সমস্ত প্রশংসা সে মহান আল্লাহর দরবারে যিনি আমাদের সৃষ্টি করে হালাল রিযকের ব্যবস্খা করেন। দরূদ ও সালাম প্রিয় নবীর প্রতি যাঁকে আমাদের প্রতিটি কর্মের জন্য আদর্শ বানানো হয়েছে।
আল্লাহর বান্দাগণ
আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করুন, ইসলামকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করুন এবং জেনে রাখুন আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করলে পরকালে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এজন্য বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ করা ও তা অতি শীঘন্স আমাদের আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরপারের দিকে পাড়ি দেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ আমাদের বিভিন্ন প্রকার নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন, যা গণনা করে শেষ করা যায় না এবং যার বিনিময় প্রদান করাও অসম্ভব। বান্দা প্রতি মুহূর্তে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি প্রদান করলে সর্বত্র মহান আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের নিদর্শনই দেখতে পায়। এ মর্মে ইরশাদ হচ্ছে: “আর পৃথিবীতে সব বিচরণকারীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন, তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়।” (সূরা হুদ, ৬)
মহান আল্লাহ তাঁর মাখলুককে সৃষ্টি করে তাদের রিযকের ব্যবস্খা করেন, কোন প্রাণীকেই তিনি রিযক থেকে বঞ্চিত করেন নি। বান্দা তার আহারের যে পরিমাণই তার মুখে পুরতে চেষ্টা করুক না কেন তা কিন্তু আসমান যমীন সৃষ্টির বহু পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছে। মহান আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তার রিযক বৃদ্ধি করেন ও বিভিন্ন প্রকার নিয়ামত প্রদান করে তাকে ধন্য করেন, তন্মধ্যে ধন-সম্পদ,পরিবার পরিজন ও তার সামাজিক বিভিন্ন অবস্খা অন্যতম। মহান আল্লাহর নিয়ামত অনেক বরকতময়। তার রহমত ও দয়া সমগ্র সৃষ্টিকে বেষ্টন করে রয়েছে। তাঁর দয়া ও রহমত কেউ বন্ধ করতে সম নয় তেমনি তাঁর করুণা বঞ্চিতদের কেউ জোরপূর্বক তাঁর থেকে করুণা আদায় করতেও অক্ষম।
মহান আল্লাহর এ বরকত দ্বারা উদ্দেশ্য হল নির্ধারিত পরিমাণ জিনিসে অতি বেশি বরকত অর্জন। আর তা অর্জনের মাধ্যমে বান্দাহর অবস্খার পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তাই বরকতের এ ধারণাটি সম্পর্কে সুýপষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কারো কম জিনিসকে আল্লাহ অতি দন্সুত বৃদ্ধি করে দেন, তেমনিভাবে অন্যের ছোট কিছুকে অল্প সময়ে বড় করে দেন। আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দার এসব নিয়ামতে বৃদ্ধির পোষণ করলে তার জন্য বেশি অর্জনের সব পথ উন্মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহর রহমত বরকত অর্জনের সবচেয়ে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে বান্দাহর আল্লাহভীতি। তাকওয়া অর্জনই আল্লাহর পক্ষথেকে বান্দার উপর অশেষ নিয়ামত বর্ষণে ভাল ভূমিকা পালন করে থাকে। এ মর্মে আল্লাহ ইরশাদ করেন: “আর যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।” (সূরা আল আনফাল, ৯৬)
এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় বান্দার সার্বিক কল্যাণ ও বরকত সবকিছু আল্লাহভীতির উপরই নির্ভর করে থাকে। আল্লাহকে যথার্থ ভয়কারীদের বিপদাপদ অনেক ক্ষেত্রে তিনি সহজতর করে দেন ও অভাব অভিযোগ ও সংকীর্ণতা দূরীভূত করেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মনের অজান্তেই আল্লাহ সহায়তা করে থাকেন। তাই মুত্তাকীদের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা তাদের খুব বেশি সমস্যায় জর্জরিত করে না। তাদের জীবনাচার হয় সহজতর ও সরল।
সম্মানিত উপস্খিতি
আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বরকত অর্জনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হল মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য সহযোগিতা কামনা করা। তিনিই একমাত্র দাতা দয়ালু ও তাঁর কাছেই বান্দাহ একমাত্র সাহায্য কামনা করা উচিত। তাই বান্দা যখনই রিযিক সহ যে কোন প্রকার সংকীর্ণতা অনুভব করে তখনই তার কর্তব্য হল আল্লাহর দরবারে ধরনা দেয়া, তাঁর নিকট কাকুতি-মিনতি সহকারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করা, তিনি কাউকেও একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। আমি মহান আল্লাহর নিকট সার্বিকভাবে প্রার্থনা করি, তিনিই আমাদের একমাত্র দাতা ও দয়ালু। তাঁর কাছে প্রার্থনা করে একেবারে খালি হাতে ফিরেছে সাধারণত এমনটি দেখা যায় না। এ ব্যাপারে প্রিয় নবীর একটি হাদিস আমাদের হিদায়াত প্রদানে উত্তম ভূমিকা পালন করে থাকে। একদা নামাজের সময় ব্যতীত মসজিদে প্রবেশ করে জনৈক সাহাবীকে মসজিদের এক কোণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্খায় দেখতে পেয়ে দয়ার নবী তাকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু উমামা! এ অসময়ে তুমি কেন এখানে বসে আছ? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল, আমি বড় ধরনের ঋণের কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আছি, যা আমাকে দিনের বেলা মানুষের সামনে লজ্জিত করে ও রাতে ঘুমের বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এ কথা শন্সবণ করে রাসূল (স) তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এমন একটি বাণী শিা দেব না যা তুমি চর্চা করলে আল্লাহ তোমার দুশ্চিন্তা ও ঋণের বোঝা লাঘবে সহায়ক হবে? আবু উমামা (রা:) বলেন, অবশ্যই তা আপনি আমাকে শিক্ষা দেবেন। তখন রাসূল (স) বললেন, তুমি সকাল সন্ধ্যায় বলবে, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকামিনাল হাম্মেওয়াল হুযনে, ওয়া আউযুবিকা মিনাল আজযে ওয়াল কাসালে, ওয়া আউযুবিকা মিনাল জুবনে ওয়াল বুখলে, ওয়া আউযুবিকা মিন গালাবাতিদ দায়নে ওয়া কাহরির রিজাল।” অর্থাৎ “হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা হতে আশন্সয় প্রার্থনা করছি, আমি তোমার নিকট দুর্বলতা ও অলসতা হতে আশন্সয় কামনা করছি, তোমার নিকট কাপুরুষতা ও কৃপণতা হতে নাজাত কামনা করছি এবং তোমার নিকট ঋণভার ও মানুষের দুষ্ট প্রভাব হতে পরিত্রাণ চাচ্ছি।” আবু উমামা বলেন, অত:পর আমি ঐরূপ আমল করি, যার ফলশন্সুতিতে আল্লাহ তায়ালা আমার চিন্তা-ভাবনা বিদূরিত করেন এবং ঋণ পরিশোধের ব্যবস্খা করে দেন।
সূরা আল ফাতিহায়ও আমরা এ ধরনের প্রার্থনা করে থাকি, যেমন বলে থাকি, “আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” (সূরা আল ফাতিহা, ৫) আল্লাহ তায়ালা যখনই ঋণগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের মেহেরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করেনও মুক্ত করতে চান তখনই তাদেরকে দোয়া শিক্ষা দেন, তার মনকে আল্লাহর প্রতি বিনয়ী হতে ও তার নিকট যাâঞা করতে অনুপ্রাণীত করেন, আকাশ-যমিনের খাজাঞ্চী একমাত্র তাঁরই হাতে নিবন্ধ। আল্লাহর প থেকে বরকত ও রিযক হাসিল করার আর একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক রা করা। এদিকটির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে আল্লাহর রাসূল (স) ইরশাদ করে, “যে ব্যক্তি নিজের রিযক প্রশস্ত হওয়া এবং নিজের আয়ুüকাল বৃদ্ধি হওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।” (বুখারী শরীফ)
তাই আত্মীয়তার হক্ক আদায় করা ও তাদের সাথে সুসম্পর্ক জোরদার করা আল্লাহর দয়া পাওয়ার অন্যতম কারণ বিধায় আমাদের চাচা-চাচী, খালা-খালু সহ নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক উন্নততর করা আবশ্যক। যারা তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে আল্লাহও তাদের প্রতি রহমত বরকত নাযিল করবেন ও তাদের রিযক বৃদ্ধি করে দেবেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি আবশ্যকীয়ভাবে রহমত বরকত লাভের আরো একটি অন্যতম উপায় হল সমাজের দুস্খ, অভাবী ও নি:স্বদের প্রতি সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করা। ইহকালে যে ব্যক্তি অভাবীদের প্রতি সহযোগিতা করবে মহান আল্লাহ ইহ ও পরকালীন উভয় জগতে তাদের প্রতি সহযোগিতা প্রদান করবেন। তেমনিভাবে ইহকালে বিপদগ্রস্তদের প্রতি যে ব্যক্তি সহানুভূতিশীল হবে আল্লাহ উভয় জগতে তার বিপদকালীন সময়ে সহযোগিতা প্রদান করেন। তাই সমôানিত উপস্খিতি, আপনারা আল্লাহর বান্দাগণের প্রতি দয়ার্দন্সচিত্ত হোন, আসমানবাসী ফেরেশতাগণ আপনাদের প্রতি রহমতের দোয়া করতে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের দয়াশীলতার প্রতি বেশি রহমত বরকত ও দয়া করে থাকেন। আল্লাহর রাসূল (স) বলেন, “প্রতিদিন সকালে দু'জন ফিরিশতা অবতরণ করেন, তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।” (বুখারী শরীফ)
আদম সন্তানগণ
