমান (রা) মক্কায় চলে গেলেন; কিন্তু কুরাইশরা মুসলমানদেরকে কা’বা জিয়ারত করার সুযোগ দিতে কিছুতেই রাযী হলো না; বরঞ্চ তারা হযরত উসমান (রা)-কে আটক করে রাখলো।
রিযওয়ানের শপথ
এই পর্যায়ে মুসলমানদের কাছে এই মর্মে সংবাদ পৌঁছলো যে, হযরত উসমান (রা) নিহত হয়েছেন। এই খবর মুসলমানদেরকে সাংঘাতিকভাবে অস্থির করে তুললো। হযরত (স) খবরটি শুনে বললেন : ‘আমাদেরকে অবশ্যই উসমান (সা)-এর রক্তের বদলা নিতে হবে।’ একথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নীচে বসে পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন : ‘আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো, তবু লড়াই থেকে পিছু হটবো না। কুরাইশদের কাছ থেকে আমরা হযরত উসমান (রা)-এর রক্তের বদলা নেবোই।’ এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুসলমানদের মধ্যে এক আশ্চর্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। তারা শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে কাফিরদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হলেন। এরই নাম হচ্ছে ‘রিযওয়ানের শপথ’। কুরআন পাকেও এই শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে সব ভাগ্যবান ব্যক্তি এ সময় হযরত (স)-এর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন।
হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তাবলী
মুসলমানদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা কুরাইশদের কাছেও গিয়ে পৌঁছলো। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গেলো যে, হযরত উসমান (রা)-এর হত্যার খবর সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে কুরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে সুহাইল বিন্‌ আমরকে দূত বানিয়ে পাঠালো। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলী স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্যে হযরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (স)-এর তরফ থেকে তখন কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বললো : ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ একথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হযরত আলী (রা) কিছুতেই এটা মানতে রাযী হলেন না। কিন্তু হযরত (স) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রাসূল।’ এরপর নিম্নোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হলোঃ
১. মুসলমানরা এ বছর হজ্জ না করেই ফিরে যাবে।
২. তারা আগামী বছর আসবে এবং মাত্র তিন দিন থেকে চলে যাবে।
৩. কেউ অস্ত্রপাতি নিয়ে আসবে না। শুধু তলোয়ার সঙ্গে রাখতে পারবে: কিন্তু তাও কোষবদ্ধ থাকবে, বাইরে বের করা যাবে না।
৪. মক্কায় সে সব মুসলমান অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কোনো মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেয়া যাবে না।
৫. কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না।
৬. আরবের গোত্রগুলো মুসলমান বা কাফির যে কোনো পক্ষের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
৭. এ সন্ধি-চুক্তি দশ বছরকাল বহাল থাকবে।
দৃশ্যত এই শর্তাবলী ছিলো মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী আর মুসলমানরা যে চাপে পড়েই এ সন্ধি করেছিলো, তাও বেশ বোঝা যাচ্ছিলো।
হযরত আবু জান্দালের ঘটনা
সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হযরত আবু জান্দাল (সা) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কি কি ধরণের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন। অবশেষে তিনি হযরত (স)-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুযুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন ।’ একথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত নিয়ে যেতে পারেন না।’ এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’ সমস্ত মুসলমান এই পরিস্তিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলো। হযরত উমর (রা) তো রাসূলুল্লাহ (স)-কে এ পর্যন্ত বললেন যে, ‘আপনি যখন আল্লাহর সত্য নবী, তখন আর আমরা এ অপমান কেন সইব? হযরত (স) তাকে বললেন : ‘আমি খোদার পয়গাম্বর, তাঁর হুকুমের নাফরমানী আমি করতে পারিন না। খোদা-ই আমায় সাহায্য করবেন।’
মোটকথা, সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হলো। সন্ধির শর্ত মুতাবেক আবু জান্দালকে ফিরে যেতে হলো। এভাবে ইসলামের পথে জীবন উৎসর্গকারীরা রাসূলের আনুগত্যের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। একদিকে ছিলো দৃশ্যত ইসলামের অবমাননা ও হযরত আবু জান্দালের শোচনীয় দুর্গতি আর অন্যদিকে ছিলো রাসূলুল্লাহ (স) -এর নিরংকুশ আনুগত্যের প্রশ্ন।
