হাদীস কেন পড়বো? ইসলাম আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা। মানুষ যেনো তাঁর পছন্দনীয় পন্থায় জীবন যাপন করতে পারে, সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা দয়া করে মানুষকে সে পথ ও পন্থার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। কোন পথে চললে তিনি খুশী হবেন, তা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। কোন্ পথে চললে তিনি নারাজ হবেন, তাও বাতলে দিয়েছেন। জীবন যাপনের সঠিক নিয়ম কানুন বলে দিয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষকে তার মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। সফলতা লাভের উপায় বলে দিয়েছেন্ আর এই যে মুক্তির পথ আল সফলতা লাভের উপায়, তারই নাম হলো ‘ইসলাম’। সুতরাং মানুষ যদি আল্লাহর পছন্দনীয় পথে চলতে চায়, তবে তাকে অবশ্যি জানতে হবে, আল্লাহর পছন্দনীয় পথ কোনটি? তাকে অবশ্যি জানতে হবে, তার মুক্তির পথ কোনটি? তার সফলতা অর্জনের উপায় কি? অর্থাৎ তাকে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে। কিন্তু , ইসলাম সম্পর্কে জানার উপায় কি? শেষ যামানার মানুষ যেনো ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, আল্লাহর পছন্দীয় পথের সন্ধান পেতে পারে, সে জন্য আল্লাহ তায়ালা আরব দেশের একজন অত্যন্তভালো মানুষকে তার বানীবাহক নিযুক্ত করেন । তার নাম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তার কাছে মানুষেরর জন্যে তার পছন্দনীয় জীবন ব্যবস্থা ইসলাম অবতীর্ণ করেন। তার কাছে একখানা কিতাব নাযিল করেন। এ কিতাবের নাম আল কুরআন। এ কিতাবের সমস্ত অর্থ ও মর্ম তিনি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য কুরআন ছাড়াও তিনি আরেক ধরনের বাণী তার উপর অবতীর্ণ করেছেন। মানুষ কিভাবে আল কুলআন অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, তা বুঝিয়ে দেবার দায়িত্বও তিনি তার উপর অর্পণ করেছেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন্ তিনি সঠিকভাবে আল্লাহর কিতাব মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি তা বুঝিয়ে দিয়েছেনঃ ১. তার বাণী, বক্তব্য ও কথার মাধ্যমে, ২. তার কাজকর্ম এবং চরিত্র ও আমলের মাধ্যমে, ৩. অন্যদের কথা ও কাজকে সমর্থন করা এবং অনুমতিদানের মাধ্যমে। নবী হিসেব তার এই তিন প্রকারের সমস্ত কাজকেই হাদীস নলা হয়। এই তিন ধরনের কাজকে তিন ধরনের হাদীস বলা হয়ঃ ১. তিনি তার বাণী, বক্তব্য ও কথার মাধ্যমে মানুষকে যা কিছু বলে গেছেন ও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার নাম হলো, বক্তব্যগত হাদীস। ২. তিনি তার কর্ম, চরিত্র ও আমারৈর মাধ্যমে যা কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন তার নাম কর্মগত হাদীস। ৩. তিনি যা কিছুর সমর্থন ও অনুমোদন দিয়ে গেছেন, তার নাম হলো, সমর্থনগত বা অনুমোদনগত হাদীস। তাহলে আমরা এখন বুঝতে পারলাম, আল্লাহর পছন্দনীয় পথ কোনটি? তার অপছন্দনীয় পথই বা কোনটি? আর কিভাবেই বা তার পছন্দনীয় পথে চলতে হবে? এসব কথা ও নিয়ম কানুন আল্লাহর তায়ালা তার নবীকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তায়ালার পাঠানো এসব বানী, বক্তব্য ও নিয়ম কানুনের সমষ্টির নাম হলো ইসলাম। আমরা একথাও জানতে পারলাম, আল্লাহ তায়ালা যে তার নবীর মাধ্যমে আমাদের জন্যে তার পছন্দনীয় জীবন যাপনের পথ ইসলাম পাঠিয়েছেন, সে ইসলামকে আমরা দু’টি মাধ্যমে জানতে পারিঃ একঃ নবীর প্রতি আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব আল কুরআন এর মাধ্যমে। দুইঃ নবীর বাণী, কাজ ও অনুমোদনসমূহের মাধ্যমে। অর্থাৎ নবীর হাদীসের মাধ্যমে। এখানে আরেকটি কথা বলে নিই। কথাটা