আমাদের সমাজের অভাবীদের প্রতি মুক্ত হস্ত হওয়া দরকার, তাহলে আল্লাহ তায়ালাও আমাদের প্রতি রহম করবেন ও আসমানবাসী ফিরিশতাগণও আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণের জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন করবেন। তাই বিপদগ্রস্ত সৃষ্টির বিপদমুক্তিতে এগিয়ে আসুন, বিধবা ও অভাবীদের প্রতি সহনশীল ও দয়ার্দন্সচিত্ত হোন, আল্লাহ তায়ালাও তাঁর অসীম রহমত নিয়ে আমাদের প্রতি সাহায্য করবেন। প্রিয় নবী তাঁর কন্যাকে এ প্রসঙ্গে উপদেশ প্রদান করত বলেন, “হে আসমা, তুমি খরচ কর, আল্লাহ তোমার তাওফিক বাড়িয়ে দেবেন, আর গুণে রেখ না তাহলে আল্লাহ তোমাকে গুণে গুণে দেবেন।” (মুসলিম শরীফ)
এতে প্রতীয়মান হয় দান করার েেত্র আন্তরিকতাই বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ইচ্ছা করে দান করলে প্রতিটি দানের সওয়াব দশ থেকে সাতশত গুণ তথা আল্লাহর যত ইচ্ছা হয় তার প্রতিদান বৃদ্ধি করে দিয়ে থাকেন। পরকালে তার জন্য থাকবে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা। মুসলিম মিল্লাতের এ কথা কখনো ভুলে থাকা উচিত নয় যে, দান-খয়রাত ও সাদকাহ দ্বারা সম্পদের ঘাটতি বা কমতি হয় না। রাসূল (স:) ও তৎপরবর্তীকালে মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক অবস্খা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। তাঁরা মহান আল্লাহর যথাযথ হিদায়াতপ্রাপ্ত অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালার বিশেষ মেহেরবানীতে তাদের সার্বিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় ও তাঁরা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে বিশেব ইসলাম প্রচারে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তাঁরা ওহীর জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে ও নিজেদের সে রঙে রঙীন করাতে মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। ফলে তাদের প্রতি বিভিন্নভাবে তাঁর অপার কৃপা বর্ণণ করতে থাকেন। তাদের সামান্য আয়োজনেও আল্লাহ বরকত প্রদান করে তাদের ধন্য করেন।
মানুষের রিযক ও হায়াত বৃদ্ধির আরো একটি বিশুদ্ধতম উপায় হচ্ছে তারা বৈধ পন্থায় আয়-রোজগার করবে। কেননা ইসলাম কর্মের ধর্ম। বেকারত্ব ও অলসতাকে কখনোই সমর্থন করে না। কর্ম করে আহারের সংস্খান করতে ইসলাম বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। অন্যের উপর দারস্খ ও বোঝা হয়ে থাকাকে ইসলাম কখনোও পছন্দ করে না। আর বৈষয়িক উন্নতির ল্েয যারা অন্যের নিকট হাত পাতে তাদের মুখাবয়বে কিয়ামতের দিন মাংস থাকবে না বলে আমাদের প্রিয় নবী (স:) সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন। পবিত্র কুরআন রিযক অনেবষণ ও বিজ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে মুমিনদের নির্দেশ প্রদান করে ইরশাদ হচ্ছে: “তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযক আহার কর।” (সূরা আল মূলক, ১৬০)
মহান আল্লাহ পৃথিবীকে সমতলভাবে সৃষ্টি করে তথায় নানারকম কল্যাণ ও বরকতের অমিয় ধারার সূচনা করেন ও কর্মের মধ্যে কল্যাণ ও অলসতায় অকল্যাণের ইঙ্গিত প্রদান করেন। তেমনিভাবে ইসলাম সংগ্রাম ও কর্মের ধর্ম। তাই আমাদের জীবন পরিচালনার সর্বেেত্র প্রচেষ্টা করতে ও বৈধভাবে আয়-উপার্জন করতে উৎসাহ প্রদান করে। ইসলামের দৃষ্টিতে রিযক অনেবষণের অর্থ এই নয় যে, মুসলমান মসজিদে বসে থাকবে আর তার নিকট আল্লাহর প থেকে রিযক আসতে শুরু করবে। রিযকের এ ধারণা বৈরাগ্যবাদ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ইসলাম বৈরাগ্যবাদ সমর্থন করে না। কেননা আল্লাহর প থেকে কখনো আসমান সোনা-চাঁদির বৃষ্টি বর্ষণ করেন না। তাই রিযক অনেবষণের নিমিত্তেও বিভিন্ন উপায় উপকরণের মাধ্যমে বৈধ পথে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাহলেই কেবল তিনি তার রহমত থেকে তাদের ধন্য করবেন। এজন্য ইসলাম ঐ সমস্ত লোকদের সমôানিত বিবেচনা করে যারা প্রচেষ্টা চালিয়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আহারের সংস্খান করে। এ প্রকার লোকদের প্রচেষ্টাকে মহান আল্লাহ পূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করবেন। ইসলাম কর্মকে লজ্জা মনে করে না। যুগে যুগে আল্লাহর নবীগণ কর্ম করে নিজেদের আহারের যোগান দেয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের একজন হযরত দাউদ (আ:) কঠিন লৌহ দ্বারা অস্ত্র তৈরির পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে কামারের কাজ ও কাঠমিস্ত্রির কাজের মত কঠিন কাজ করাও কোন লজ্জার বিষয় নয়; বরং লজ্জার