মুহররম মাস ও আশুরার তাৎপর্য।

মহান আল্লাহ সর্বদাই তাঁর বান্দাদের কল্যাণ চান। আর এ কল্যাণ অর্জনে যা তাদের জন্য সহজ তাই তিনি আবশ্যক করেছেন। তিনি পবিত্র কুরআনে বলেন, “আল্লাহ তোমাদের সহজ চান, তিনি তোমাদের কঠিন চান না।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

পূর্ববর্তী লোকেরা দীর্ঘ হায়াত পেত। তাই তারা আমলও অনেক বেশি করতে পারত। কিন্তু মুহামôদ (সা·)-এর উমôত তাদের তুলনায় অনেক কম হায়াত পেয়ে থাকে। ফলে তাদের মত বেশি ইবাদাত করতে সক্ষম হয় না। স্বভাবতই তাদের মনে আফসোস দানা বাঁধে। এ আফসোস দূরীকরণে তারা যাতে এ স্বল্প হায়াতে অল্প ইবাদত করে অনেক সাওয়াবের অধিকারী হতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের জন্য কতিপয় দিন, রাত ও মাসকে মর্যাদাবান করে দেয়া হয়েছে। সে সকল মর্যাদাবান মাসেরই একটি হল মুহররম মাস এবং মর্যাদাবান দিনগুলোর একটি হল এর দশ তারিখ।
মুহররম মাসের নামকরণ: মুহররম মাসকে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে, কেননা তাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম। অথবা এর পবিত্রতার প্রতি লক্ষ্য করে একে মুহররম (পবিত্র) নামকরণ করা হয়েছে।
মুহররম মাসের মর্যাদা: তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে এ মাসের মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়:
১· এটি সমôানিত মাসসমূহের একটি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর নিকট বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান এবং যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য হতে চারটি সমôানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)
২· এ মাসকে আল্লাহর সাথে সম্বন্ধকরণ: রাসূলুল্লাহ স· এ মাসকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করেছেন যা এর সমôান ও উচ্চমর্যাদারই প্রমাণ বহন করে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “রমযানের পর সর্বোত্তম সাওম হল শাহরুল্লাহিল মুহররম (আল্লাহর মাস মুহররম) এর সাওম।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৯৮২) ইবন রাজব রাহ· বলেন, নবী স· মুহররমকে শাহরুল্লাহিল (আল্লাহর মাস) নামে নামকরণ করেন। আল্লাহর দিকে তার এ সম্বন্ধটি নি:সন্দেহে এর মর্যাদা ও ফযীলতের প্রমাণ বহন করে। কেননা আল্লাহ তা'আলা কেবল তার সৃষ্টিকূলের বিশেষ বিষয়কেই নিজের দিকে সম্বন্ধ করে থাকেন।
৩· এ মাসে সাওম পালনের ফযীলত: এ মাসে সাওম পালনের যে ফযীলত রয়েছে তা মূলত এর মর্যাদা ও সমôানের প্রতিই ইঙ্গিত করে। রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর নিকট এসে জিজ্ঞেস করেন, রমযানের পর সর্বোত্তম সাওম কোন্টি? তিনি বলেন, আল্লাহর মাসের সাওম যাকে তোমরা মুহররম বল।” (ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭৩২) আবূ উসমান আন-নাহদী রাহ· বলেন, তারা তিনটি ‘দশ'কে সমôান করতেন, “রমযানের শেষ দশ দিন, জিলহাজ্জের প্রথম দশ দিন এবং মুহররমের প্রথম দশ দিন।”
৪· এ মাসে রয়েছে অত্যন্ত ফযীলতের দিন আশুরা: এ মাসের দশ তারিখকে কুরআন সুন্নাহর ভাষায় আশুরা বলা হয়। এ আশুরার দিনের অনেক ফযীলত সুন্নাতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাই তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো।
মুহররম মাস সম্পর্কে কতিপয় কুসংস্কার: হিজরী ৬১ সালের ১০ মুহররমে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন রাদি· এর শাহাদাতকে কেন্দন্স করে এ মাসে আমাদের সমাজে কতিপয় ভ্রান্তিমূলক প্রথা ও কুসংস্কার জন্ম নেয়।
১· এ মাসকে শোক, মাতম, দুশ্চিন্তা ও দু:খের মাস হিসেবে পালন করা।
২· এ মাসে বিবাহ-শাদী অনুষ্ঠিত হওয়াকে অমঙ্গল মনে করা।
৩· এ মাসে নারীদের সৌন্দর্যচর্চা থেকে বিরত থাকা।
৪· এ মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়িঘর ঝেড়ে মুছে, ধুয়ে পরিüকার করা এবং খাবার তৈরী করে তাতে
ফাতিহা, বাকারার প্রথম অংশ, সূরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক ও নাছ পাঠ করা। তারপর নবী স· এর উপর দরূদ পাঠ করে এগুলোর সাওয়াব মৃতদের বখশে দেয়া।
৫· এ মাসে জন্মগ্রহণকারী নবজাতককে দুর্ভাগা মনে করা।
৬· এ মাসের ১০ তারিখে সংঘটিত কারবালার ঘটনাকে আশুরার ফযীলতের কারণ মনে করা।
আশুরার পরিচিতি: মুহররম মাসের ১০ তারিখকে সুন্নাহ ও ইসলামের ইতিহাসে আশুরা বলা হয়।
আশুরার বৈশিষ্ট্য: সহীহ বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুসা আ· ও তার অনুসারীদেরকে ফেরআউনের নির্যাতন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ সমুদেন্স ডুবিয়ে মেরেছিলেন। বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ স· মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সাওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোন দিন? তারা বলল: এটা এক মহান দিবস, এটা এমন দিন যাতে আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুদের নিকট থেকে রক্ষা করেন, ফলে মুসা সে দিবসে সাওম পালন করেন।” (বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৫)

