হজরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেইশ বছরের নবুওতি জিন্দেগির সাধনার দ্বারা এমন একটা আদর্শ জনগোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন, যারা গুণগত উত্কর্ষতার কারণেই আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন। তাদের পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সময়কালের জন্য মুসলিম উম্মাহর আদর্শ শিক্ষক এবং অনুসরণীয় নুমনারূপে। তারাই সাহাবায়ে-কেরামের জামাত। অনন্ত সম্ভাবনাময় একটা বিরাট জাতিসত্তার সফল নেতৃত্ব প্রদান করার মতো যোগ্য প্রশিক্ষণ তাদের দেয়া হয়েছিল।শুধু সমকালীন যুগের সমস্যাদিই নয়, ভবিষ্যত্কালেও এ উম্মত সাধারণভাবে যেসব মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যেসব ব্যাধির নিশ্চিত পরিণতিই হচ্ছে শুধুই ধ্বংস, সেসব বিষয়াদি সম্পর্কেও পরবর্তী উম্মতকে সতর্ক করার লক্ষ্যে অনেক তাত্পর্যপূর্ণ বাণী এবং ইশারা সাহাবাদের সামনে আল্লাহর রাসুল (সা.) রেখে গেছেন। প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থগুলোর ‘কিতাবুল-ফেতান’ এবং কেয়ামতের আলামত শীর্ষক অধ্যায়ে সেসব অমূল্য বাণী সংকলিত হয়েছে।
সম্ভাব্য ফেতনা বা বিপর্যয় সম্পর্কিত সে হাদিসগুলো ভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে সে ধরনের কিছু বর্ণনাই শুধু নয়। নিশ্চিতরূপে সেগুলো উম্মতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একেকটি সতর্কবাণী। ফেতনা বা বিপর্যয়ের আগাম সতর্কবাণী সম্পর্কিত এসব হাদিস সম্পর্কে ভাষ্যকারদের অভিমত হচ্ছে যে মুসলিম উম্মাহ যখনই এসব ফেতনায় আক্রান্ত হতে শুরু করবে, তখন তাদের ওপর একের পর এক খোদায়ী গজব নাজিল হতে শুরু করবে। গজব দেখে যদি তারা সতর্ক হয় এবং নবী করীমের (সা.) দেখানো পথে ফিরে আসে, তবে আল্লাহপাক তাদের ওপর থেকে বিপর্যয়ও তুলে নেবেন, পুনরায় তারা নেতৃত্ব ও মর্যাদার আসন ফিরে পাবে। আর উম্মতের সবাই যদি ফেতনার প্লাবনে গা ভাসিয়ে দেয়, দুনিয়ার কোনো অংশেই যদি নির্ভেজাল সত্যের আলো আর অবশিষ্ট না থাকে, তবে দুনিয়ার ওপর মহাপ্রলয় নেমে আসবে। আর সমগ্র মানবজাতিই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহতায়ালার আজাব ও গজব সৃষ্টিকারী সেসব ফেতনা যদি বিশেষ কোনো অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করে, তবে তার পরিণতিও সেই বিশেষ অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।ধ্বংস আসবে এবং দুনিয়া মহাপ্রলয়ের শিকার হবে। তিলে তিলে গড়া মানুষের এ বিপুলায়তন সভ্যতা করুণ পরণতি বরণ করবে। আর এ পরিণতির কারণ হবে মানুষ নিজেই। মানুষেরই স্বহস্তকৃত দুষ্কর্ম জলস্থলে বিপর্যয় সৃষ্টি করে দেবে। নবী করীম (সা.) এর ফেতনা সম্পর্কিত এ সতর্কবাণীগুলো সেসব অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের কবল থেকে আত্মরক্ষা করার লক্ষ্যে উচ্চারিত হয়েছিল, যারা এসব মহাবাণীর প্রতি গুরুত্ব দেবে, তারা অবশ্যই সম্ভাব্য করুণ পরিণতি থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হবে।সাম্প্রতিক দিনগুলোয় আমরা একের পর এক নানা বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছি। বান-বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ফসলহানি, জীবন ও সম্পদের অকল্পনীয় ক্ষতি যেন আমাদের জন্য একটা স্থায়ী ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়েছে। জাতীয় জীবনের প্রতিটা দিন যেমন যাচ্ছে মারাত্মক উদ্বেগের মধ্য দিয়ে, তেমনি প্রত্যেকটা নতুন দিন আসছে একটানা একটা নতুন উদ্বেগের বিভীষিকা নিয়ে। এমন একটা ভয়াবহ বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ফেতনা সম্পর্কিত হাসিদগুলো নতুন করে পাঠ করা এবং তিনি যেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সতর্কবাণী করে গেছেন, সেগুলোতে আমরা কতটুকু জড়িয়ে পড়েছি, তা যাচাই করে দেখার তাগিদ বোধহয় খুবই সময়োপযোগী হবে।