বিষয়: মুমিনদের ভালবাসা প্রসঙ্গে
খতীব: শায়খ উসামা ইবনু আব্দিল্লাহ খাইয়্যাত
সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের জন্য। যিনি আমাদের সৃষ্টি করে জীবনবিধান হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন। প্রিয়নবী (স)-এর প্রতি লাখো কোটি দরূদ ও সালাম যিনি তাঁর অকান্ত পরিশন্সমে মুমিনদের জীবনের খুঁটিনাটি সর্ব ব্যাপারে শিক্ষা দিয়ে তাদের একটি মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে গঠন করেছেন।
সম্মানিত উপস্খিতি
আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন, তাঁরই ইবাদত ও শুকরিয়া প্রকাশ করুন। সôরণ রাখবেন আপনাদের সবাইকে তাঁরই নিকট ফিরে যেতে হবে। তাই তাঁরই নিকট হাজির হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আপনারা ইহকালীন জীবনের ধোঁকায় পড়ে সর্বস্ব হারাবেন না। কোন ধোঁকাবাজের চক্রান্তে পড়ে নিজের সর্বনাশ করবেন না।
সম্মানিত মুসলিম জনতা
সত্যিকার ঈমান ও আমলে সালেহ যার মাধ্যমে বান্দা তার রবের সন্তুষ্টি কামনা করে ও নবী করিম (স)-এর আদর্শের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করে, তারাই পরকালের পুঁজি সরবরাহে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয়টি বুদ্ধিমান ও সচেতনদের নিকট সুýপষ্ট। ঈমানের স্বাদ আস্বাদনকারীদের একটি নিদর্শন হল, তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঈমানদারদের পরýপরে ভালবাসাতে থাকে যা কখনো বিলুপ্ত হয় না। এ সত্যটি পবিত্র কুরআন সুýপষ্টভাবে বর্ণনা করে ইরশাদ করেন, “যারা বিশবাস স্খাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ভালবাসা দেবেন।” (সূরা মরিয়াম, ৯৬)
আল্লাহর বান্দাগণ
মুমিনদের পারýপরিক ভালবাসাই মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হয়ে থাকে তা প্রকাশ্য দলিল হিসেবেই বুঝতে পারবেন। এ মর্মে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদীস সরাসরি ইঙ্গিত প্রদান করছে। রাসূল (স) ইরশাদ করেন, “মহান আল্লাহ যখন কোন বান্দাহকে ভালবাসেন তখন জিব্রাইল (আ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস। রাসূল (স) বলেন, তখন তাকে জিব্রাইল (আ) পছন্দ করতে থাকেন ও আকাশ জগতে ঘোষণা করে দেন যে, মহান আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ভালবাসেন, তাই তোমরা সবাই তাকে ভালবাস। ফলশন্সম্নতিতে সবাই তাকে ভালবাসতে শুরু করে। এমনিভাবে পৃথিবীতে তাকে ভালবাসার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।” বাস্তব সমাজে আমরা উপরোক্ত লোকদের আপামর জনতার অপার ভালবাসা ও প্রশংসা করতে দেখি। এখান থেকে আমরা ঈমান ও তাকওয়ার প্রভাব অনুভব করতে পারি, কিভাবে তা তার অধিকারীকে মানুষের মনে ভালবাসার পাত্রে পরিণত করে, যে ভালবাসা পাওয়ার সে চেষ্টাও করেনি বা তার মনে কখনো এ বিষয়টি উদিতও হয়নি।
এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় শুধুমাত্র ঈমান ও তাকওয়াই তাকে এ মানে উন্নীত করেছে ও তিনি আল্লাহর একনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার গুণাবলী অর্জন করেছেন। যাদের পরকালীন জীবনে কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্খিতিতে তাদের ভয়মুক্ত ও শঙ্কাহীন থাকার কথা তাদের রবের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ও পৃথিবীতে তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ইরশাদ করা হয়েছে, “মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তানিবত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে।” (সূরা ইউনুস: ৬২-৬৩)
খাঁটি মুমিনদের মর্যাদার বিষয়টি এখানেই শেষ নয়; বরং তারা আল্লাহর ভালবাসা ও তাঁর নিকট তাদের অবস্খানের কারণে পৃথিবীতে যারাই তাদের সাথে দুশমনি করে মহান আল্লাহ তাদেরকে আল্লাহর সাথে দুশমনি করার সমপর্যায় মনে করেন। এ মর্মে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে কুদসীটি সরাসরি ইঙ্গিত প্রদান করে, প্রিয় নবী (স) ইরশাদ করেন, “মহান আল্লাহ বলেন, যে কেউ আমার কোন ওলীর সাথে দুশমনি করবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করব।” অর্থাৎ মানুষ যেমন প্রতিপক্ষ দুশমনকে হারানো ও পর্যুদþত্ম করার জন্য যা করে আমিও ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত-বঞ্চিত করার জন্য তাই করব, শেষ পর্যন্ত তার ধ্বংস অনিবার্য।