হযরত (স) আবু জান্দালকে বললেন : ‘আবু জান্দাল! ধৈয্য ও সংযমের সাথে কাজ করো। খোদা তোমার এবং অন্যান্য মজলুমের জন্যে কোনো রাস্তা বের করে দিবেনই। সন্ধি-চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। কাজেই আমরা তাদের তাদের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারি না।’ তাই আবু জান্দালকে সেই শৃংখলিত অবস্থায়ই ফিরে যেতে হলো।
হুদাইবিয়া সন্ধির প্রভাব
সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হবার পর হযরত (স) সেখানেই কুরবানী করার জন্যে লোকদেরকে হুকুম দিলেন। সর্বপ্রথম তিনি নিজেই কুরবানী করলেন। সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর হযরত (স) তিন দিন সেখানে অবস্থান করলেন। ফিরবার পথে সূরা ফাতাহ নাযিল হলো। তাতে এই সন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করে এতে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করা হলো। যে সন্ধি-চুক্তি মুসলমানরা চাপে পড়ে সম্পাদন করলো, তাকে আবার ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যা দেয়া দৃশ্যত একটি বেখাপ্পা ব্যাপার ছিলো। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্টত প্রমাণ করে দিলো যে, ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবয়ার সন্ধি ছিলো একটি বিরাট বিজয়ের সূচনা মাত্র। এর বিস্তৃত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ :
এতদিন মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে পুরোপুরি একটা যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছিলো। উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার কোনোই সুযোগ ছিলো না। এই সন্ধি-চু্‌ক্তি সেই চরম অবস্থার অবসান ঘটিয়ে রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিলো। এরপর মুসলমান ও অমুসলমানরা নির্বাধে মদীনায় আসতে লাগলো। এভাবে তারা এই নতুন ইসলামী সংগঠনের লোকদেরকে অতি নিকট থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেলো। এর পরিণতিতে তারা বিস্ময়কর রকমে প্রভাবিত হতে লাগলো। যে সব লোকের বিরুদ্ধে তাদের মনে ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো, তাদেরকে তারা নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে আপন লোকদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মানের দেখতে পেলো। তারা আরো প্রত্যক্ষ করলো, আল্লাহর যে সব বান্দাহর বিরুদ্ধে তারা এদ্দিন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে আসছে, তাদের মনে কোনে ঘৃণা বা শত্রুতা নেই; বরং তাদের যা কিছুই ঘৃণা, তা শুধু বিশ্বাস ও গলদ আচার-পদ্ধতির বিরুদ্ধে। তারা (মুসলমানরা) যা কিছুই বলে,তার প্রতিটি কথা সহানুভূতি ও মানবিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ। এতো যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও তারা বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি সদাচরণের বেলায় কোনো ত্রুটি করে না।
পরন্ত এরূপ মেলামেশার ফলে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের সন্দেহ ও আপত্তিগুলো সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা করাও প্রচুর সুযোগ হলো। এতে করে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা কতোখানি ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো, তা তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলো। মোটকথা, এই পরিস্থিতি এমনি এক আবহাওয়ার সৃষ্টি করলো যে, অমুসলিমদের হৃদয় স্বভাবতঃই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। এর ফলে সন্ধির-চুক্তির মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে এতো লোক ইসলাম গ্রহণ করলো যে, ইতঃপূর্বে কখনো তা ঘটেনি। এরই মধ্যে কুরাইশদের কতিপয় নামজাদা সর্দার ও যোদ্ধা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলালো। হযরত খালিদ বিন্‌ অলিদ (রা) এবং হযরত আমর বিন্‌ আস (রা) এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর ফলে ইসলামের প্রভাব-বলয় এতোটা বিস্তৃত হলো এবং তার শক্তিও এতোটা প্রচণ্ড রূপ পরিগ্রহ করলো যে, পুরনো জাহিলিয়াত স্পষ্টত মৃত্যু-লক্ষণ দেখতে লাগলো। কাফির নেতৃবৃন্দ এই পরিস্থিতি অনুধাবণ করে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠলো। তারা স্পষ্টত বুঝতে পারলো, ইসলামের মুকাবিলায় তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই অনতিবিলম্বে সন্ধি-চুক্তি ভেঙে দেয়ার এবং এর ক্রমবর্ধমান সয়লাবকে প্রতিরোধ করার জন্যে আর একবার ইসলামী আন্দোলনের সাথে ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তারা খুঁজে পেলো না। এই চুক্তি ভঙ্গের কথা পরে মক্কা বিজয় প্রসঙ্গে আলোচিত হবে।
সম্রাটদের নামে পত্রাবলী
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হযরত (স) ইসলামের দাওয়াত প্রচারের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন : ‘হে জনমণ্ডলী! আল্লাহ তা’আলা আমাকে তামাম দুনিয়ার জন্যে রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন (আমার বাণী সারা দুনিয়ার জন্যে প্রযোজ্য এবং এটা সবার জন্যে রহমত স্বরূপ)। দেখো, ঈসার হাওয়ারীদের (সঙ্গী-সাথী) ন্যায় তোমরা মতানৈক্য করো না। যাও, আমার পক্ষ থেকে সবার কাছে সত্যের আহবান পৌঁছিয়ে দাও।’
এ সময়, অর্থাৎ ষষ্ঠ হিজরীর শেষ কিংবা সপ্তম হিজরীর শুরুতে তিনি বড়ো বড়ো রাজা-বাদশার নামে আমন্ত্রণ-পত্র লেখেন।৪৬ এসব পত্র নিয়ে বিনন্ন সাহাবীকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। ইতিহাসে যে সব আমন্ত্রণ-পত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নরূপঃ
১. রোম সম্রাট (কাইসার) হিরাক্লিয়াসের নামে পত্র - ওহিয়া কালবী (রা) নিয়ে যান।
২. পারস্য সম্রাট (কিসরা) খসরু পারভেজের নামে পত্র-হযরত আবদুল্লাহ বিন্‌ খাজাফা সাহমী (রা) নিয়ে যান।
৩. মিশরের শাসক আজীজের নামে পত্র-হযরত হাতিম বিন্‌ আবী বালতায়া (রা) নিয়ে যান।
৪. আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর নামে পত্র- হযরত উমর বিন্‌ উমাইয়া (রা) নিয়ে যান।৪৭
রোম সম্রাটের নামে
রোম সম্রাটের কাছে যে পত্র প্রেরিত হয়, তা নিম্নরূপঃ

‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দাহ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে রোমের প্রধান শাসক হিরাক্লিয়াসের নামে।

‘যে ব্যক্তি সত্যাপথ (হেদায়েত) অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আমি তোমাকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি।’

‘আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য ও ফর্মাবর্দারী কবুল করো, তুমি শান্তিতে থাকবে। আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ প্রতিফল দান করবেন। কিন্তু তুমি যদি আল্লাহর ফর্মবর্দারী থেকে বিমুখ হও তাহলে তোমার দেশবাসীর (অপরাধের) জন্যে তুমি দায়ী হবে। (কারণ তোমার অস্বীকৃতির কারণেই তাদের কাছে ইসলামের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছতে পারবে না।’

‘হে আহলি কিতাব ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান; তা এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবো না, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্যেও কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের প্রভু বানাবো না। কিন্তু তোমরা যদি এ কথা মানতে অস্বীকৃত হও, তাহলে (আমরা স্পষ্টত বলে দিচ্ছি যে,) তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম (অর্থাৎ আমরা শুধু খোদারই আনুগত্য ও বন্দেগী করে যাবে।’

আবু সুফিয়ানের সাথে কথাবার্তা
হযরত ওহিয়া কালবী (রা) এই পত্রগুলি বসরায় অবস্থানরত কাইসারের প্রতিনিধি হারি গাস্‌সালীর নিকট পৌঁছিয়ে দিলেন। গাস্‌সালী তখন কাইসারের অধীনে সিরিয়া শাসন করতো। সে পত্রখানি কাইসারের কাছে পাঠিয়ে দিলো। কাইসাস পত্র পেয়েই আরবের কোনো অধিবাসীকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ঐ সময় বাণিজ্য উপলক্ষে আবু সুফিয়ান উক্ত এলাকায় অবস্থান করছিলো। কাইসারের কর্মচারীরা তাকেই দরবারে উপস্থিত করলো। তার সঙ্গে কাইসারের নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো :

কাইসার ; নবুয়্যাতের দাবিদার লোকটির খান্দান কিরূপ?
আবু সুফি : সে শরীফ খান্দানের লোক।
কাইসার : এ খান্দানের কেউ আর কেউ নবুয়্যতের দাবি করেছিলো?
আবু সুফি : কক্ষনো নয়।
কাইসার : এই খান্দানে কেউ কখনো বাদশাহ ছিলো কি?
আবু সুফি : না।
কাইসার : যারা নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে, তারা কি গরীব না ধনবান?
আবু সুফি : গরীব শ্রেণীর লোক।
কাইসার : তার অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে না হ্রাস পাচ্ছেঃ
আবু সুফি : ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
কাইসার : তোমরা কি তাকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখেছো?
আবু সুফি : কক্ষনো নয়।
কাইসার : সে কি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে থাকে?
আবু সুফি : এ পর্যন্ত সে কোনো চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি। তবে তার সাথে একটি নতুন চুক্তি (হুদাইবিয়া সন্ধি) সম্পাদিত হয়েছে। এখন সে চুক্তির উপর অটল থাকে কিনা , দেখা যাবে।
কাইসার : তোমরা তার সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেছো?
আবু সুফি : হ্যাঁ, করেছি।
কাইসার : যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে?
আবু সুফি : কখনো আমরা জিতেছি, কখনো তার জয় হয়েছে।
কাইসার : সে লোকদের কি শিক্ষা দিয়ে থাকে?
আবু সুফি : সে বলে, কেবল এক খোদার ব্‌ন্দেগী করো। অপর কাউকে তার সঙ্গে শরীক করো না। নামায পড়ো। পুত-পবিত্র থাকো। সত্য কথা বলো। একে অপরের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করো ইত্যাদি।
এই কথাবার্তার পর কাইসার বললোঃ ‘পয়গাম্বর হামেশাই ভালো খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। যদি এ লোকটির খান্দানের প্রভাব বলে বিবেচনা করা যেতো-বলা যেতো, রাজত্বের লিপ্সায়ই হয়তো সে এই কৌশল অবলম্বন করেছে। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। আর যখন প্রমাণিত হয়েছে যে, লোকদের ব্যাপারে সে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি, তখন সে খোদার ব্যাপারে এতো বড় মিথ্যা খাড়া করেছে (যে খোদা তাঁকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন), এটা কি করে বলা যায়? তাছাড়া পয়গাম্বরদের প্রথম দিককার অনুসারীরা স্বভাবতঃই গরীব শ্রেণীর লোক হয়ে থাকে। সত্য ধর্মও হামেশা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরন্ত এ-ও সত্য যে, পয়গাম্বররা কখনো কাউকে ধোঁকা দেন না, কারো সঙ্গে ফেরেববাজীও করেন না। সর্বোপরি, তোমরা এও বলছো যে, সে নামায-রোযা, পাক-পবিত্রতা, খোদা-নির্ভরতা ইত্যাদির উপদেশ দিয়ে থাকে। এ সব যদি সত্য হয়, তাহলে তাঁর আধিপত্য একদিন নিশ্চিত রূপে আমার রাজত্য পর্যন্ত পৌঁছবেই। আমি জানতাম যে, একজন পয়গাম্বর আসবেন; কিন্তু তিনি যে আরবেই জন্ম নেবেন, এটা আমার ধারণা ছিলো না। আমি যদি সেখানে যেতে পারতাম তো নিজেই তাঁর পা ধুয়ে দিতাম।’
কাইসারের এসব অভিমত শুনে তাঁর দরবারের পাদ্রী ও আলেমরা ভীষণ খাপ্পা হলো। এমন কি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আশংকা পর্যন্ত দেখা দিলো। এই আশংকার ফলেই কাইসারের হৃদয়ে যে সত্যের আলো জ্বলে উঠেছিলো, তা আবার নিভে গেলো। বাস্তবিকই সত্যকে গ্রহণ করার পথে ধন-মাল ও ক্ষমতার মোহই সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
পারস্য সম্রাটের নামে
পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের নামে নিম্নোক্ত পত্র লেখা হলো :
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের তরফ থেকে পারস্যের প্রধান শাসক কিসরা সমীপে।
‘যে ব্যক্তি সত্যপথ (হেদায়েত) অনুসরণ করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সমস্ত মানুষের জন্যে আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত পয়গাম্বর, যেনো প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তিকে (আল্লাহর নাফরমানীর) মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি। তুমিও আল্লাহর আনুগত্য ও ফর্মাবর্দারী কবুল করো। তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হবে। নচেত অগ্নিপূজকদের পাপের জন্যে তুমি দায়ী হবে।’
খসরু পারভেজ ছিলো প্রবল প্রতাবান্বিত সম্রাট। তার কাছে প্রথম খোদার নাম, তারপর পত্র-প্রেরকের নাম এবং তারপর সম্রাটের নাম লেখা, তাও আবার নিতান্ত সাদাসিধা ভাবে,তদুপরি দরবারে প্রচলিত কায়দা-কানুন, লিখন-পদ্ধতি ও সম্বোধন রীতির ছাপ পর্যন্ত নেই- পত্র লেখার এ ধরণটাই ছিলো অসহ্য। খসরু পারভেজ এই পত্র দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং বললো : ‘আমার গোলাম হয়ে আমায় এমনিভাবে পত্র লেখার স্পর্ধা! একথা বলেই সে পত্রখানি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো এবং এই নবুয়্যাতের দাবিদারকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে তার সামনে হাযির করার জন্যে তার ইয়েমেনস' গভর্নরকে নির্দেশ পাঠালো।৪৮
ইয়েমেনের গভর্নর হযরত (স)-কে ডেকে নেবার জন্যে তাঁর খেদমতে দুজন কর্মচারী পাঠিয়ে দিলো। এরই মধ্যে খসরু পারভেজের পুত্র তাকে হত্যা করে নিজেই সিংহাসন দখল করে বসলো। গভর্নর কর্তৃক প্রেরিত কর্মচারীদ্বয় যখন হযরত (স)-এর খেদমতে পৌঁছলো,তখর এ সম্পর্কে তারা কিছুতেই অবহিত ছিলো না। হযরত (স) আল্লাহর নির্দেশক্রমে এ কথা জানতে পারলেন। তিনি কর্মচারীদ্বয়কে এ ঘটনা অবহিত করে বললেন : “তোমরা ফিরে যাও এবং গভর্নরকে গিয়ে বলো, ইসলামের কর্তৃত্ব শীগগীরই খসরু পারভেজের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছবে।’ কর্মচারীদ্বয় ইয়েমেনে ফিরে গিয়ে জানতে পারলো, খসরু পারভেজ সত্য সত্যই নিহত হয়েছে।
আবিসিনিয়ার নাজ্জাশী ও মিসরের আজীজের নামে
আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছেও প্রায় অনুরূপ বিষয়-সম্বলিত পত্র প্রেরণ করা হলো। তার জবাবে তিনি লিখলেন : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি খোদার সাচ্চা পয়গাম্বর।’ নাজ্জাশী হযরত জাফরের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, একথা ইতঃপূর্বে ‘আবিসিনিয়ায় হিজরত’ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে।
মিশরের আজীজ যদিও চিঠি পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন নি।, কিন্তু তিনি পত্র-বাহককে খুব সম্মান করেন এবং উপঢৌকন দিয়ে ফেরত পাঠান।
ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা
মদীনা থেকে বনু নযীর গোত্রের লোকদেরকে বহিস্কৃত করার পর তারা খায়বরে এসে বসতি স্থাপন করলো। খায়বর মদীনা মুনাওয়ারা থেকে প্রায় দু’শ মাইল উত্ত-পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে ইহুদীরা কয়েকটি বড়ো সুদৃঢ় কিল্লা নির্মাণ করেছিলো।
খায়বর তখন ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধতার সবচাইতে বড়ো কেন্দ্র এবং ইসলামের পক্ষে একটি স্থায়ী বিপদে পরিণতি হয়েছিলো। খন্দক যুদ্ধের সময় মদীনার ওপর যে প্রচণ্ড হামলা চালান হয়েছিলো, তার মূল কারণ ছিলো এই খায়বরের ইহুদীরাই। সেই চক্রান্ত ব্যর্থক হবার পর ভিন্নতর পন্থায় ইসলামী আন্দোলনের মূলোৎপাটনের জন্যে তারা ক্রমাগত ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগালো। এই উদ্দেশ্যে তারা আরবের বিভিন্ন গোত্র বিশেষত কুরাইশদের সঙ্গে আঁতাত স্থাপন তো করলোই, সেই সঙ্গে মদীনার মুনাফিকদেরও উস্কাতে শুর করলো। তাদেরকে এই মর্মে বুঝানো হলো যে, তারা যদি মুসলমানদের ভেতরে থেকে এদের শিকড় কাটতে থাকে, তাহলে বাইরের বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষে ইসলামকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়া সহজতর হবে। ইহুদীদের এই সব চক্রান্তের খবর হযরত (স)-এর কাছেও যথারীতি পৌঁছতে লাগলো। তিনি ইহুদীদেরকে এ জঘন্য তৎপরতা থেকে বিরত হলো না। এমন কি তারা বিভিন্ন গোত্রের কাছ এই মর্মে প্রস্তাব পাঠালো যে, ‘আমাদের সঙ্গে মিলে যদি তোমরা মদীনার ওপর হামলা করো, তাহলে তোমাদেরকে স্থায়ীভাবে আপন খেজুর বাগানের অর্ধেক ফসল দিতে থাকবো।’ মোটকথা, ইহুদীদের চক্রান্তের ফলে বহু গোত্রের মন-মানস পরিবর্তিত হলো এবং তারা একযোগে মদীনার ওপর হামলা করার ব্যাপরে ঐক্যমত্যে পৌঁছলো।
আক্রমণাত্নক যুদ্ধ
এ যাবত মুসলমানরা যুদ্ধ করে আসছে শুধু আত্নরক্ষার খাতিরে। দুশমনরা তাদেরকে খতম করার জন্যে হামলা চালিয়েছে আর তাঁরা আত্নরক্ষার জন্যে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলার সাহায্য তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবংদুশমনরা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পলায়ন করেছে। কিন্তু এই স্তরে এসে অবস্থার গতি অন্যদিকে মোড় নিলো। কুফরী শক্তির সুসংহত রূপ নেবার আগেই আক্রমণাত্নক হামলা চালিয়ে তাকে খতম করে দেবার প্রয়োজন দেখা দিলো। কারণ ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার জন্যে যেমন প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধেত্ম প্রয়োজন রয়োছে, তেমনি প্রয়োজন মতো আক্রমণাত্নক হামলা করারও দরকার আছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-পদ্ধতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই জীবন পদ্ধতি ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কায়েম ও তাকে নিরাপদ করতে হলে কেবল অন-ইসলামী জিন্দেগী ও জীবন বিধানের অনুপর্তীদের হামলা থেকে আত্নরক্ষা করাই যথেষ্ট নয়; বরং এই জীবন বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে কখনো কখনো অন্যান্য বাতিল জীবন পদ্ধতিকে উৎখাত করার জন্যে আক্রমণাত্নক আঘাত হানারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
খন্দক যুদ্ধের পর ইসলামী আন্দোলন এই স্তরেই প্রবেশ করলো। এবার শুধু প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধই নয়; বরং এখন আক্রমণাত্নক মনোভাব নিয়ে বিপদাশংকা চিরতরে মুছে ফেলারই প্রয়োজন দেখা দিলো। তাই খন্দক যুদ্ধের সমআপ্তির পর হযরত আমরা শুধু তার মুকাবিলা করবো, এখন আর এটা চলবে না; বরং এখন আমরা নিজেরাই গিয়ে দুশমনদের ওপর হামলা করবো।৪৯
খায়বর আক্রমণ
এবার খায়বরের ইহূদীদের ক্রমবর্ধমান ফিতনাকে কার্যকর ভাবে প্রতিরোধ করার সময় এসে পড়লো! হযরত [স] খায়বরের ওপর হামলা চালানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন এবং ইহুদীদের তরফ থেকে সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে যাত্রা করলেন। এটা সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসের ঘটনা। এই হামলার জন্যে তিনি ষোলশ’ সৈন্য সঙ্গে নিলেন। এর ভেতরে মাত্র দু’শ ছিলো অশ্ব ও উষ্ট্রারোহী, বাকী সব পদাতিক।
খায়বরে ছয়টি দুর্গ এবং তাতে বিশ হাজার ইহুদী সৈন্য মোহায়েন ছিলো। সেখানে পৌঁছে হযরত (স) নিশ্চিতরূপ জানতে পারলেন যে, ইহুদীরা সত্য সত্যই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত; তারা কোনো অবস্থায়ই কোনো সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন করতে রাযী নয়। তিনি সাহাবীদের সামনে জিহাদ সম্পর্কে একটি উদ্দীপনাময় ভাষণ প্রদান করলেন এবং আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে তাদেরকে জীবন পণ করার উপদেশ দিলেন। পর দিন তিনি ইহুদীদের দুর্গগুলো অবরোধ করলেন। অবরোধকালে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হলো। প্রায় বিশ দিন অবরোধের পর আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে বিজয় দান করলেন। এই যুদ্ধে ৯৩ জন ইহুদী নিহত এবং ১৫ জন মুসলমান শহীদ হলেন। হযরত আলী (রা)-এর হাতে মারহাব নামক ইহুদিদের এক বিরাট পাহলোয়ান নিহত হলো। ইহুদীরা তার বীর্যবত্তার জন্যে গর্ব করতো। তার মৃত্যু তাই এ যুদ্ধের এক বিরাট উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিলো।
বিজয়ের পর ইহুদীগণ আবেদন জানালো, তাদের কাছে যে সব জমি-জমা রয়েছে, তা তাদেরকেই ছেড়ে দেয়া হলে মুসলানদেরকে তারা অর্ধেক ফসল দিতে থাকবে। তাদের এই আবেদন হযরত (স) মঞ্জুর করলেন। পরবর্তী বছরগুলোতে এই ফসল আদায়ের ব্যাপরে মুসলিম কর্মচারীগণ ইহুদীদের সঙ্গে অত্যন্ত ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার প্রদর্শন করেন। তাঁরা ফসলকে দু’ভাগে বিভক্ত করতেন এবং কৃষকদের যে ভাগ ইচ্ছা পছন্দ করে নেবার অধিকার দিতেন। এভাবে ফসল আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহুদীদের অন্তরও তাঁরা জয় করে নিলেন।
মুসলিম সমাজের প্রশিক্ষণ
ওহুদ যুদ্ধের পর ইসলামী আন্দোলনের জন্যে বাইরের বিপদাশংকা কি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিলো, খন্দক যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে তা সহজেই আন্দাজ করা চলে। এটি ছিলো অত্যন্ত সংঘাতের সময়; কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনের আহবায়ক একজন জেনারেল হিসেবে যেমন দৃঢ়তার সাথে এসব ঘটনাবলী মুকাবিলা করছিলেন, তেমনি একজন সুদক্ষ নৈতিক শিক্ষক হিসেবেও তিনি আন্দোলনের অগ্রসেনাদের জন্যে যথোচিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছিলেন। তিনি এই নয়া ইসলামী সমাজের জন্যে প্রায়োজনীয় আইন-কানুন ও নিয়ম-বিধি শিক্ষা দেয়া হতো, তা এ সময়ে অবতীর্ণ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা অর্থাৎ নিসা ও সূরা মায়েদা অধ্যয়ন করলেই স্পষ্টত অনুমান করা যায়।
সূরা নিসা চতুর্থ ও পঞ্চম হিজরীর বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ সময়ে অবতীর্ণ হয়। এ সময় নবী করীম (স) এই নতুন ইসলামী সমাজকে পুরনো জাহিলী রীতিনীতি ও বিধি-ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করে কিভাবে নৈতিকতা, কৃষ্টি-সভ্যতা, সামাজিক ও অর্থনীতির নবতর ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন, এ থেকে তা সহজেই আন্দাজ করা চলে। এ সময় আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক জীবনেও ইসলামী ধারায় শুধরে নেবার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় পথ নির্দেশ দিলেন। তাদেরকে পারিবারিক ব্যবস্থাপনার নীতি বাতলানো হলো; বিবাহ ও তালাক সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিযম-নীতি জানিয়ে দেয়া হলো; নারী-পুরুষের অধিকার-সীমা নির্দিষ্ট করে সমাজের নান ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা হলো, ইয়াতিম, মিসকীন ও দরিদ্র লোকদের অধিকারের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে তাগিদ করা হলো; সম্পদের উত্তরাধিকর সংক্রান- নীতিভঙ্গি নির্ধারণ করা হলো; পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতি বাতলে দেয়া হলো, শরাব পানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো এবং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম-কানুন বলে দেয়া হলো। এভাবে খোদা ও তাঁর বান্দাদের সাথে একজন সৎ লোকের সম্পর্ক সম্বন্ধে মুসলমানদেরকে অবহিত করা হলো। সেই সঙ্গে আহলি কিতাবদের ভ্রান্ত আচরণ ও অসঙ্গত জীবন যাপন পদ্ধতির সমালোচনা করে তাদের দোষ-ত্রুটিগুলো সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরা হলো এবং মুসলমানদেরকে এ ধরণের ভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকার জন্যে সতর্ক করে দেয়া হলো।
বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের এ দিকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সংশোধন ছাড়া বাতিলের মুকাবিলায় তার সাফল্য অর্জন কখনোই সম্ভব নয়। অন্য কথায়, ইসলামী আন্দোলনের অগ্রসেনাদের শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতার দিক থেকেই বাতিলপন্থীদের চেয়ে উন্নত হওয়া যথেষ্ট নয়; বরং অন-ইসলামী সমাজের তুলনায় সর্বদিক থেকে শ্রেষ্ঠ একটি আদর্শ সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও তাদের কর্তব্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কোনো বিশেষ ধরণের উদ্যোগ-আয়োজনের প্রয়োজন নেই; বরং আন্দোলনের অগ্রসেনাদের মধ্যে খোদানির্ভরতা ও খোদাপ্রেমের গুণাবলী সৃষ্টি হতে থাকলে স্বভাবতই এরূপ ফলাফল প্রকাশ পেতে থাকে। এ কারণেই একজন নবীর সংস্কারক ও বিপ্লবাত্নক আন্দোলন অন্যান্য সমস্ত আন্দোলনের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে থাকে। নবী সাধারণ লোকদের মধ্যে আদর্শ প্রচার করার জন্যে যতোটা অস্থির হয়ে থাকেন, তাঁর অনুবর্তীদের শিক্ষা-দীক্ষা ও সংশোধনের প্রতি তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে থাকেন। ইসলামী আন্দোলনের এই বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব সূরা নিসা বক্তব্যেও প্রতিভাত হয়েছে। এই সূরায় নৈতিকতা, কৃষ্টি-সভ্যতা, সামাজিকতা ইত্যাদি বিষয়ে আইন-কানুন বর্ণনার পাশাপাশি দাওয়াত ও তাবলীগের প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং মুশরিক ও আহলি কিতাবদেরকে যথারীতি সত্য দ্বীনের দিকে আহবান জানানো হয়েছে।
সূরা মায়েদা হুদাইবিয়া সন্ধির পর প্রায় সপ্তম হিজরীতে অবতীর্ণ হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি-চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানরা ঐ বছর ‘উমরা’ করতে পারে নি। তখন স্থির করা হয়েছিলো যে, হযরত (স) পরবর্তী বছর কা’বা জিয়ারত করতে আসবেন । তাই ঐ সময়ের পূর্বে কা’বা জিয়ারত সম্পর্কে বহু নিয়ম-কানুন বাতলে দেবার প্রয়োজন হলো। এ ছাড়া কাফিরদের বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও মুসলমানরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কখনো যাতে সীমালংঘন না করে, সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হলো।
এ সূরাটি (সুলা মায়েদা) যখন অবতীর্ণ হয়, তখন পর্যন্ত মুসলমানদের অবস্থা অনেক বদলে গিয়েছিলো। ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তীকালে মুসলমানরা যে রূপ চারদিক দিয়ে বিপদ পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলো, এ সময়টা ঠিক সে রকম ছিলো না। এ সময় ইসলাম নিজেই একটি প্রচণ্ড শক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছিলো এবং ইসলামী রাষ্ট্রও যথেষ্ট সমপ্রসারিত হয়েছিলো। মদীনার চারদিকে দে-দুশ’ মাইলের মধ্যকার সমস্ত বিরোধী গোত্রের শক্তি এ সময় ভেঙে পড়েছিলো এবং খোদ মদীনা থেকে বিপজ্জনক ইহুদীগণ সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। কোথাও কিছু অবশিষ্ট থাকলে তারাও মদীনা সরকারের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলো। মোটকথা, এ সময় এ সত্য স্পষ্টত প্রতিভাত হয়ে উঠলো যে, ইসলাম শুধু কতিপয় আকীদা-বিশ্বাসেরই সমষ্টি নয়, যাকে প্রচলিত ভাষায় ‘ধর্ম’ বলা যায় এবং যার সম্পর্ক কেবল মানুষের মন-মগজের সঙ্গে বরং ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-পদ্ধতি, যার সম্পর্ক মানুষের মন-মগজ ছাড়াও তার পূর্ণ জীবনের সঙ্গে; সমাজ, রাষ্ট্র, যুদ্ধ, সন্ধি সব কিছুই তার অন্তর্ভুক্ত। পরন্ত এ সময় মুসলমানরা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো। তারা যে জীবন পদ্ধতিকে (দ্বীন) বুঝে-শুনে গ্রহণ করেছিলো , তার ভিত্তিতে তারা নিজেরা নির্বোধ জীবন যাপন করতে পারছিলো। বাইরের অন্য কোনো জীবন পদ্ধতি বা আইন-কানুন তাদের গতিরোধ করতে পাছিলো না; বরং তারা এই দ্বীনের দিকে অন্যান্য লোকদেরকেও আহবান জানাতে সমর্থ হচ্ছিলো।
এ সময় মুসলমানদের নিজস্ব একটি কৃষ্টি-সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো এবং অন্যান্য কৃষ্টি-সভ্যতা থেকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হতে লাগলো। মুসলমানদের নৈতিক চরিত্র, তাদের জীবন যাপন পদ্ধতি, তাদের আচার-ব্যবহার-এক কথায় তাদের জীবনের সমগ্র কাঠামোই ইসলামী নীতির ছাঁচে ঢালাই হতে লাগলো। অন্যান্য জাতির মুকাবিলায় তারা সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী হয়ে উঠলো। তাদের নিজস্ব দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন প্রচলিত হলো; নিজস্ব আদালত ও কোর্ট-কাচারী বসলো; লেনদেন ও বেচা-কেনার নিজস্ব পদ্ধতি চালু হলো; উত্তরাধিকার সম্পর্কে একটি স্থায়ী বিধান জারি হলো। এ ছাড়া বিবাহ ,তালাক, পর্দা এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয়েও তাদের নিজস্ব আইন-কানুন চালু হলো। এমন কি তাদের উঠা-বসা, খানা-পিনা ও মেলামেশার নিয়ম-কানুন সম্পর্কেও সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ দেয়া হলো।
সূরা মায়েদার হজ্জ সংক্রান- নিয়মাবলী, খাদ্য-দ্রব্যে হারাম-হালালের বাচ-বিচার, অযু-গোসল ও তায়াম্মুমের নিয়মাবলী, শরাব ও জুয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা, সাক্ষ্য আইন সম্পর্কিত নির্দেশাবলী, বিচার ও ইনসাফের ওপর কয়েম থাকার তাগিদ ইত্যাদি সহ ইসলামী সমাজ গঠনের জন্যে অপরিহার্য বিষয়াদি বিবৃত হলো। তাই এর প্রতিটি বিষয়ের প্রতিই অতীব গুরুত্ব আরোপ করা হলো।