সাহাবি হজরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সামনে খুতবা দিতে দাঁড়ালেন এবং সেদিন থেকে শুরু করে কেয়ামত পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে যা কিছু হওয়ার সেসব কিছু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই তা স্মরণ রেখেছেন, আবার অনেকেই ভুলেও গেছেন। সে সবের মধ্য থেকে যখন কোনো একটার আলামত প্রকাশ পায় তখনই এ সম্পর্কিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সতর্কবাণী আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, যেমন অনেক পরিচিত ব্যক্তির চেহারাও আমরা ভুলে যাই, কিন্তু সাক্ষাত্ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আবার স্মরণ হয়ে যায় (বুখারি ও মুসলিম)।
নানারকম ফেতনা মানুষের মনের মধ্যে এসে বাসা বাঁধতে থাকবে। যারা সতর্ক হবে না, তাদের অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়বে। সাহাবি হজরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি ফেতনা মানুষের মন-মস্তিষ্কের মধ্যে একের পর এক এসে স্থান গ্রহণ করতে থাকবে, যেমন একটির পর একটি বেতি সংযুক্ত হয়ে চাটাইয়ের সৃষ্টি হয়। যেসব অন্তর তা গ্রহণ করবে, সেগুলোয় একটি কালো দাগ পড়ে যাবে (এবং সেটি ক্রমে বিস্তৃত হবে)। আর যেসব অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করবে সেগুলোতে স্বচ্ছ মর্মর পাথরের মতো একটা শুভ্রতা সৃষ্টি হবে। যে পর্যন্ত আসমান-জমিন কায়েম থাকবে, সে পর্যন্ত কোনো ফেতনাই এসব অন্তরকে কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। অপরদিকে ফেতনার প্রভাব গ্রহণ করত কলুষিত হয়ে যাওয়া অন্তরগুলো কালো ছাইয়ে পূর্ণ পাত্রের মতো হয়ে যাবে। কোনো সত্কর্মের প্রতিই এদের মনে কোনো আকর্ষণ থাকবে না, কোনো মন্দকাজে জড়িত হতেও মনে দ্বিধা সৃষ্টি হবে না। প্রবৃত্তির তাড়না দ্বারাই কেবল তারা ভালো-মন্দ বিচার করবে (মুসলিম শরিফ)।আমানত বা সত্যের প্রতি দৃঢ়তা ও শ্রদ্ধাবোধ এমন একটা গুণ যা দ্বারা সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করা যায় এবং সত্য গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। এ মহত্ গুণটি বিনষ্ট হওয়ার কারণ অসতর্কতা। এমন এক অসতর্ক কালো ঘুমে পতিত হয়ে একদা মুসলমানরা আমানতগুণ হারিয়ে ফেলবে। হজরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দুটো বিষয় বলে গেছেন। এর মধ্যে একটা তো চোখের সামনেই বাস্তবায়িত হতে দেখলাম এবং অপরটা কখন বাস্তব হয়ে সামনে আসবে সেই অপেক্ষা করছি। প্রথম হাদিস খানায় রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের বলেছিলেন, আমানত প্রথমে মানবহৃদয়ের গভীরে অবতারণ করা হয়। অতঃপর তারা কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে এ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত হয়। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের জ্ঞাত করলেন কীভাবে আমানত মানুষের হৃদয়-মন থেকে সরে যাবে। তিনি বললেন, মানুষ ঘুমিয়ে পড়বে এবং এ অসতর্ক মুহূর্তেই তাদের অন্তর থেকে আমানত উঠিয়ে নেওয়া হবে। তবে অন্তরের মধ্যে এর কিছুটা চিহ্ন ত্বকের ওপর তিল চিহ্নের মতো অবশিষ্ট থাকবে। এরপর আবারও মানুষ নিদ্রিত হবে এবং সে অসতর্কতার মধ্যে অবশিষ্ট চিহ্নটুকুও সরিয়ে নেয়া হবে। তখন পায়ের পাতায় ফোস্কা পড়লে পর যেমন তার কিছুটা চিহ্ন অবশিষ্ট থাকে, ঠিক তেমনি আমানত নামটিই শুধু থাকবে। লোকজন ক্রয়-বিক্রয় করবে, কিন্তু তাতে কেউ আমানতের তোয়াক্কা করবে না। লোকমুখে শোনা যাবে যে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার ব্যক্তি রয়েছেন। অপরদিকে এমন লোককে চালাক-চতুর এবং ধীমান বলে প্রশংসা করা হবে, যার অন্তরের মধ্যে সরিষা পরিমাণও ঈমান নেই (বুখারি-মুসলিম)। একের পর এক অন্যায় অনাচারের প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকবে। তবে এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা জঘন্য হবে ভ্রান্ত নেতৃত্ব; যা সাধারণ মানুষকে দীনের পথ থেকে সরিয়ে চরম অন্ধকারে নিয়ে ফেলবে। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হবে দীনদার মুসলমানদের জামাতের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে রাখা। যদি এমন কোনো আদর্শ জামাতের অস্তিত্ব তালাশ করে পাওয়া না যায়, তবে সমাজবিচ্ছিন্ন নিরিবিলি জীবনযাপন করাই হবে শ্রেয়তর।
সাহাবি হজরত হুযাইফার (রা.) বর্ণনা—রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে লোকেরা সাধারণত অনাগত দিনের কল্যাণকর দিকগুলোর কথাই বেশি জিজ্ঞাসা করত। আর আমি জানতে চাইতাম অকল্যাণকর দিকগুলো সম্পর্কে এ আশঙ্কায় যে পাছে সেগুলো আমার ওপর এসে পতিত না হয়।একবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), জাহেলিয়াতের যুগে আমরা অন্যায়-অনাচারের মধ্যে ডুবে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহতায়ালা আমাদের আজকের এ কল্যাণময় অবস্থায় এনে উপনীত করেছেন। এ কল্যাণের পর কি নতুন কোনো অনাচার আসার সম্ভাবনা রয়েছে?
জবাব দিলেন—হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—সে অনাচারের পর কি আবার কল্যাণ আসবে? বললেন-হ্যাঁ, তা আসবে। তবে সে কল্যাণকর অবস্থার মধ্যে কিছুটা আবর্জনার সংমিশ্রণ থাকবে।
আমি আরজ করলাম—কী ধরনের আবর্জনা? জবাব দিলেন—লোকজন আমার আদর্শ ছেড়ে অন্য আদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করবে। আমার দেখানো পথ ছেড়ে অন্য পথ প্রদর্শন শুরু হয়ে যাবে। সে সবের কিছু অংশ পরিচিত মনে হলেও অনেক কিছুই তোমাদের নিকট অপরিচিত বলে বিবেচিত হবে।আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম—ওই ভালো সময়টির পর কি আরও কোনো মন্দ দিন আসার সম্ভাবনা রয়েছে ?বললেন—এমন কিছু প্রচারকের প্রাদুর্ভাব হবে, যারা লোকজনকে জাহান্নামের দরজার দিকে ডাকতে থাকবে। যারা ওদের ডাকে সাড়া দেবে, তারা দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।আমি আরজ করলাম—ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) আমাদের ওদের স্বরূপ বলে দিন। হুজুর (সা.) বললেন—ওরা আমাদেরই বংশধারার উত্তরাধিকারী হবে এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি আরজ করলাম—যদি সে পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পতিত হই তবে আমার সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী হবে? বললেন—মুসলমানদের জামাতের মধ্যেই দৃঢ়পদ এবং তাদের নেতার অনুগত থাকবে। আমি বললাম, যদি মুসলমানদের কোনো জামাত বা নেতা না থাকে, তবে কী করব?বললেন—এমতাবস্থায় ওই সব ফেরকা ও উপদল থেকে দূরে থাকবে, যদি তোমাকে কোনো বৃক্ষমূল দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকতে হয় তবুও মৃত্যু পর্যন্ত এভাবেই পড়ে থাকবে (বুখারি মুসলিম)।
মুসলিম শরীফের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে—রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন—আমার পর এমন নেতৃত্বের প্রাদুর্ভাব হবে, যারা আমার দেখানো পথে অন্যদের চালাবে না, আমার আদর্শও অনুসরণ করবে না। এদের মধ্যে এমন লোকও হবে যাদের মানবাকৃতি বিশিষ্ট দেহের মধ্যে হৃদয়-মন থাকবে শয়তানের।হজরত হুযাইফা (রা.) বলেন—আমি জিজ্ঞেস করলাম, এমন লোকের মধ্যে পতিত হলে আমি কী করব? জবাব দিলেন—মুসলিম নেতৃত্বের অনুগত থাকবে, তাদের কথা মতো চলবে; যদি বেত্রাঘাতে তোমার পৃষ্ঠদেশ ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়া হয়, তবুও।এমন দুঃসময় উপস্থিত হবে, যখন মানুষ সামান্য স্বার্থের জন্য দীন-ঈমান বিক্রয় করে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। একমাত্র দীনের ওপর দৃঢ়ভাবে আমল করার মাধ্যমেই সে সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন—রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা আমলের প্রতি দ্রুত অগ্রসর হও সেই সমস্ত বিপর্যয় আসার আগে যেগুলো হবে অন্ধকার রাতের কোনো অংশের মতো। তখন সকালবেলায় হয়ত কেউ মুমিন থাকবে, আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কাফের হয়ে যাবে। আবার সন্ধ্যায় হয়ত কেউ মুমিন থাকবে, কিন্তু সকালবেলায় সে কাফেরে পরিণত হবে। এসব লোক দীন-ঈমানকে দুনিয়ার সামান্য কিছু সামগ্রীর বিনিময়ে বিক্রি করে দেবে। এরই সঙ্গে এলেম চলে যাবে। লোভের প্রাবল্য ঘটবে। সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, এমন সময় ঘনিয়ে আসছে, যখন ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে। চারদিকে ফেতনা ব্যাপক আকারে আত্মপ্রকাশ করবে। লোকের মনে লোভ এবং কার্পণ্য বাসা বাঁধবে। আর চারদিকে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে (বুখারি-মুসলিম)।
হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক ছড়াছড়ি হবে। একজন আরেকজনকে কেন হত্যা করছে কিংবা নিহত ব্যক্তি কোন অপরাধে নিহত হলো তাও বোঝার কোনো উপায় থাকবে না।সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন—রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমার প্রাণ যার হাতে সেই সত্তার শপথ করে বলছি, মানুষের ওপর এমন একটা দুর্দিন আসার আগ পর্যন্ত দুনিয়া ধ্বংস হবে না, যখন একজন হত্যাকারী বুঝতে পারবে না, কেন সে এ লোকটিকে হত্যা করল। অনুরূপ নিহত ব্যক্তিও নির্ণয়করতে পারবে না,কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো। জিজ্ঞেস করা হলো—এমন একটা অবস্থা কেমন করে হবে? বললেন—পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়েই জাহান্নামী হবে (কারণ যে নিহত হবে সেও অন্যকে হত্যা করার লক্ষ্য নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছিল) (মুসলিম শরীফ)। ফেতনা যখন ব্যাপক আকার ধারণ করবে, কোনো পক্ষ সত্যের ওপর রয়েছে, এটাও নির্ধারণ করা সম্ভবপর হবে না,তখন নিরিবিলিতে এবাদত করাই হবে নিরাপদ থাকারএকমাত্র পথ। সাহাবি হজরত মাকাল ইবনে ইয়াছার (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন—ব্যাপক হানাহানির অবস্থায়ও যে ব্যক্তি এবাদত-বন্দেগিতে মশগুলথাকতে পারবে সে যেন হিজরত করে আমার নিকট চলে এলো (মুসলিম শরীফ)।
উম্মতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর বিপর্যয় সৃষ্টি করবে পথভ্রষ্ট নেতারা। এদের প্ররোচনায় যখন রক্তপাত শুরু হবে তখন কেয়ামত পর্যন্ত তা আর বন্ধ হবে না। একটি দুর্ঘটনা আরেকটি দুর্ঘটনার জন্ম দিতে থাকবে। সাহাবি হজরত ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন—রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আমার উম্মতের জন্য ভয় করি পথভ্রষ্ট নেতাদের জন্য (ওরা উম্মতকে ধ্বংসের পথে পরিচারিত করবে)। আমার উম্মতের মধ্যে একবার যখন তরবারি পতিত হবে,তখন সেটি আর কেয়ামতপর্যন্ত কোষবদ্ধ হবে না (আবু দাউদ,তিরমিযী)।এক সময় মুসলমানদের নেতৃত্ব মেধাহীন বাজে লোকের করায়ত্ব হয়ে যাবে। ভালো-মন্দের তফাত্ চলে যাবে। তখন সমষ্টিগত কোনো কাজ করা বিপজ্জনক হয়েদাঁড়াবে?সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আস (রা.) এর বর্ণনা- রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তখন কী করবে, যখন তুমি মেধাহীন বাজে লোকদের কর্তৃত্বের মধ্যে গিয়ে পড়বে? ওরা ওদের অঙ্গীকার এবং আমানত নিজেরাই তছনছ করে ফেলবে। এরা পরস্পরবিরোধে লিপ্ত হয়ে পড়বে।হজরত আবদুল্লাহ (রা.) আরজ করলেন—এমতাবস্থায় আমার প্রতি কী নির্দেশ ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)? বললেন—তোমার স্বচ্ছ বিবেক যা সত্য বলে মনে করে সেটি ধারণ করবে এবং যা অন্যায় বলে বিবেচিত হয় সেটি পরিহার করে চলবে। অন্যায় থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে, নিজেকে লোকজন থেকে দূরে এবং সর্বাবস্থায় মুখসংযত রাখবে (তিরমিযী)।