বিষয় হল মানুষ আল্লাহর নিষিদ্ধ কার্যাবলী করে থাকা, অলসতা, বেকারত্ব ইত্যাদি ন্যাক্কারজনক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। তাই আমাদের বৈধ আয়ের পথে সার্বিক প্রচেষ্টা করা উচিত। যারা সঠিকভাবে হালাল পথে মেহনত করে যাবে আল্লাহ তাদের কখনো সংকীর্ণ অবস্খায় পতিত হতে দেবেন না। এ মর্মে প্রিয় নবী (স:)-এর একটি হাদিস প্রণিধানযোগ্য, তিনি ইরশাদ করেন, “যদি তোমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার হক আদায় করতে, তবে তিনি পাখিকে রিযক দেয়ার মতই তোমাদেরকেও দিতেন। পাখি তো সকালে খালি পেটে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে।” (তিরমিযী)
উপরোক্ত বিষয়গুলো আমাদের ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। পরকালে মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের সবাইকে হাযির হতে হবে। ঐ দিনের সম্বল অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করত আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্যে সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।” (সূরা আল হাশর, ১৮)
মহান আল্লাহ আমাকে ও আপনাদের পবিত্র কুরআন থেকে বরকত ও উপকৃত হবার তাওফিক দিন। কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর নিদর্শনাবলী, বিজ্ঞময় উপদেশ এবং প্রিয় নবী (স:)-এর হিদায়াত থেকে আমাদের সবাইকে উপকৃত করুন। একথাগুলোর পর আমি আমার নিজের ও আপনাদের সবার জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। আপনারাও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মদ সা:, সাহাবীগণ, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনুসারীগণের উপর। প্রিয় পাঠক, আর মাত্র কয়েকদিন পর অসংখ্য নিয়ামত ও সুসংবাদের বার্তা নিয়ে আমাদের দরজায় নক করবে পবিত্র ও বরকতময় মাস রমজান। রমজানের আগমনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনন্দিত হয়ে সাহাবীদেরকে বলতেন, “তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমজান এসেছে, যার সিয়াম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন। (সুনান নাসায়ী: ২০৭৯) কাজেই আমাদের জন্য আবশ্যক এ বরকতময় মাসের ফযিলত, গুরুত্ব ও তাতে আমাদের কি করণীয় তা জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
রমজান মাসের মর্যাদা ও ফযিলত:
১· কুরআন অবতীর্ণের মাস: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য।” (সূরা বাকারা- ১৮৫)
২· ইসলামের বিজয়ের মাস: দ্বিতীয় হিজরীতে এ মাসের ১৭ তারিখে বদরের যুদ্ধ হয়েছিল এবং মুসলমানগণ তাতে অকল্পনীয় বিজয় লাভ করেন। অনুরূপ অষ্টম হিজরীর ২০ রমাদানে রাসূলুল্লাহ স· মক্কা বিজয় করেন।
৩· বরকতময় মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমজান এসেছে, যার সিয়াম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন।” (সুনান নাসায়ী: ২০৭৯)
৪· গুনাহ মাফের মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “এক রমজান তার পূর্ববর্তী রমজানের মধ্যবর্তী সময়ের সকল সগীরা গুনাহ মিটিয়ে দেয়।” (সহীহ মুসলিম: ৩৪৪)
৫· কদরের রাতবিশিষ্ট মাস: এ মাসে রয়েছে কদরের রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ বলেন, “কদরের রাত, হাজার মাস থেকেও উত্তম।” (সূরা কদর: ৩)
৬· সবরের মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “সবরের মাসে সাওম পালন ও প্রত্যেক মাসে তিনদিন সাওম পালন অন্তরের অস্খিরতা দূর করে।” (মুসনাদ আহমাদ: ৭২৬১)
৭· জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত এবং জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধের মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যখন রমজান আগমন করে তখন খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাসমূহ এবং বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের প্রবেশ পথগুলো। আর শৃকôখলিত করা হয় শয়তানদের।” (সহীহ মুসলিম: ১৭৯৩)
৮· জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস: এ মাসে আল্লাহ তাঁর অসংখ্য বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন “এ মাসের প্রত্যেক রাতেই আল্লাহ তার কতিপয় বান্দাহকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।” (সুনান তিরমিযী: ৬১৮)
৯· দশমাস সাওম পালনের সমপরিমাণ সাওয়াব বিশিষ্ট মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “রমজান মাসের সিয়াম দশ মাসের সমতূল্য এবং শাওয়ালের ছয় দিনের সিয়াম দুই মাসের সমতুল্য। এ যেন সারা বছরের সিয়াম।” (মুসনাদ আহমাদ: ২১৭৮)