আশুরার সাওমের ফযীলত: এ দিনে সাওম পালনের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, ইবন আব্বাস রা· বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ স·কে এই আশুরার দিনের সাওম ও এই রমযান মাসের সাওম ব্যতীত অন্য কোন সাওমকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি।” (বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৭)

অপর এক হাদীসে আবু কাতাদাহ রা· থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “আল্লাহর নিকট আমি আশা পোষণ করি যে, আশুরার দিনের সাওম পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ মোচন করে।” (তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮৩)

হাদীসে আরো এসেছে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “যে আশুরার সাওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।” (বাযযার, হাদীসটিকে আলবানী সহীহ বলেছেন) ইমাম বায়হাকী (রহ·) বলেন: “এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলো যে সাওম পালনকারীর পাপ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার পাপ নেই আশুরার সাওম তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী)

আমাদের সালফে সালেহীন এ সাওমকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। ইবনে রজব রহ· বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস রা· আবু ইসহাক আস-সাবেয়ী, ইমাম যুহরী (রহ·) প্রমুখ বলতেন: ‘রমজানের সাওম কোন কারণে ছুটে গেলে অন্য সময়ে আদায় করার সুযোগ থাকে কিন্তু আশুরার সাওম ছুটে গেলে আর রাখা যায় না।” (লাতায়েফুল মাআরিফ: ইবনে রজব) নেক কাজে অগ্রণী হওয়ার ব্যাপারে এই ছিল আমাদের পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরামের আদর্শ।

আশুরার সাওমের বিধান: ইসলামের সূচনাতে মক্কায় থাকাকালীন আশুরার সাওম ফরয ছিল। বুখারীর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, আশুরার দিনকে ইহুদিরা ঈদ হিসেবে গ্রহণ করত, কাজেই তোমরা সেদিন সাওম পালন কর।” (বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৬) কিন্তু পরবর্তীতে যখন রমযানের সাওম ফরয করা হয় তখন এটির আবশ্যকতা রহিত হয়ে মুস্তাহাব হিসেবে সাব্যস্ত হয়। সুতরাং আশুরার সাওম মুস্তাহাব। ইবন হাজার রাহ· বলেন, “ইবন আব্দুল বার নকল করেন, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, ‘আশুরার সাওম এখন আর ফরয নয় বরং তা মুস্তাহাব'।”