এটি গেল আল্লাহর সাথে দুশমনি করার পর্যায়, তেমনিভাবে আল্লাহর কোন ওলীর সাথে বন্ধুত্ব পোষণ করলে, আল্লাহও তাকে সম্মানিত করেন, তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তাকে হিদায়াতের পথে অটল রাখেন। এ প্রসঙ্গে দলিল হিসেবে আমরা রাসূল (স)-এর সাহাবাদের তাঁকে অত্যন্ত আপনজন হিসেবে ভালবাসার ও তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করার কারণে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে যা বর্ণনা করেন তা উল্লেখ করা আবশ্যক। তিনি ইরশাদ করেন, “আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে পুরাতন এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কাননকুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রসন্সবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।” (সূরা তাওবাহ, ১০০)
আল্লাহর দীন বিজয়ের বজন্স কঠিন শপথে তাদের অটলতা প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অত:পর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।” (সূরা আল ফাতহ্, ১৮)
রাসূল (স) তাঁর সাথীদের যে কাউকে মন্দ বলতে নিষেধ করেন, এমনকি উম্মতের বাকী সদস্যদের কেউ তার সব সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করলেও তারা সাহাবাদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার কোন সাহাবীকে গালমন্দ করো না, তোমাদের কেউ ওহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ আল্লাহর রাþত্মায় দান করলেও তারা সাহাবাদের দান করা এক ‘মুদ' বা তার অর্ধেক পরিমাণ খরচ করার সওয়াবের ধারে কাছেও যেতে পারবে না।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
উপরোক্ত দলিলসমূহের উপর ভিত্তি করে ইসলামী চিন্তাবিদগণ রাসূল (স)-এর সাহাবাদের সাথে ভালবাসা পোষণ করাকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকীদার অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করেন, তাদের এ মত পোষণে কারো দ্বিমত নেই। ইমাম আবু জাফর তাহাবী (রা) এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করত তার মত পোষণ করেন, “আমরা রাসূলের সাহাবাদের অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ভালবাসি, তাদের কারো প্রতি ভালবাসায় বেশকম করি না, তাদের অপছন্দকারীদের আমরা অপছন্দ করি, তাদের সর্বপ্রকার ভালকাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা হিদায়াতের পথ পেয়ে থাকি। তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করা দীন, ঈমান ও ইহসানের অন্তর্ভুক্ত মনে করি, পক্ষান্তরে তাদের প্রতি ঈর্ষানিবতদের কুফরি, কপটতা ও বিদেন্সাহী কাজ বলে মনে করি।
আল্লাহর বান্দাগণ
বাস্তবিকই সাহাবাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করাই দীন, ঈমান ও ইহসানের পথে চলার সহায়ক, কেননা তাদের প্রদর্শিত পথে চললেই আল্লাহর পথে চলা ও তাদের নিষেধ করা পথ থেকে বিরত থাকলেই আল্লাহর নিষিদ্ধ পথে বিরত থাকা অনেক সহজতর হয়ে থাকে। তাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইসলামের পথে থেকে দীনের বিজয়ের পথ সুগম করেছেন, রাসূল (স)-এর সাথে যুদ্ধ ও সংগ্রাম সাধনা করেছেন, ঐপথে তাদের ধন-মাল ও জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। আমাদের পূর্বেকার ঐসব ভাগ্যবান খাঁটি মুমিনদের জীবন পরিপূর্ণভাবে সফল, তাঁদের স্বভাব-চরিত্রের বহি:প্রকাশ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর পবিত্র বাণীতে চিরস্খায়ীভাবে স্খাপন করে বলেন, “আর এই সম্মান ও মর্যাদা তাদের জন্যে, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভ্রাতাগণকে ক্ষমা কর এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়।” (সূরা আল হাশর, ১০)
ভাষান্তর: ড· মুহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ
সহযোগী অধ্যাপক, দারুল ইহসান বিশববিদ্যালয়, ঢাকা