১০· কল্যাণের প্রতি আহ্বানের মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “এ মাসের প্রতি রাতেই আহ্বানকারী ঘোষণা দেয়, হে কল্যাণ কামনাকারী, কল্যাণের দিকে আস। হে অকল্যাণ কামনাকারী থেমে যাও।” (সুনান তিরমিযী: ৬১৮)
১২· সিয়াম পালনের মাস: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমজান এসেছে, যার সিয়াম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন।” (সুনান নাসায়ী: ২০৭৯) নিম্নে সাওমের হুকুম, ফযিলত ও সাওম সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হল।
সাওমের হুকুম
সাওম ফরয। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, হে মু'মিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা বাকারা: ১৮৩)
সাওমের ফযিলত
১· জান্নাতের একটি দরজা কেবল সাওম পালনকারীদের জন্য নির্দিষ্ট: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “সাওম পালনকারীদেরকে রাইয়ান নামক দরজা হতে ডাকা হবে।” (সহীহ বুখারী: ১৭৬৪)
২· জাহান্নামের আগুন থেকে রাকারী: সাওম রোযাদারের জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে ঢালস্বরূপ। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “তোমাদের কারোর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢালের ন্যায় সাওমও জাহান্নামের ঢালস্বরূপ।” সুনান নাসায়ী: ২২০০) অর্থাৎ সাওম জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে।
৩· কিয়ামতের দিনে বান্দার সুপারিশকারী: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “কিয়ামতের দিনে সাওম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে।” (মুসনাদ আহমাদ: ৬৩৩৭)
৪· ফিতনার কাফফারাস্বরূপ: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “কোন ব্যক্তির ফিতনা তার পরিবার, জান, মাল, সন্তান ও প্রতিবেশির মাঝে। যাকে মিটিয়ে দেয় সালাত, সাওম, সাদাকাহ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।” (সহীহ বুখারী ৪৯৪)
৫· এর প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দেবেন: হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, “কেবল সাওম ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য; সাওম আমার জন্য আমি নিজে এর প্রতিদান দিব।” (সহীহ বুখারী: ১৭৭১)
৬· সাওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যার হাতে আমার জীবন তার কসম, রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তা'আলার নিকট মিশকের ঘন্সাণের চেয়েও অধিক উত্তম।” (সহীহ বুখারী: ১৭৬১)
যাদের উপর সাওম ফরয
১· মুসলিম নর-নারীর উপর সাওম ফরয।
২· প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারী, অপ্রাপ্ত বয়স্কের উপর সাওম ফরয নয়।
৩· সুস্খ মস্তিüক সম্পন্ন নর-নারীর জন্য সাওম ফরয। পাগলের উপর সাওম ফরয নয়।
৪· মুকিম নর-নারীর উপর সাওম ফরয,মুসাফিরের উপর সাওম ফরয নয়।
৫· সামর্থ্যবান নর-নারীর উপর সাওম ফরয। কিন্তু সামর্থ্যহীন লোকের উপর সাওম ফরয নয়। যেমন অতি বার্ধক্যের কারণে যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না তার উপরও সাওম ফরয নয়। অনুরূপ যে অসুস্খতার কারণে সাওমের সামর্থ রাখে না। গর্ভবতী ও দুগ্ধদান কারী নারী নিজের ও সন্তানের তির আশঙ্কা করলে সাওম ছাড়তে পারবে। পরে কাযা আদায় করে নিবে।
৬· মাসিক বন্ধ এমন নারী: ঋতুকালীন সময়ে নারীর জন্য সাওম পালন নিষেধ। সে পরে কাযা করে নিবে।
সাওম ভঙ্গের কারণসমূহ
১· রোযার সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা। চাই তা স্বাস্খ্যের জন্য উপকারী হোক বা তিকর। যেমন ধুমপান, তামাক পান ইত্যাদি।
২· রোযা অবস্খায় যৌন মিলন ঘটানো। এতে কাযা ও কাফ্ফারা উভয়টি ওয়াজিব হয়।
৪· পানাহারের বিকল্প হিসেবে রক্তগ্রহণ, স্যালাইনগ্রহণ, এমন ইনজেকশন নেয়া বা আহারের কাজ করে, যথা- গ্লুকোজ ইনজেকশন ইত্যাদি নেয়া। অনুরূপ রক্তরণ মিটানোর জন্য ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রদান করা।
৫· ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি করলে তাতে সাওম ভঙ্গ হবে না।
৬· মহিলাদের হায়েজ (ঋতুসন্সাব) ও নিফাস (প্রসবজনিত ররণ) হওয়া।
সাওম ভঙ্গ হয় না এমন কতিপয় বিষয় যা অনেকের নিকট অýপষ্ট