আশুরার সাওম পালনের পদ্ধতি: এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে আমরা নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিসমূহ পাই। ক· কেবল ১০ তারিখে সাওম পালন করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “আশুরার দিনকে ইহুদিরা ঈদ হিসেবে গ্রহণ করত, কাজেই তোমরা সেদিন সাওম পালন কর।” (বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৬) এটি ইসলামের সূচনালগ্নে ছিল। পরে এ পদ্ধতি রহিত হয়ে যায়। কারণ এটা ইহুদীদের আমলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। (ইকতেজাউ সিরাতিল মুস্তাকীম: ইমাম তাইমিয়া) ও (রদ্দুল মুহতার: ইবনে আবেদীন)।

খ· ৯ ও ১০ তারিখে সাওম পালন করা। এ পদ্ধতি অতি উত্তম। কারণ রসূলে কারীম স· এভাবেই আশুরার সাওম পালনের সংকল্প করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তবে আমি ৯ তারিখে সাওম পালন করব।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৯১৭) এ হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ কেউ বলেন যে, এখানে তিনি কেবল ৯ তারিখে সাওম পালনের আকাáক্ষা করেছেন। মুলত: তাদের এ ব্যাখ্যাটিই ভুল। কারণ অন্যান্য বর্ণনা থেকে ýপষ্ট যে, তিনি ৯ তারিখ ও ১০ তারিখের সাওমের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
গ· ১০ ও ১১ তারিখে সাওম পালন করা। এটিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত।
ঘ· ৯, ১০ ও ১১ তারিখ তিনদিনই সাওম পালন করা। রাসূলুল্লাহ স· বলেন, তোমরা ইহুদীদের বিরোধিতা কর, তোমরা আশুরার আগের দিন এবং এর পরের দিনও সাওম পালন কর।” (বায়হাকী, হাদীসটির সনদ দুর্বল) যেহেতু হাদীসটি দুর্বল সেহেতু এভাবে সাওম পালন করা যায় তখনই যখন আশুরার তারিখ নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। এতে আশুরা ফযীলত লাভ করার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ থাকে না। মুহামôদ বিন সীরীন রহ· থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার মুহররমের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে তিনি উপরোক্ত নিয়মে তিনটি সাওম পালন করেন। (ফাতহুল বারী ও যাদুল মাআ'দ)