যাদের শক্তি আছে তাদের কর্তব্য হবে, ফেতনার সময় শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং নিজেকে নিশ্চিত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে হলেও ফেতনা প্রতিহত করার জন্য সচেষ্ট হওয়া। আর যাদের শক্তি নেই, তাদের কর্তব্য হবেনিজেকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখা যেন লোকালয়ের কোলাহল তাকে স্পর্শ করতে না পারে।
উম্মে মালেক বাহজিয়্যা (রা.) নাম্মী এক মহিলা সাহাবি বর্ণনা করেন—একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সামনে সম্ভাব্য ফেতনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) এরূপ ফেতনার সময় সর্বোত্তম লোক কারা হবে? বললেন, এমনসব লোক যারা পশুপালের মধ্যে থেকে ওগুলির পরিচর্যা এবং এতদসঙ্গে আল্লাহর এবাদত করতে থাকবে। অন্য আরেক শ্রেণীর লোক যারা অশ্বের লাগাম ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এতে শত্রুরা তাকে দেখে ভয় পাবে এবং সেওফেতনা সৃষ্টিকারী শত্রুর হুমকিতে ভীত হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব পালন করে যাবে(তিরমিযী)। ফেতনার যুগ শুরু হওয়ার পর বাকসংযম অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়বে। কারণ অনাচারবিস্তারের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন বক্তব্য নিতান্ত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনএমন একটা ফেতনা আসবে, যা দ্বারা সমগ্র আরব প্রভাবান্বিত হবে। এতে যারা নিহত হবে তাদের সবাই হবে জাহান্নামি। এ সময় মানুষের জিহবা তরবারির আঘাতের চাইতে অনেক বেশি তীক্ষ্ম এবং মারাত্মক বলে বিবেচিত হবে (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
ফেতনায় পতিত না হওয়াটা হবে প্রকৃতই সৌভাগ্যের ব্যাপার। অপরপক্ষে যারা দুর্ভাগ্যবশত এতে পতিত হয়েও ছবর করবে এবং নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে তাদেরও ভাগ্যবানই বলতে হবে।সাহাবি হজরত মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.) বর্ণনা করেন—আমি এ কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি যে নিশ্চিতরূপে সেই ব্যক্তি হবে ভাগ্যবান, যে ফেতনা এড়িয়ে থাকতে পারবে। (কথাটা তিনবার বললেন) আর যে ব্যক্তি ফেতনায় পতিত হয়েও সবর করতে পারবে। যারা ফেতনায় গিয়ে পতিত হবে,তারা হবে নিতান্তই আক্ষেপের পাত্র (আবু দাউদ)।শেষ জামানার মুসলমানদের একটা জনগোষ্ঠী মূর্তিপূজক মুশরেকদের সঙ্গে মিশেযাবে। অতঃপর তারা প্রকাশ্যে মূর্তিপূজা করতে থাকবে। এর মধ্যে আবারনবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারেরও আবির্ভাব ঘটবে। সাহাবি হজরত ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন—সে পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যে পর্যন্ত না আমার উম্মতেরই একটা জনগোষ্ঠী মুশরেকমূর্তিপূজকদের সঙ্গে গিয়ে হাত মেলাবে। এমনকি একটি জনগোষ্ঠী প্রকাশ্য মূর্তিপূজা শুরু করে দেবে। আমার উম্মতের মধ্যে পরপর এমন ত্রিশটি মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে, যারা নিজেদের নবী বলে প্রচার করবে। অথচ আমিই খাতেমুন নবীইন, অর্থাত্ শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। আমার উম্মতের মধ্যে অন্তত একটা দল সব সময়ই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা প্রবল থাকবে। বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। এ অবস্থায়ই কেয়ামত এসে উপনীত হবে (আবু দাউদ, তিরমিযী)।
লেখক : সম্পাদক মাসিক মদীনা