হলো, আমাদের প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা, কাজ ও অনমোদনের মাধ্যমে অর্থাৎ হাদীসের মাধ্যমে আমাদেরকে ইসলাম পালন করার যেসব নিয়ম কানুন, বিধি বিধান, আচার আচরণ ও রীতিপদ্ধতি জানিয়ে ও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, তার নাম হলো, সুন্নতে রসূল বা রসূলের সুন্নাহ। এখন এ আলোচনা থেকে আমাদের কাছে একটি কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। তাহলো, যারা আল্লাহর পছন্দনীয় জীবন যাপনের পথ ইসলামকে জানতে চায় এবং ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চায়, তাদেরকে অবশ্যি : ১. আল্লাহর কিতাব আল কুরআন পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং তা মেনে চলতে হবে। ২. নবীর হাদীস ও সুন্নাহকে পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন করত হবে। তাহলে হাদীস কেন পড়বো? এ প্রশ্নটির জবাব এখন সুন্দরভাবে আমাদের জানা হয়ে গেলো! হাদীস কোথায় পাবো? এখন তুমি যদি আমাকে প্রশ্ন করো, আল্লাহর কিতাব কুরআন তো আমাদের ঘরে ঘরে আছে। কিন্তু নবীর হাদীস কোথায় পাবো? জবাব কিন্তু সোজা। আল্লাহর কিতাবের মতো নবীর হাদীসও কিন্তু আমরা ঘরে ঘরে রাখতে পারি। সেই ব্যবস্থা আমাদের দেশে আছে। কথাটি বুঝিয়ে বলছি। নবীর সাহবীগণ নবীর কাছ থেকে তার হাদীস জেনে ও শিখে নিয়েছিলেন। সাহাবীদের কাছ থেকে তাদের পরবর্তী লোকেরা হাদীস জেনে ও শিখে নেন। অতঃপর তাদের থেকে তাদের পরবর্তী লোকেরা হাদীস জেনে ও শিখে নেন। এভাবে এক দেড়শ বছর চলতে থাকে। এ সময় কিছু লোক হাদীস লিখেও রাখতেন, আবার কিছু লোক মুখস্থও করে রাখতেন। এরপর খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয হাদীসের শিক্ষকগণকে নির্দেশ দেন, যেখানে যার যে হাদীস জানা আছে, তা সব যেনো সংগ্রহ করে লিখে ফেলা হয়। ইসলামের বিজয়ের সাথে সাথে সাহাবীগণ ছড়িয়ে পড়েছিলেন দেশে দেশে। সেই সাথে নবীর হাদীসও ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। তাই হাদীসের ছাত্র ও শিক্ষকগণ হাদীস সংগ্রহের জন্যে ছুটে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। এভাবে তারা সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা নবীর সমস্ত হাদীস সংগ্রহ করে ফেলেন। যিনি যেখানে যে হাদীস পেয়েছেন, তিনি তা সংগ্রহ ও সংকলন করে ফেলেন। এভাবেই সংকলিত হয়ে যায় নবীর হাদীসের বিরাট বিরাট গ্রন্থ। তাদের সংকলন করা হাদীসের গ্রন্থগুলো আমাদের কাছে এখন ছাপা হয়ে মওজুদ রয়েছে। কয়েকজন বড় বড় হাদীসের উস্তাদ এবং তাদের সংগ্রহ ও সংকলন করা হাদীস গ্রন্থগুলোর নাম বলে দিচ্ছি : ১. মালিক ইবনে আনাস (৯৩-১৬১)। তার সংকলিত গ্রন্থের নাম ‘মুয়াত্তা’ বা ‘মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক।’ ২. আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১) হিজরী)। গ্রন্থ: মুসনাদে আহমদ। ৩. মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী)। গ্রন্থ: ‘আল জামেউস সহীহ’। সহীহ বুখারী নামে সুপরিচিত। ৪. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ নিশাপুরি (২০২-২৬১ হিজরী)। গ্রন্থ: সহী মুসলিম। ৫. আবু দাউদ আশআস ইবনে সুলাইমান (২০২-২৭৫ হিজরী) । গ্রন্থ: সুনানে আবু দাউদ। ৬. আবু ঈসা তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিজরী)। গ্রন্থ: সুনামে তিরমিযী। ৭. আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী (মৃত্যু-৩০৩ হিজরী)। গ্রন্থ: সুনানে নাসায়ী। ৮. মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে মাজাহ (মৃত্যু ২৭৩ হিজরী)। গ্রন্থ: সুনানে ইবনে মাজাহ। এই বিখ্যাত আটজন মুহাদ্দিসের সংকলিত এই আটখানা হাদীস গ্রন্থ সবচাইতে বেশী খ্যাতি