কুরআন শরীফ (আরবি: القرآن আল্ক্বুর্'আন্ "আবৃত্তিটা") মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) নিকট অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা বা অধ্যায় আছে। আয়াত বা অনুচ্ছেদ সংখ্যা ৬,৬৬৬ টি। এটি মূল আরবি ভাষায় অবর্তীর্ণ হয়। কুরআন ধারাবাহিকভাবে অবর্তীর্ণ পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ। গ্রন্থ অবতরণের এই ধারা ইসলামের প্রথম পয়গম্বর আদম থেকেই শুরু হয়। কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যার সাথে বাইবেলসহ অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের বেশ মিল রয়েছে, অবশ্য অমিলও কম নয়। তবে কুরআনে কোনও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নেই। অপরিবর্তণীয় থাকার রহস্য রয়েছে কুরআনেরই একটি আয়াতের মধ্যে:
“আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক”
বুৎপত্তি
আরবি ব্যাকরণে কুরআন শব্দটি মাসদার তথা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি قرأ ক্বারা'আ ক্রিয়া পদ থেকে এসেছে যার অর্থ পাঠ করা বা আবৃত্তি করা। এই ক্রিয়াপদটিকেই কুরআন নামের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই শব্দটির মিটার বা "মাসদার" (الوزن) হচ্ছে غفران তথা "গুফরান"। এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত ভাব, অধ্যবসায় বা কর্ম সম্পাদনার মধ্যে একাগ্রতা। উদাহরণস্বরুপ, غفر নামক ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে "ক্ষমা করা"; কিন্তু এর আরেকটি মাসদার রয়েছে যার যা হল غفران, এই মাসদারটি মূল অর্থের সাথে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ক্ষমা করার কর্মে বিশেষ একাগ্রতা বা অতি তৎপর বা অতিরিক্ত ভাব। সেদিক থেকে কুরআন অর্থ কেবল পাঠ করা বা আবৃত্তি করা নয় বরং আরেকটি অর্থ হচ্ছে একাগ্র ভঙ্গীতে পাঠ বা আবৃত্তি করা। কুরআনের অভ্যন্তরেও এই অর্থেই কুরআন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের সূরা আল-কিয়ামার (৭৫ নং সূরা) ১৮ নং আয়াতে এই শব্দটি উল্লেখিত আছে:
فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ
অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি (ক্বুরা'নাহু), তখন আপনি সেই পাঠের (কুরআ'নাহ্) অনুসরণ করুন। (মাআরিফুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ)
কুরআনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ১১৪ টি সূরা রয়েছে। সকল সূরা মিলিয়ে মোট আয়াতের (আয়াত আরবী শব্দ, এর সাহিত্যিক অর্থ নিদর্শন) সংখ্যা প্রায় ৬৬৬৬(মতান্তরে ৬২৩৬, ৬৩৪৮, সকল বিসমিল্লাহ্কে আয়াত হিসেবে গণনা করে) প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম রয়েছে। নামকরণ বিভিন্ন উপায়ে করা হয়েছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কোন শব্দকেই নাম হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এছাড়া এমন নামও পাওয়া যায়, যা সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়নি, যেমন: সূরা ফাতিহা, ফাতিহা শব্দটি সূরার কোন স্থানে নেই। সূরাগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জা রয়েছে। এই সজ্জাটিও কুরআনের মত এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে। সজ্জাকরণ তাদের অবতরণের ধারাবিহকতা অনুসারে করা হয়নি। বরং দেখা যায় অনেকটা বড় থেকে ছোট সূরা অনুযায়ী সাজানো; অবশ্য এটিও পুরোপুরি সঠিক নয়, প্রকৃত সজ্জার কারণ কারও জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় সূরাও ছোট সূরার পড়ে এসেছে। তবে একটি সূরা বা তার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিকতার সাথেই অবতীর্ণ হয়েছিলো। এই সজ্জাটি মুখস্থকরণের সুবিধার সৃষ্টি করেছে।
বিভাজন: হিজ্ব বা মানজিল
হিজ্ব বা মানজিল হচ্ছে কুরআনের প্রথম সূরা ফাতিহা ব্যাতীত অন্য সূরাগুলো নিয়ে করা একটি শ্রেণী। হিজ্ব মুফাস্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করা। এতে ৭ টি মানজিলের মাধ্যমে সবগুলো সূরাকে একসাথে করা হয়েছে। মানজিলগুলো হচ্ছে:
মানজিল ২ = ৫ টি সূরা, যথা, ৫ - ৯
মানজিল ৩ = ৭ টি সূরা, যথা, ১০- ১৬
মানজিল ৪ = ৯ টি সূরা, যথা, ১৭- ২৫
মানজিল ৫ = ১১ টি সূরা, যথা, ২৬-৩৬
পারা
পবিত্র কুরআনে মোট ৩০ টি পারা বা অধ্যায় রয়েছে। এই পারাগুলোর মাধ্যমে ১১৪ টি সূরা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সূরাগুলো বিভিন্ন আকারের হলেও কুরআনের পারাগুলো প্রায় সমান আকারের। কুরআন মুখস্থকরণের ক্ষেত্রে সাধারণতম পারা অনুযায়ী শিক্ষা করানো হয়। যে সকল স্থানে সমগ্র কুরআন পাঠের আয়োজন করা হয় সেখানেও এই পারা অনুযায়ী করা হয়।
কুরআনের সাহিত্যিক গঠন
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্য এবং ইসলাম শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ইসা বাউলাতা কুরআনের সাহিত্যিক গঠনপ্রণালি সম্বন্ধে নিম্ন প্রকারের মন্তব্য করেছেন।
কুরআনের বার্তাগুলো বিভিন্ন সাহিত্যিক গঠনে প্রকাশিত হয়েছে, যা আরবী সাহিত্যের সবচেয়ে নিখুঁত লিখিত রচনা হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কুরআনের ভাষার উপর ভিত্তি করেই আরবী ব্যকরণ রচিত হয়েছে, এবং মুসলিম অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের বর্ণনামতে, কুরআনের বাগধারাগুলো ভীষণ সুন্দর এবং মহিমান্বিত হিসেবে বিবেচিত হয়... উপসংহারে একথা বলা যেতে পারে যে, কুরআন এর বার্তা প্রকাশ করার নিমিত্তে বিপুল প্রকার ও শ্রেণীর সাহিত্যিক উপদানের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছে।