মানব জীবনে কোরবানীর শিক্ষা
আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বে মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মধ্যে বিবাহকে কেন্দ্র করে বিবাদ দেখা দিলে হযরত আদম (আঃ) তাদেরকে কোরবানী করার আদেশ দেন। তখন থেকেই কোরবানীর প্রচলন শুরু হয়। তবে সে সময় কোরবানীর নিয়ম ছিল ভিন্ন। ভেড়া, দুম্বা, শস্য বা গম ইত্যাদি কোরবানীর জন্য পেশ করা হতো। যার কোরবানী কবুল হতো আল্লাহপাকের হুকুমে আকাশ থেকে অগ্নি এসে তা ভস্মীভূত করে দিত। যারটা কবুল হতো না তারটা এমনি পড়ে থাকতো।
কোরবানীর পরিচয়ঃ কুরবানী আরবী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানী বলা হয় ঐ নির্দিষ্ট জন্তুকে যা একমাত্র আল্লাহপাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে একমাত্র আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়।
কোরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্যঃ কোরবানী আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর অতুলনীয় ত্যাগের স্মৃতি বহন করে। কোরবানীর দ্বারা মুসলমানগণ ঘোষণা করে যে, তাদের কাছে আপন জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। কোরবানীর মাধ্যমে ত্যাগ ও উৎসর্গের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাই উদ্দেশ্য। এর দ্বারা আল্লাহপাক মানুষের আন্তরিকতা যাচাই করেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلاَ دِمَآؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقْوَىٰ مِنكُمْ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَبَشرِ ٱلْمُحْسِنِينَ } “কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া”(সূরা হজ্জ আয়াত-৩৭)। কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত মোটা, কত সুন্দর, আল্লাহপাক তা দেখেন না বরং তিনি দেখতে চান কার অন্তরে কতটুকু তাকওয়া বা পরহেজগারী আছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত, দীর্ঘ হাদীসে প্রিয় নবী (সাঃ) ঘোষণা করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদের শরীর ও চেহারা-সুরতের দিকে লক্ষ্য করেন না, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের দিকে।” (মুসলিম শরীফ)।
ঐতিহাসিক পটভূমিঃ আল্লাহতায়ালা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে অনেকবার পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহপাক তাকে ইঙ্গিত করেছেন প্রাণধিক পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করতে। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কি হতে পারে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করবেন। তখন তিনি হযরত ইসমাঈল (আঃ) বললেন, যা পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعْيَ قَالَ يٰبُنَيَّ إِنيۤ أَرَىٰ فِي ٱلْمَنَامِ أَني أَذْبَحُكَ فَٱنظُرْ مَاذَا تَرَىٰ قَالَ يٰأَبَتِ ٱفْعَلْ مَا تُؤمَرُ سَتَجِدُنِيۤ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّابِرِينَ * فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ * وَنَادَيْنَاهُ أَن يٰإِبْرَاهِيمُ - “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি?” সে (হযরত ইসমাঈল (আঃ)) বলল, “হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা সফফাত আয়াত-১০২)। ছেলের সাহসিকতাপূর্ণ জবাব পেয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) অত্যন্ত খুশি হলেন। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছেলের গলায় ছুরি চালান। তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত হতে একটা দুম্বা নিয়ে রওয়ানা হলেন। তার মনে সংশয় ছিল পৃথিবীতে পদার্পণের পূর্বেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যবেহ কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলবেন। তাই জিবরাইল (আঃ) আকাশ হতে উচ্চৈস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন “আল্লাহু আকবার”। আওয়াজ শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার”। পিতার মুখে তাওহীদের বাণী শুনতে পেয়ে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলে উঠলেন আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিলহামদ”। আল্লাহর প্রিয় দুই নবী এবং হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর কালামগুলো আল্লাহর দরবারে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত এই কথাগুলো ৯ই জিলহজ্ব ফজর থেকে আসর পর্যন্ত বিশেষ করে ঈদুল আযহার দিনে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকবে।
আল্লাহপাকের অসীম কুদরতে হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে কোরবানী হয়ে গেল একটি বেহেস্তী দুম্বা। কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে ঘোষণা করেনঃ وَنَادَيْنَاهُ أَن يٰإِبْرَاهِيمُ * قَدْ صَدَّقْتَ ٱلرُّؤْيَآ إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي ٱلْمُحْسِنِينَ * إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلْبَلاَءُ ٱلْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ * وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي ٱلآخِرِينَ *
“তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার (ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু।” (সূরা সাফফাত আয়াত-১০৪-১০৭)। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) উপরোক্ত গায়েবী আওয়াজ শুনে হযরত জিবরাইল (আঃ)কে একটি বেহেস্তী দুম্বাসহ দেখতে পান। এ জান্নাতী দুম্বা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দেয়া হলে তিনি আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে সেটি কোরবানী করলেন। আর তখন থেকেই শুরু হলো কোরবানীর মহান বিস্ময়কর ইতিহাস। যা অন্ততকাল ধরে সুন্নতে ইব্রাহীম হিসেবে বিশ্বের সকল মুসলমানের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। কোরবানীর তাৎপর্যঃ কোরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানীর তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদীস পাওয়া যায়। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা কতিপয় সাহাবী প্রিয় নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল!, কোরবানী কি? প্রিয় নবী (সাঃ) বললেন, তোমাদের (জাতির) পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নত। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, এতে আমাদের জন্য কি আছে? রাসূলে পাক (সাঃ) বললেন, কোরবানী গরু ও বকরীর প্রতিটি পশমে নেকী রয়েছে। তখন সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ভেড়া ও দুম্বার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি উত্তরে বললেন, ভেড়া ও দুম্বার পশমেও ছওয়াব আছে। (আহমাদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত-১২৯)। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, কোরবানীর পশু পুলসীরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে। তাই তোমরা মোটা তাজা পশু কোরবানী কর। তারগীব নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে একবার হযরত নবী করিম (সাঃ) স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে (রাঃ) ডেকে বললেন “হে ফাতেমা! তুমি তোমার কোরবানীর জন্তুর নিকট যাও কেন না কোরবানীর জন্তু জবেহ করার পর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তোমার যাবতীয় গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।” হযরত ফাতেমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্য? প্রিয় নবী (সাঃ) জবাব দিলেন “এটা সকল মুসলমানের জন্য”। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান কোরবানীর দিন যেসব নেকীর কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহতায়ালার নিকট সবচেয়ে পছন্দীয় আমল হলো কোরবানী করা। কেয়ামতের দিন কোরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা এ পুরস্কারে আন্তরিকভাবে খুশী হও। (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, মিশকাত-পৃ-১২৮)। কোরবানী করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা। এ জন্যই প্রাণী জবেহ করার বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। এ বিধানকে অমান্য করে কেউ যদি কোরবানীর পশুর মূল্য দান করে দেয় অথবা তার পরিবর্তে খাদ্য-শস্য, কাপড় ইত্যাদি গরীবকে দান করে দেয় তবে তার দ্বারা আল্লাহপাকের এই হুকুম পালন করা হবে না। এমনকি প্রতিটি পশমের বিনিময়ে যে সওয়াবের কথা রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত হবে। এ হাদীসে এরশাদ হয়েছে “যে ব্যক্তি সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করল না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে”।
কোরবানী কার উপর ওয়াজিবঃ যার উপর যাকাত ফরজ হয়েছে তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। তবে যাকাত এবং কোরবানী ওয়াজিব হবার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ কোরবানীর দিবসের আগের চব্বিশ ঘন্টা সঞ্চিত থাকাও জরুরী নয়। বরং জিলহজ্ব মাসের নবম তারিখের আসরের সময় যদি নিসাব পরিমাণ মাল কারো হস্তগত হয় তাহলেই তার উপর কোরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে। এমনকি ১০ জিলহজ্ব থেকে ১২ জিলহজ্ব এই তিন দিনের যেকোন একদিন মালিক হলেই কোরবানী ওয়াজিব হবে। তাছাড়া নিম্নের শর্তগুলো পাওয়া গেলেই কোরবানী ওয়াজিব হবেঃ
(ক) কোরবানীর দিন নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। কাজেই গরীবের উপর কোরবানী ওয়াজিব নয়।
(খ) সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া।
(গ) স্বাধীন হওয়া।
(ঘ) মুসলমান হওয়া।
(ঙ) প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
(চ) মুকিম বা স্থায়ী হওয়া। মহিলাদের নিজস্ব সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে ব্যক্তিগতভাবে তার উপর কোরবানী ওয়াজিব হবে।
কিরূপ পশু দ্বারা কোরবানী করতে হবেঃ কি কি পশু দ্বারা কোরবানী করা যাবে এবং কি ধরনের হতে হবে তা ইসলামী শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। যথাঃ গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বা দ্বারা কোরবানী করা যেতে পারে। এছাড়া অন্য জন্তু যত মূল্যবানই হোক বা সুস্বাদুই হোক, পশুই হোক আর পাখিই হোক কোরবানী দুরস্ত হবে না। যেমন হরিণ বা অন্য কোন জন্তু, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি দিয়ে কোরবানী করলে জায়েজ হবে না। যেহেতু কোরবানীর জন্তুটি আল্লাহপাকের মহান দরবারে পেশ করা হয়ে থাকে এ জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট ধরনের মোটা তাজা সুস্থ সবল এবং সকল প্রকার ত্রম্নটিমুক্ত হতে হবে। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন যে, আমরা কোরবানীর পশুর চোখ ও কান ভালভাবে পরীক্ষা করে নেই এবং এমন পশু কোরবানী না করি যার কানে ছিদ্র আছে (তিরমিযী শরীফ)।
বস্তুতঃ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মহান আল্লাহপাকের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন তা যেমন অতুলনীয় ঠিক তেমনিভাবে চির অনুস্মরণীয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আজ পৃথিবীতে লক্ষ কোটি মুসলমান হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মহান আত্মত্যাগের আদর্শকে অনুসরণ করে মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য নিজেদের জানমাল কোরবান করছে। সাথে সাথে নিজের সর্বস্ব পর্যন্ত কোরবানী করার বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। যার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় প্রতিটি মুমিন মুসলমানের গৃহে কোরবানীর দিনে।