অর্জন করেছে। শেষের ছয়খানা গ্রন্থ ‘সিহাহ সিত্তা বা বিশুদ্ধ ছয়গ্রন্থ’ নামে পরিচিত। এই আটখানা এবং এ রকম অন্যান্য বড় বড় গ্রন্থ থেকে বিষয় ভিত্তিক হাদীস বাছাই করে আবার অনেকগুলো গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। এগুলো হলো বাছাই করা সংকলন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোঃ ১. মিশকাতুল মাসাবীহ। সংকলন করেছেন অলীউদ্দীন আল খতীব। ২. বুলূগুল মারাম। সংকলন করেছেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেযে হাদীস এবং সহীহ্ বুখারীর ব্যাখ্যাতা ইবনে হাজর আসকালানী। ৩. রিয়াদুস সালেহীন। সংকলন করেছেন সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাতা ইয়াহিয়া ইবনে শরফ নববী । ৪. মুনতাকিল আখবার। সংকলন করেছেন আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়া। ইনি ইমাম ইবনে তাইমিয়ার দাদা। এগুলো ছাড়াও আরো অনেকগুলো সংকলন রয়েছে। বাংলা ভাষায়ও বেশ কিছু সংকলন তৈরী হয়েছে, অনুবাদ হয়েছে ও প্রকাশ হযেছে। সুতরাং হাদীস কোথায় পাবো? সে প্রশ্নের জবাবও আমরা পেয়ে গেলাম। ১.এই আটখানা গ্রন্থের প্রায়গুলোই বাংলায় প্রকাশ হয়েছে। বাকীগুলোও হওয়ার পথে। দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে পরকালে প্রশ্ন করা হবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ১. কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্ন জিজ্ঞিসা করার আগে বনী আদমের পা এক কদমও নড়তে পারবেনা। সেগুলো হলোঃ ১. সে নিজের জীবনটা কোন্ পথে কাটিয়েছে? ২. যৌবনের শক্তি কোন্ কাজে লাগিয়েছে? ৩. ধন সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে? ৪. কোন পথে ধন সম্পদ ব্যয় করেছে? ৫.দীন ইসলাম সম্পর্কে যতোটুকু জানতো, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। {তিরমিযী : ইবনে মাসউদ রাঃ} ব্যাখ্যা : এই হাদীসে আমাদের প্রিয় নবী আমাদেরকে একথাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের জীবনের একটি মুহূর্তও অকারণে নষ্ট করা যাবেনা। অন্যায় পথে একটি পয়সাও খরচ করা যাবেনা। আল্লাহর মর্জির খেলাফ কাজে একটি পয়সাও খরচ করা যাবেনা। আর দীন ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চলতে হবে। কারণ, আল্লাহর কাছে একদিন এগুলোর হিসাব দিতে হবে। আমাদের প্রত্যেককেই মরতে হবে এবং আল্লাহর কাছে হাযির হতে হবে। তাই সেদিনকার মুক্তির ব্যবস্থা পৃথিবী থেকেই করে যেতে হবে। মৃত্যুর আগে জীবনকে কাজে লাগাও নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ২.পাঁচটি খারাপ সময় আসার আগে পাঁচটি ভালো সময়কে কাজে লাগাও : ১. বুড়ো হবার আগে যৌবনের শক্তিকে, ২. অসুখ হবার আগে সুস্থ থাকার সময়কে, ৩. অভাব অনটন আসার আগে সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে অবসর সময়কে এবং ৫. মরণ আসার আগে জীবিত থাকার সময়কে। (তিরমিযী : আমর ইবনে মাইমুন রাঃ) ব্যাখ্যাঃ অনেক মানুষ কেবল এই দুনিয়ার অর্থ সম্পদ এবং মান মর্যাদা লাভ করবার ও ভোগ করবার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। পরকালের মুক্তির জন্য কি আমল করলো আর মরণের পরে কি অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে, সে বিষয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা করেনা। আসলে দুনিয়ার জীবনটা একটা সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরকালের মুক্তির ব্যবস্থা করা সকলেরই কর্তব্য। পরকালের জন্যে কাজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩. আসল বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করলো এবং মরণের পরের জন্য আমল করলো। আর বোকা দুর্বল সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে কামনা বাসনার অনুসারী করে দিয়েছে, অথচ আল্লাহ তাকে বেহেশত নিয়ে যাবে বলে মিথ্যা আশা করে বসে আছে। (তিরমিযী : শাদ্দাদ ইবন আউস রাঃ) প্রকৃত মুমিন সত্যিকার ঈমানদান কিভাবে হওয়া যায়, হাদীসে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই কথাও জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ৪. ঐ ব্যক্তির ঈমানদের স্বাধ পেয়েছে (অর্থাৎ সত্যিকার ঈমানদার হয়েছে), যে ব্যক্তি সন্তুষ্টির সাথে আল্লাহকে রব মেনে নিয়েছে। ইসলামকে দীন মেনে নিয়েছে। আর মুহাম্মদকে রসূল মেনে নিয়েছে। (মুসলিমঃ আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব।) ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে বলা হয়েছে, প্রকৃত মুমিন হতে হলে মনের সন্তুষ্টির সাথে তিনটি কথা স্বীকার করতে হবে। সেগুলো হলোঃ ১. আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করতে হবে। ২. ইসলামকে দ্বীন বা জীবন চলার পথ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং ৩. মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রসুল মেনে নিতে হবে। আল্লাহকে রব মানার অর্থ কি? এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহকে যে রব বলে স্বীকার করতে হবে, সেই রবের মানেটা কি? রব মানে হচ্ছে, মালিক, প্রভু, গার্জিয়ান, প্রতিপালক, রক্ষক, সকল ক্ষমতার অধিকারী, কর্তা, শাসক। আমি আল্লাহকে রব মানি, এই কথার অর্থ হলো, আমি কেবল আল্লাহকেই একমাত্র মালিক, অভিবাবক, প্রতিপালক, রক্ষক, ক্ষমতার অধিকারী এবং শাসনকর্তা মানি। আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকেও মালিক মনে করিনা। আর কাউকে প্রভু মানি না । প্রয়োজন পূরণকারী মনে করিনা। রক্ষাকর্তা মনে করিনা। আর কারো হুকুম মানিনা। আইন মানিনা। আর কারো কাছে মাথা নত করিনা। এগুলোই হলো আল্লাহকে রব মানার অর্থ। আল্লাহকে এভাবে মেনে নিলেই তাকে রব মানা হয়। আর তাকে এভাবে মানাই ঈমানের দাবী। দীন কাকে বলে? এবার দেখা যাক ইসলামকে দীন মানার অর্থ কি? দীন মানে, জীবন যাপনের পথ। মানুষ তার গোটা জীবন কিভাবে চালাবে? কিভাবে ঘর সংসার চালাবে? কোন নীতিতে ব্যবসা বাণিজ্য করবে, চাষ বাস করবে? কিভাবে দেশ চালাবে, সমাজ চালাবে? কিভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে? এসব নিয়ম কানুন ইসলামে রয়েছে। এসব নিয়ম কানুনকেই দীন বলা হয়। ইসলামকে দীন মেনে নেয়ার মানে হলো, ইসলাম মানুষের জীবনের সকল কাজ কারবার চালাবার জন্যে যে নিয়ম কানুন এবং বিধি বিধান দিয়েছে, সেগুলোকে মেনে নিয়ে, সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করা। মানুষের জীবনের ছোট বড় সকল কাজের ব্যাপারেই ইসলাম নিয়ম কানুন দিয়েছে। একেবারে পায়খানা পেশাব কিভাবে করতে হবে, তা থেকে নিয়ে রাষ্ট্র কিভাবে চালাতে হবে? এইসব ব্যাপারেই ইসলাম নিয়ম কানুন বলে দিয়েছে। আর এই গোটা নিয়ম কানুন ও বিধি ব্যবস্থার নামই হলো দীন ইসলাম বা ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপনের পথ। রসূল মানার অর্থ কি? এবার দেখা যাক, হাদীসে যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রসূল মানার কথা বলা হলো, তার আসল মর্ম কি? আসলে মুখে মুখে কেবল ইয়া রসূলাল্লাহ বললেই তাকে রসূল মানা হয়না। তাকে রসূল মানার অর্থ হলো, এই কথাগুলো মেনে নেয়া যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তার মাধ্যমে মানুষের কাছে জীবন যাপন করার সকল নিয়ম কানুন পাঠিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে, তা তিনি নিজের জীবন আমল করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি যা কিছু সত্য বলেছেন, তাই সত্য। আর