আশুরার ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিভ্রান্তি: আশুরার ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়:
১· এ দিনে পৃথিবী সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
২· এ দিনে আল্লাহ তা'আলা সৃষ্টি জগতের সামনে ‘রব' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
৩· এ দিনে আল্লাহ আরশ, কুরসী ও লওহে মাহফুয সৃষ্টি করেন।
৪· এ দিনে আদম আ· এর সৃষ্টি হয়েছিল।
৫· এ দিনেই আদমকে আ· দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং এ দিনে আদম ও হাওয়ার মিলন হয়েছিল আরাফাতের ময়দানে। উভয়ের তাওবাও কবুল হয়েছিল এ দিনে।
৬· নূহ আ· এর প্লাবন এ দিনে হয়েছিল। প্লাবন শেষে নূহ আ· এর নৌকা এ দিনে জুদী পাহাড়ে আশন্সয় লাভ করে।
৭· নবী ইদরীস আ·কে এ দিনে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।
৮· আইউব আ· এর দীর্ঘ রোগমুক্তি এ দিনে হয়েছিল।
৯· মাছের পেট থেকে ইউনুস আ·-এর মুক্তি লাভ এ দিনে হয়েছিল।
১০· মুসা আ· তাওরাত লাভের জন্য তুর পাহাড়ে এ দিনে গমন করেছিলেন।
১১· নমরুদের আগুন থেকে ইবরাহীম আ· এ দিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।
১২· ইয়াকুব আ· এ দিনে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন।
১৩· সুলাইমান আ· এ দিনে তার হারানো রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন।
১৪· ঈসা আ· এর জন্ম এ দিনে হয়েছিল। ঈসা আ· কে এ দিনে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।
১৫· ফির'আউনের বিবি আসিয়া শিশু মূসা আ·কে লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ দিনে।
১৬· এ দিনে কাবা শরীফের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
১৭· এ দিনে জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়।
১৮· এ দিনে ইয়াকূব আ· এর সাথে ইউসুফ আ· এর মিলন হয়।
১৯· এ দিনে দাউদ আ· জালূতকে হত্যা করেন।
২০· এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কিছু এ দিনে সংঘটিত হয়েছিল তা যেমনিভাবে আলিমদের কাছ থেকে শোনা যায় তেমনি আশুরা সম্পর্কিত লিখিত অনেক বই পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায়। গবেষণার মাধ্যমে যতদূর জানা যায়, উপরোক্ত বিষয়গুলো মোটেই কুরআন ও হাদীসভিত্তিক তথ্য নয়। বরং এ দিনের ব্যাপারে হাদীসভিত্তিক সঠিক তথ্য হল, যা আমি ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এ দিনে আল্লাহ মূসা ও তার দলকে ফিরআউনের নির্যাতন থেকে মুক্তি দেন এবং ফিরআউন ও তার দলবলকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন।

আশুরার দিনের কতিপয় বিভ্রান্তিমূলক আমল: আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, আশুরার দিনে সাওম পালন বড়ই ফযীলতের কাজ এবং এটি সুন্নাহভিত্তিক আমল। কিন্তু আমাদের মুসলিম সমাজে এ দিনে সাওম পালন ছাড়া আরো কতিপয় আমল হয়ে থাকে যা কুরআন ও হাদীস সমর্থিত নয়। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা সেগুলোকে ফযীলত মনে করে পালন করি। আমলগুলো হল:
১· এ দিনে ভাল ও বিভিন্ন প্রকারের উন্নত খাবারের ব্যবস্খা করা এবং মনে করা যে, এর কারণে সারা বছর ভাল ও উন্নত খাবারের ব্যবস্খা হবে। এ সম্পর্কে হাদীসে রয়েছে, “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গের জন্য প্রশস্ত মনোভাব দেখাবে আল্লাহ সারা বছর তার জন্য প্রশস্ত মনোভাব দেখাবে।” (তাবারানী, হাদীস নং ৯৮৬৪) তবে হাদীসটি দুটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়।
ক· মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে অশুদ্ধ বলেছেন। ইমাম আহমাদ বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়। তাবারানী ও বায়হাকী বলেন, এর সকল সনদই দুর্বল। ইবনুল জাওযী এটিকে জাল হাদীসের তালিকায় বর্ণনা করেছেন। আর সুয়ূতী তার ‘আল জামি' আস-সাগীর' গ্রন্থে এর ক্ষেত্রে সহীহ চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য সুয়ূতী এ ধরনের হাদীসের ক্ষেত্রে নমনীয়।
খ· হাদীসটি রাসূলুল্লাহ স· এর সেই সকল সহীহ হাদীসের বিরোধী যাতে তিনি আশুরাতে সাওম পালন করতে বলেছেন। সাওম পালন করলে ভাল খাবার ব্যবস্খার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে। কাজেই এ বিবেচনায় হাদীসটি মুনকার।
২· এ দিনে চোখে সুরমা ব্যবহার করা এবং মনে করা যে, এর কারণে চক্ষুদ্বয় আর কখনো রোগাক্রান্ত হবে না। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “আশুরার দিন যে চোখে সুরমা ব্যবহার করে তার চক্ষু কখনো রোগাক্রান্ত হবে না।” (বায়হাকী, হাদীস নং ৩৬৩৬) এই হাদীসটিও খুবই দুর্বল। হাকিম বলেন, হাদীসটি মুনকার। সাখাবী বলেন, হাদীসটি জাল, ইবনুল জাওযী হাদীসটিকে জাল হাদীসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হাকীম আরো বলেন, আশুরার দিন চোখে সুরমা ব্যবহার করা সংক্রান্ত কোন হাদীস নবী স· থেকে বর্ণিত হয়নি, এটি একটি বিদ'আত যা হুসাইন রাদি· এর হত্যাকারী কর্তৃক প্রণোদিত।
৩· এ দিনের রাত্রি জাগরণ করা।
৪· মসজিদে মসজিদে আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করে প্রতিটি গৃহ থেকে চাল, ডাল ও লাকড়ি সংগ্রহ করে শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ সমবেত হয়ে আলোচনা শেষে তবারক সমেত বাসায় ফেরা।
৫· আনন্দ-ফূর্তি প্রকাশ করা।
৬· এ দিনকে কেন্দন্স করে মাযার যিয়ারত করা।
এ আশুরার দিনে শিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে আরো কতিপয় মারাত্মক বিদ'আত প্রচলিত রয়েছে। যেমন:
১· আশুরার দিন ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের সôরণে মাযারের প্রতিকৃতি বানিয়ে তা নিয়ে মাতম ও তাযিয়া মিছিল বের করা।
২· তরবারী দ্বারা মাথায় আঘাত করে তা রক্তাক্ত করা।
৩· চাবুক দ্বারা পিঠে আঘাত করে তা ক্ষত-বিক্ষত করা।
৪· বুকে ব্লেড মেরে তা রক্তাক্ত করা।
৫· এ দিনে নারী-পুরুষের অবৈধ মিলনকে শিথিল করে দেয়া।