১· ভুলবশত পানাহার বা স্ত্রী সহবাস করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেউ যদি রোযা অবস্খায় ভুলবশত: পানাহার করে সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে; কেননা আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।
২· শরীর বা কাপড়ে সুগন্ধি ব্যবহার করা। এমনকি নাকে মুখে ঘন্সাণযুক্ত তেল ব্যবহার করা। চোখে সুরমা ব্যবহার করা।
৩· রোযা অবস্খায় স্বপ্নদোষ হওয়া। এমনকি কারো প্রতি অসৎ দৃষ্টি নিেেপর কারণে বীর্যপাত ঘটা। অনুরূপ কোন রোগের কারণে উত্তেজনা ব্যতীত বীর্যপাত ঘটা।
৪· স্বাভাবিক কোন কারণে যেমন কেটে যাওয়া, দাঁত উঠানো, নাকের রোগ ইত্যাদিতে রক্ত বের হলে রোযা ভাঙ্গবে না।
৫· স্বামী-স্ত্রী চুম্বন- আলিঙ্গন। তবে শর্ত হল বীর্যপাত না ঘটা। আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা অবস্খায় তাকে চুম্বন করতেন এবং রোযা অবস্খায় আলিঙ্গন করতেন।” (সহীহ মুসলিম: ১৮৫৪।) তবে যে ব্যক্তি চুম্বন-আলিঙ্গনের পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না বলে আশংকা রয়েছে, তার জন্য এরূপ করা সঠিক হবে না।
৬· অপবিত্র অবস্খায় সকাল করা। এমনকি তাতে সারাদিন গড়িয়ে গেলেও সাওম নষ্ট হবে না।
৭· সাওম পালন অবস্খায় মিসওয়াক করা।
৮· খাবারের স্বাদ পরীা করার জন্য জিহ্বায় তার স্বাদ গ্রহণ করা। তবে তা যেন পেটে চলে না যায়।
৯· অসুস্খতার কারণে গ্যাস জাতীয় ýেপ্র ব্যবহার করা। ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন ব্যবহার করা।
১০· পরীার জন্য রক্ত প্রদান করা।
১১, কুলি করার সময় অনিচ্ছাকৃত মুখে পানি ঢুকে যাওয়া।
১২· সূর্য ডুবে গেছে অথবা ফজর এখনো হয়নি ভেবে পানাহার করা।
১৩· এমন ইনজেকশন নেয়া যা খাবারের সহায়ক নয়। যেমন পায়ুপথে ডুশ ব্যবহার করা অথবা রগে ইনজেকশন নেয়া।
রমজান মাসে আমাদের করণীয়
১· অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা: বছরের সব মাসেই অন্যায় থেকে বিরত থাকা জরুরী। কিন্তু রমজান যেহেতু বরকতময় মাস সেহেতু এ মাসে কোন অন্যায় করলে তা মারাত্মক হিসেবে গৃহীত হয়। তাছাড়া এ মাসে অন্যায় কাজ করলে তা সাওমের পুরোপুরি প্রতিদান লাভেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়।রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “কত সাওম পালনকারী রয়েছে যারা অনাহার ছাড়া আর কিছু পায় না।” (মুসনাদ আহমাদ: ৯৩০৮) অন্যত্র তিনি বলেছেন, “যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী: ১৭৭০)
২· উত্তম আচরণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করা: উত্তম চরিত্র হল মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সদাচরণের কারণে কোন ব্যক্তি যেমন প্রিয় হয়ে উঠে আল্লাহর নিকট তেমনি প্রিয় হয়ে উঠে জনগণের নিকট। রমজান মাসেও যেন আমরা আমাদের সেই আচরণে কেউ যেন কষ্ট না পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ খারাপ আচরণ করলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার না করে তাকে এড়িয়ে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “সাওম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সাওম পালনের দিনে অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল না করে। যদি তাকে কেউ গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে তখন সে যেন বলে‘আমি রোযাদার'।” (সহীহ বুখারী: ১৭৭১)
৩· অপচয় থেকে বিরত থাকা: অপচয় তা যে কোন বিষয়েই হোক ইসলামী শরিয়তে নিষিদ্ধ। অথচ রমজানের এ পবিত্র মাসে আমরা অনেকেই এ নিষিদ্ধ কাজে প্রতিযোগিতায় নেমে যাই। সাওম হল বৈধ ইচ্ছা-চাহিদাগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরকালমুখী নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের দীক্ষা নিয়ে তাকওয়া অর্জনে সম হওয়া। সমাজে যারা উপোস থাকে তাদের দু:খ-বেদনা অনুধাবন করা। কিন্তু আমরা এ মাসেই সবচেয়ে উন্নতমানের ও বেশি পরিমাণে খাবার খেয়ে থাকি। এ মাসের পানাহারের বাজেটটি হয় অন্যান্য মাস থেকে বেশি। আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করেছেন, “তোমরা খাও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আ'রাফ: ৩১) কাজেই পানাহারের ক্ষেত্রে আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
৪· দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে দেয়া: রমজান মাসে দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে আখিরাতমুখী কার্যকলাপের দিকে বেশি ধাবিত হওয়া। ইমাম মালিক (রহ·) রমজান মাস আসলে অন্যান্য কার্যকলাপ বন্ধ করে ইবাদাতে মশগুল হয়ে যেতেন। এমনকি তিনি দারস বন্ধ করে কুরআন তিলাওয়াতকে অগ্রাধিকার দিতেন। আমরা অনেকেই রমজান মাসকে অর্থ উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি এবং এর জন্যই বেশি সময় ব্যয় করি। তা ঠিক নয়। কাজেই যতটুকু না হলেই নয় তা করার পর আমরা আখিরাতমুখী কাজে লিপ্ত হয়ে যাই।
৫· বেশি বেশি দান-খয়রাত করা: হাদীস শরীফে এসেছে, “নবীজী স· ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল। তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন রমজান মাসে।” (সহীহ বুখারী: ৫)
৬· রাতের সালাত আদায় করা: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সাথে সাথে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আদায়েও পুরোপুরি মনোনিবেশ করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যে ঈমান ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানের রাতে সালাত আদায় করে তার অতীতের পাপসমূহ মা করে দেয়া হয়। (সহীহ বুখারী: ৩৬)
৭· কুরআনের অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা: রমজান কুরআন নাযিলের মাস। কাজেই এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা ও খতম দেয়া। হাদীসে এসেছে, সাওম ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। (মুসনাদ আহমাদ: ৬৩৩৭)
৮· তওবা করা: রমজান মাসে তাওবার অনুকুল অবস্খা বিরাজ করে। তাই এ মাসে তাওবা করে নিজেকে বিগত জীবনের সকল পাপ থেকে মুক্ত করে বাকী জীবন আখিরাতমুখী করে তোলা। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাসে পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক।” (সুনান তিরমিযী: ৩৪৬৮)
৯· উমরা আদায়: সামর্থ্য ও সুযোগ থাকলে রমজানে উমরা করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “রমজান মাসে উমরা আদায় আমার সাথে হজ্ব আদায়ের সমতূল্য। (সহীহ বুখারী: ১৭৩০)
১০· ইতিকাফ করা: রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফে বসা। ইবন উমার (রা:) বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন। (সহীহ বুখারী: ১৮৮৫)
১১· রোযাদারদের ইফতার করানো: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যে কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে রোযাদারের সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমবে না।' (সুনান তিরমিযী: ৭৩৫)
১২· বেশি বেশি দোয়া করা: রমজান রোযাদারের দোয়া কবুল হয়। তাই রমজান মাসে বেশি বেশি দোয়া করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “রমজান মাসে কৃত প্রত্যেক মুসলমানের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। (মুসনাদ আহমাদ: ৭১৩৮)
১৩· কদরের রাত্রি পাওয়ার উদ্দেশ্যে শেষ দশদিন বেশি বেশি আমল করা: আয়িশা (রা:) আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ যখন রমজানের শেষ দশকে পৌঁছতেন তখন লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন (প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন), রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদন্সা থেকে জাগিয়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী: ১৮৮৪)। তিনি আরো বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগীতে যে পরিশন্সম করতেন অন্য সময় তা করতেন না।' (সহীহ মুসলিম: ২০০৯)
২· সাহরীর খাবার হালকা হওয়া: নবীজী স· বলেছেন, “মু'মিনের উত্তম সাহরী হল খেজুর।” (সুনান আবু দাউদ: ১৯৯৮)
৩· দেরি করে সাহরী খাওয়া: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “তোমরা তাড়াতাড়ি ইফতার কর এবং দেরিতে সাহরী কর। (আসসিলসিলাতুস সহীহা: ১৭৭৫)
৪· সাহরীর সময়ে সালাত, দোয়া, যিকর, ইত্যাদি নেক আমল করা: সাহরীর সময়টি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ সময়। এ সময় আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “আমাদের রব তাবারাকা ওয়া তা'আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ! যে আমার নিকট দোয়া করবে আমি তার দোয়া কবুল করব। কে আছ! যে আমার নিকট চাইবে আমি তাকে দান করব। কে আছ! যে আমার কাছে মা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব।” (সহীহ বুখারী: ১০৭৭)
ইফতারের আদাবসমূহ
১· তাড়াতাড়ি ইফতার করা: সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে।” (সহীহ বুখারী: ২৮২১)
২· খেজুর অথবা তা না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করা: হাদীসে এসেছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।” (সুনান আবু দাউদ: ২০০৯)
৩· ইফতারের সময় দোয়া করা: ইফতারের সময়ের দোয়া কবুল হয়। হাদীসে এসেছে, তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়, ন্যায়পরায়ণ নেতা, রোযাদার যখন ইফতার করে, নির্যাতিত ব্যক্তি।” (সুনান তিরমিযী: ২৪৪৯)। ইবন উমার বলেন রাসূলুল্লাহ যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, ‘যাহাবায যামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল উরুকু, ওয়াছাবাতাল আজরু ইনশা আল্লাহ” অর্থাৎ পিপাসা নিবারণ হল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হল এবং প্রতিদান সাব্যস্ত হল ইনশাআল্লাহ (সুনান আবু দাউদ: ২০১০)
৪· রোযাদারকে ইফতার করানো: রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যে কোরা রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে রোযাদারের সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমবে না।” (সুনান তিরমিযী: ৭৩৫)
সাওম-এর শিক্ষা
১· আত্মসংযমের শিা: দীর্ঘ এক মাস সাওম পালন আমাদেরকে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, যৌনতা, ভোগ-বিলাস পরিহার করে আত্মসংযমের মাধ্যমে এক আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হতে সাহায্য করে।
২· সদাচারের শিক্ষা: শরীয়ত আমাদেরকে রোযা অবস্খায় অশ্লীল, অনর্থক,ধোকা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার বিধান জারী করে দিয়ে মানুষের সাথে সদাচরণ করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং এক মাসের এ আমলে তা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
৩· সহমর্মিতার শিক্ষা: সাওম আমাদের মাঝে অন্যের দু:খ-কষ্ট ও ব্যথা-বেদনা বুঝার অনুভূতি সৃষ্টি করে। দীর্ঘ সময় উপবাসের মাধ্যমে ুধার কি জ্বালা তা মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দেয়।
৪· পরিশন্সমী ও কর্মঠ হওয়ার শিক্ষা: সাওম মানুষের জড়তা, অলসতা, আরামপ্রিয়তা ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে ইবাদাত পালনের মাধ্যমে কর্মঠ ও পরিশন্সমী হওয়ারশিক্ষা দেয়। ইফতার, মাগরিবের সালাত, রাতের খাবার, তারাবীর সালাত, তাহাজ্জুদের সালাত, সাহরীর খাবার, ফজরের সালাত, জোহরের সালাত, আসরের সালাত ইত্যাদি আদায়ের মাধ্যমে আমরা পরিশন্সমী হয়ে উঠি।
৫· অপকর্ম বর্জনের শিক্ষা: সাওমের মূল শিাই হল, অপকর্ম বর্জন করা। রোযাদার তার দেহের প্রতিটি অঙ্গকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ স· বলেছেন, “যে মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার ত্যাগ আল্লাহর কোন কাজে আসবে না।” (সহীহ বুখারী: ১৭৭০)
রমাদান মাসে প্রচলিত কতিপয় বিদ'আত
১· “নাওয়াইতু আন আসুমা গাদাম” এ জাতীয় বাক্য পড়ে সাওমের নিয়ত করা। কারণ হাদিসে সাওমের নিয়তের জন্য এ জাতীয় কোন বাক্য পাওয়া যায়নি। নিয়ত শব্দের অর্থ হল, ইচ্ছা পোষণ করা। কাজেই ‘সাহরী খাওয়া', অথবা ঘুমানোর আগে আগামীকাল রোযা রাখবো এ ধরনের ইচ্ছাই হল রোযার নিয়ত। শরীয়ত নির্দেশ করেনি এমন কোন বাক্যকে নিয়তের জন্য নির্ধারিত করাই হল বিদ'আত।
২· তারাবীর সালাতে ৪ রাকাতের পর ‘সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুত” যে দোয়াটি পড়া হয় তাও বিদ'আত। রাসূলুল্লাহ স· বা কোন সাহাবী এ ধরনের দোয়া পড়েছেন বলে হাদীসে পাওয়া যায়নি।
৩· ইতফারের নির্দিষ্ট সময় থেকে সতর্কতামূলকদেরি করা। অনুরূপ সাহরীতেও সতর্কতামূলক বেশ আগে খেয়ে ফেলা। কারণ হাদীসে এর বিপরীত আমল পাওয়া যায়।
৪· রোযা রাখার কারণে সম্পূর্ণরূপে কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা।
৫· সপ্তম রাতে বা তার আগে তারাবীর শেষ রাকাতে বিশেষ ফযিলতের উদ্দেশ্যে সূরা আন'আম পুরোটি পড়া।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রমজান মাস ও সাওম দু'টি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। কাজেই আমরা সর্বদা বিশেষ করে রমজান মাসে অন্যায়-অত্যাচার পরিহার করে সাওম ও বেশি বেশি ইবাদাত পালনের মাধ্যমে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের ভাগীদার হতে সচেষ্ট হব। আল্লাহ আমাদেরকে রমজানের শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখে তা অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন\
লেখক : রিসার্চ এসোসিয়েট: কাউন্সিল ফর ইসলামিক রিসার্চ মসজিদ, কাউন্সিল