এ ধরনের অনেক কুসংস্কার ও বিদ'আত আমাদের সমাজে স্খান গেড়ে আছে। অথচ আমরা জানি যে, আমল কবুল হওয়ার জন্য দু'টি শর্ত রয়েছে। এক· আমলটি এখলাসের সাথে হওয়া। দুই· আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় হওয়া। মাতম করা, শোক প্রকাশ করত: উচ্চস্বরে আহাজারী করা, বুক চাপড়ানো, পোশাক ছিঁড়ে ফেলা, শরীর রক্তাক্ত করা সবই জাহেলী যুগের আচরণ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ স· বলেন, “সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে (শোকে) গাল চাপড়ায়, গলাবন্ধ ছিঁড়ে ফেলে ও জাহিলী যুগের আচরণ করে।” (মুসলিম, হাদীস নং ১২১৪) অপর হাদীসে এসেছে, উমেô আতীয়া নুসাইবা রা· থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইয়াত গ্রহণকালে আমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যেন আমরা মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশার্থে উচ্চ শব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে কান্নাকাটি না করি। (বুখারী, হাদীস নং ১২২৩) মুসলিমের অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মৃত ব্যক্তিকে কেন্দন্স করে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা কুফরীর মধ্যে গণ্য।” (হাদীস নং ১০০)

মোটকথা আমরা মুহররম মাস ও আশুরার কার্যাবলীর দিকে লক্ষ্য করলে দেখি এগুলো দু'ভাগে বিভক্ত।
এক· কাজগুলো আমাদের অভ্যাসের অন্তর্গত। এগুলো শিয়া ও রাফেজী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ থেকে এসেছে। তারা হুসাইন রা· এর শাহাদাত সôরণে শোক প্রকাশ ও মাতম করে থাকে। যেমন এ দিনে গোসল করা, সুরমা ব্যবহার করা, মাযারের প্রতিকৃতি বানিয়ে তা নিয়ে মাতম ও তাজিয়া মিছিল বের করা, মেলার আয়োজন করা ইত্যাদি। দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকায় আমরা এ সকল কুসংস্কার ও বিদআতে লিপ্ত হয়ে থাকি। তাই আমাদের সকলের জন্য দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। আমাদের অজ্ঞতার কারণেই আমরা দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক দ্বীন বুঝার তাওফীক দান করুন।

কারবালার ঘটনা ও আশুরা?
অনেকেই কারবালার ঘটনার সাথে আশুরার বিষয়টি তালগোল করে ফেলে। তারা আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝায়। অথচ আশুরার ফযীলত ও তার সাওম ইসলামের সূচনা থেকেই চলে আসছে। কারবালার বিষয়টি মূলত: হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহাররামে সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ কারবালার ঘটনা ও আশুরার পার্থক্যের বিষয়টিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়
০ সর্বদাই সকল পাপ থেকে বিরত থাকা বিশেষ করে সমôানিত মাসসমূহে। কারণ সমôানিত মাসসমূহে করা পাপ অন্যান্য মাসের পাপের তুলনায় অধিক জঘন্য ও ভয়াবহ। ইবন কাসীর কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেন, হারাম মাসসমূহে যুলুম ও সীমালংঘন অন্য মাসের তুলনায় অনেক বড় পাপ ও ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে পরিগণিত। এ সমôানিত মাসসমূহ হল, যিলকাদ, যিলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব।
০ ইহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ করত: মুহাররামের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে সুন্নাত হিসেবে আশুরার সাওম পালন করা।
০ মুসলিম সমাজে আশুরার সাওম পালন ছাড়া আর যে সকল কুসংস্কার ও বিদ'আত প্রচলিত আছে তা বর্জন করা।
০ কারবালার ইতিহাস সôরণে আশুরা পালনের নামে মাতম, মর্সিয়া, তাজিয়া মিছিল, শরীর রক্তাক্ত করা ইত্যাদি কার্যাবলী সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা এবং অন্যদেরকেও এগুলো করা থেকে বিরত রাখা। ইসলাম এ সকল কার্যকলাপের অনুমোদন দেয় না। এগুলো সন্দেহাতীতভাবে বিদ'আত। এগুলো পরিহার করে চলা ও অন্যদের পরিহার করতে উৎসাহিত করা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসারী সকল ঈমানদারের কর্তব্য।
০ কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সাথে আশুরার ফযীলতের কোন সম্পর্ক স্খাপন না করা। আশুরার মর্যাদার বৃদ্ধিতে বা কমাতে এর কোন ভূমিকা নেই।
০ আল্লাহ ও তার রাসূলকে মহব্বত করার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম না করা। রাসূল স· নিজেই বলেছেন, “তোমরা আমার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না যেমন খৃস্টানরা মারিয়ামের ছেলের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি কেবল একজন বান্দা। কাজেই তোমরা বল ‘আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল' (বুখারী, হাদীস নং ৩১৮৯)
০ আমরা যারা দ্বীন প্রচারে ভূমিকা রাখি, মসজিদের ইমাম-খতীব, বক্তা, দাওয়াত কর্মী তারা যেন দ্বীন সম্পর্কে কিছু বলার সময় তা কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত বক্তব্য ও উপদেশ থেকে বলি। কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা যা প্রমাণিত নয় তা প্রচার করা থেকে বিরত থাকি। কারণ আল্লাহ তায়ালা দ্বীন সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তার উমôাতকে বিরত থাকতে বলেছেন। হাদীসে রয়েছে, মহানবী স· বলেন, “হে মানুষ! সাবধান তোমরা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে।” (ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২০)
০ নবী, রাসূল বুজুর্গ, পীর-মুরশীদ ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে বার্ষিকী বা মিলাদ বা মিলাদ অনুষ্ঠান বা চল্লিশা ইত্যাদি পালন করা থেকে বিরত থাকা। কারণ এর কোনটিই শরীয়ত সমর্থিত নয়। এগুলো মহব্বত প্রকাশের নামে বাড়াবাড়ি। আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআন ও সুন্নাহমুখী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন\
রিসার্চ এসোসিয়েট, মসজিদ কাউন্সিল