যা কিছু মিথ্যা বলেছেন, তা সবই মিথ্যা। তিনি যা করতে বলেছেন, তাই করতে হবে। সেটাই ইসলাম। তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন, তা করা যাবে না। কারণ সেটা কুফরী। তিনি ইসলামের যে কাজ যেভাবে করেছেন, আমাদেরকেও সে কাজ ঠিক সেভাবে করতে হবে। এটাকেই বলে সুন্নতে রসূলের অনুসরণ করা। তিনিই সত্য মিথ্যার মাপকাঠি। সেই মাপকাঠিতে মেপেই সকল মুসলমানকে আমল করতে হবে। এই হচ্ছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রসূল মানার অর্থ। ইচ্ছা বাসনার দীনের অধীন করো হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৫. তোমাদের চিন্তা ভাবনা, কামনা বাসনা ও মতামত আমার নিয়ে আসা দীন ও শরীয়ত অনুযায়ী না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না। (মিশকাতঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর রাঃ) ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির বক্তব্য হলো, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ে আসা দীন ইসলাম অনুযায়ী নিজের চিন্তা ও জীবনকে গঠন করলেই প্রকৃত মুমিন হওয়া যাবে। তবে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করলে ইসলাম অনুযায়ী চিন্তা ও জীবন গঠন করা যায়না। কারণ কোনো জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে, সে জিনিসের আকাংখা করা এবং সে অনুযায়ী নিজের জীবন গড়া কেমন করে সম্ভব? জ্ঞানের পথে পা ফেলো প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৬.যে ব্যক্তি জ্ঞান লাভের জন্য কোনো পথ চলে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে বেহেশতের পথ সহজ করে দেন। (মুসলিম : আবু হুরাইরা রাঃ) ব্যখ্যা : হাদীসটি থেকে জানা গেলো, জ্ঞান লাভের কাজে বিরাট ফায়দা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা পড়ালেখা জানে না, তারা কিভাবে দীন ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে? হ্যা, যারা পড়ালেখা জানে, তাদের জন্যে জ্ঞানার্জন করা তো খুবই সহজ। আর যারা পড়ালেখা না শিখেই বড় হয়েছে, তারাও জ্ঞানার্জন করতে পারে। নবীর সাথীরা সবাই পড়ালেখা জানতেননা। এমনকি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও পড়ালেখা জানতেননা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহীর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেছেন। আর তার সাহাবীরা তার থেকে শুনে শুনে জ্ঞানার্জন করেছেন। পড়েও জ্ঞানার্জন করা যায়। শুনেও জ্ঞানার্জন করা যায়। সাহাবীগণ শুনেই জ্ঞানার্জন করেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৭. “(দীনের) জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ফরজ”। সাহাবীগন শুনে শুনেই এ ফরয আদায় করেছেন। বর্তমানেও যারা পড়ালেখা জানেননা, তাদেরকে শুনে শুনেই দীন ইসলামের জ্ঞানার্জন করতে হবে। যারা দীন সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান রাখেন, তাদের থেকেই দীন সম্পর্কে শুনতে হবে। আরেকটি হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৮. “যে জ্ঞান লাভের জন্যে চেষ্টা করে, তার এ কাজের দ্বারা তার অতীতের অপরাধসমূহ মাফ হয়ে যায়”। সুতরাং এতোদিন জ্ঞানার্জনের কথা চিন্তা না করে থাকলেও এখন থেকে শিশু কিশোর, শিক্ষিত অশিক্ষিত, পুরুষ নারী সকলকেই দীন ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানলাভের চেষ্টা করা একান্ত দরকার। যারা আমল করার নিয়তে দীন ইসলাম সম্পর্কে ইলম হাসিল করার চেষ্টা করবে, আল্লাহ তায়ালা এই নেক নিয়তের কারণে তাদের অতীত অবহেলার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। কুরআন শিখো কুরআন শিখাও তোমরা তো জানো গোটা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। আমাদের এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের তিনিই সৃষ্টি করছেন। তিনিই সমস্ত জ্ঞানের উৎস। আমরা কিভাবে জীবন যাপন করলে দুনিয়ায় শান্তি পাবো এবং পরকালে মুক্তি পাবো, জান্নাত পাবো, তা কেবল তিনিই জানেন। তিনি দয়া করে কুরআনের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন সঠিক জীবন যাপন করার পথ। তাই কুরআনকে জানা, বুঝা এবং মানা আমাদের সবচাইতে বড় কর্তব্য। এ কর্তব্য যারা পালন করে তাদের চাইতে উত্তম মানুষ আর হয় না। প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৯. “তোমাদের মাঝে সবচেয়ে ভালো মানুষ সে, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিখায়। (বুখারী : উসমান রাঃ) এসো কুরআন পথে এসো আলোর পথে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ১০. “এই কুরআন আল্লাহর রশি, অনাবিল আলো, নিরাময়কারী ও উপকারী বন্ধু। যে তাকে শক্ত করে ধরবে তাকে সে রক্ষা করবে। যে তাকে মেনে চলবে সে তাকে মুক্তি দেবে। (মুসতাদিরকে হাকিম : ইবনে মাসউদ) শিক্ষককে শ্রদ্ধা করো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ১১. “তোমরা জ্ঞান শিক্ষা করো এবং শিক্ষকদের প্রতি বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হও।” (তিবরানী : আবু হুরাইরা) সমানে সমান যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে চলে, আল্লাহর হুকুম পালন করে, সে তার প্রতিটি নেক কাজের জন্যেই আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাবে। কিন্তু যে অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে, আল্লাহর পথে চলতে বলে এবং দীনের শিক্ষা দান করে, সে কী পাবে? প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ১২. “যে ব্যক্তি ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে, সে ভালো কাজ সম্পাদনকারীর সমতুল্য (পুরস্কার পাবে)।” (তারগীব ও তারহীবঃ আবু হুরাইরা রাঃ) ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি মানুষকে সৎ ও কল্যাণের কাজে উদ্বুদ্ধ করে, পরকালে সে বিরাট লাভবান হবে। কারণ সে নিজের ভালো কাজরে পুরস্কার তো পাবেই, আবার সেই সাথে অন্যদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার পুরস্কারও পাবে। তার পুরস্কার হবে ডাবল। নামায পড়ো রীতিমতো কোন মুসলমান নামায ত্যাগ করতে পারেনা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ১৩. “যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করলো, সে কুফরী করলো।” (তিরমিযী) ব্যাখ্যাঃ অন্য হাদীসে প্রিয় নবী বলেছেন, নামায ত্যাগ করলে মুসলমান আর কাফিরের মধ্যে পার্থক্য থাকেনা। সুতরাং মুসলমান কোনো অবস্থাতেই এক ওয়াক্ত নামাযও ত্যাগ করবেনা। হাতে যতো কাজই থাকুক না কেন, যতো অসুবিধাই থাকুক না কেন, সময় মতো নামায পড়ে নিতে হবে। কারণ, নামায পড়া আল্লাহর হুকুম। নামায পড়লে ক্ষমা পাবে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের সুফল সম্পর্কে বলেছেনঃ ১৪. “আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি এই নামায গুলো আদায় করার জন্যে সুন্দরভাবে ওযু করে, প্রত্যেক ওয়াক্ত নামায সময়মতো পড়ে, ঠিক ঠিক মতো রুকু সিজদা করে আর আল্লাহর ভয়ে বিনীতভাবে নামায আদায় করে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব।” (আবু দাউদ) নামায পড়ো জামাত গড়ো জামাতে নামায পড়লে সওয়াব বেশী হয়। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ১৫. “একা একা নামায পড়ার চাইতে জামাতে নামায পড়ার মর্যাদা সাতাশ গুণ বেশী।” (মুসলিম : আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ) মানে জামাতে নামায পড়া লোকেরা পরকালে তাদের জামাতে নামায পড়ার জন্যে সাতাশ গুণ বেশী পুরস্কার পাবে। জামাত ছাড়লে শয়তান ঘেঁষে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাতের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন : ১৬. কোনো গ্রামে বা এলাকায় যদি তিনজন মুসলমানও থাকে, আর তার যদি নামাযের জামাত কায়েম না করে, তবে শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং জামাতে নামায় আদায় করা তোমাদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। কারণ, পাল ত্যাগ করা ভেড়াকে বাঘে খাইয়া ফেলে। (আবু দাউদ : আবু দারদা রাঃ) ব্যাখ্যাঃ হাদীসের উদাহরণটা খুব চমৎকার। কোনো ভেড়া পাল ত্যাগ করে যদি একা একা বিচ্ছিন্নভাবে চরতে যায়, তখন তাকে যেমন বাঘে খেয়ে ফেলা সহজ, তেমনি জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া লোককে ধোকা দেয়া শয়তানের পক্ষে খুবই সহজ। অর্থাৎ মুসলমান দলবদ্ধ থাকলে তাদের কাছে শয়তান ঘেষতে ভয় পায়। যাকাত করো পরিশোধ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত সম্পর্কে বলেছেনঃ ১৭. “আল্লাহ যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। যাকাত ধণীদের থেকে আদায় করা হবে আর দরিদ্রের মধ্যে বন্টন করা হবে।” (বুখারী মুসলিম) ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসে যাকাত সম্পর্কে তিনটি কথা পাওয়া গেলোঃ এক : যাকাত দেয়া ফরয। দুই : যাকাত ধনীদের থেকে আদায় করতে হয়। তিন : যাকাত গরীবদের মধ্যে বিতরন করতে হয়। ফসলের যাকাত উশর যাদের ফসলাদি উৎপন্ন হয়, তাদেরকে ফসলেরও যাকাত দিতে হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ১৮. “যে জমিতে বৃষ্টি, বর্ষার পানি এবং নদী নালার পানিতে বিনা সেচে ফসল জন্মে, কিংবা নদী বা খালের কাছে বলে সেচের প্রয়োজন হয়না, সেই জমিতে যে ফসল হয়, তার দশভাগের একভাগ যাকাত দিতে হবে। আর যেসব জমিত শেরমের মাধ্যমে সেচ করতে হয়, সেসব জমিতে যে ফসল হয়, তার বিশভাগের একভাগ যাকাত দিতে হবে। (বুখারী) • উশর মানে এক দশমাংশ বা দশভাগের এক ভাগ। রমযান মাসের রোযা রাখো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাসের রোযা সম্পর্কে বলেছেন : ১৯. “আল্লাহ্ এই মাসে (রমযান মাসে) রোযা রাখা ফরয করে দিয়েছেন।” (মিশকাত) রোযার পুরস্কার আল্লাহ্ নিজে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেনঃ “বান্দা আমার জন্যে রোযা রাখে, সুতরাং আমি নিজেই রোযাদারের পুরস্কার।” (মিশকাত) সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ নিজেই যদি রোযার পুরস্কার হন, তবে এর চাইতে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে কি? আল্লাহ বড়ই মেহেরবান। যে আল্লাহকে পায়, তার আর কি প্রয়োজন? রোযা রাখো মিথ্যা ছাড়ো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ২০. “যে ব্যাক্তি রোযা রেখেও মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা কাজকর্ম ছাড়তে পারলোনা, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (বুখারী) পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণ করো রসূলুল্লাহর বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন : ২১. “আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলামঃ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন সময়মতো নামায পড়া। আমি বললাম তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণ করা। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর পথে জিহাদ করা।” (বুখারী ও মুসলিম) ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি থেকে আমরা জানতে পারলাম, মহান আল্লাহর তিনটি অতি প্রিয় কাজের মধ্যে একটি হলো, বাবা মার সাথে সদ্ব্যবহার বা উত্তম আচরণ করা। আল্লাহ তায়ালা কুরাআন মজীদে কিন্তু পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ এবং তাদের সেবা করার হুকুমই দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ “আমি মানুষকে তার পিতা মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করার হুকুম দিয়েছি।” (আনকাবূত : ৮) কুরআনের আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেনঃ “তোমার প্রভু হুকুম দিচ্ছেনঃ তোমরা ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না। বাবা মার সাথে ভাল ব্যবহার করবে। তাদের কোনো একজন কিংবা দুজনই যদি বৃদ্ধ অবস্থায় তোমার কাছে থাকে, তবে (তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে) উহ্ পর্যন্ত বলবেনা। তাদেরকে ভৎর্সনা করবেনা। তাদের সাথে কথা বলবে সম্মানের সাথে। তাদের সাথে বিনয় ও নম্রতার আচরণ করবে। আর তাদের জন্যে এভাবে দোয়া করবেঃ প্রভু! এদের দুজনকেই দয়া করো, যেমন করে স্নেহ মমতার সাথে তারা শিশুকাল থেকে আমাকে প্রতিপালন করেছেন।” (বনী ইসরাইলঃ ২৩ -২৪) সূরা লুকমানে আল্লাহ্ পাক পিতা মাতা সম্পর্কে একথাটিও বলে দিয়েছেন যে, পিতা মাতা যদি মুশরিকও হয়, তবু এই পৃথিবীর জীবনে তাদের সাথে ভাল ব্যবহারই করবে। তবে তারা যদি তোমাকে শিরক কিংবা পাপের দিকে ডাকে, সে ডাকে সাড়া দেবেনা। বাবা মাকে কষ্ট দিওনা আবী বকরা নুফাঈ বিন হারিছ (রাঃ) বলেনঃ একদিন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বললেনঃ ২২. “আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ্ কি তা বলবো? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আমরা বললামঃ অবশ্যি, হে আল্লাহর রসূল। তিনি বললেনঃ ১. আল্লাহর সাথে শরীক করা ২. বাবা মাকে কষ্ট দেয়া। এ যাবত তিনি হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন: ৩. সাবধান মিথ্যা কথা বলা এবং ৪. মিথ্যা সাক্ষি দেয়া।” (বুখারী ও মুসলীম) পিতা মাতাকে কষ্ট দেয়া এতো বড় গুনাহ বলেই তো প্রিয় নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের সাবধান করে গেছেন। একবার এক ব্যক্তি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ ২৩. “ওগো আল্লাহর রসূল! সন্তানের উপর পিতা মাতার অধিকার কি? তিনি বললেনঃ তারা তোমার জান্নাত, আবার তারাই তোমার জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ : আবু উমামা রাঃ) ব্যাখ্যাঃ এ দুটি হাদীস থেকে জানা গেলো, পিতা মাতাকে কষ্ট দেয়া জাহান্নামে যাওয়ার কাজ। অপরদিকে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা জান্নাতে যাওয়ার কাজ। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি তার পিতা মাতার সাথে কেমন ব্যবহার করেছে, কিয়ামতের দিন এ বিষয়টির হিসাব নেয়া হবে। যেসব কারণে মানুষ জান্নাত বা জাহান্নামে যাবে তন্মধ্যে এটিও একটি বিবেচনার বিষয় হবে। দোয়া করো পিতা মাতার জন্যে প্রিয় নবীর সাথে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ২৪. “মানুষ যখন মরে যায়, তখন তার আমলও ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল (আমলনামায়) যোগ হতে থাকেঃ ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. কল্যাণময় শিক্ষা, ৩. এমন সৎ সন্তান যে মৃত পিতা মাতার জন্যে দোয়া করে।” (মুসলিম : আবু হুরাইরা) ব্যাখ্যাঃ ‘সদকায়ে জারিয়া’ মানে এমন জনসেবার কাজ, যা দ্বারা বছরের পর বছর মানুষ উপকৃত হয়। তাদ্বারা যতোদিন মানুষ উপকৃত হবে, ততোদিন এই সেবাদানকারীর আমল নামায় নেক আমল যোগ হবে। ‘কল্যাণময় শিক্ষা’ মানে এমন জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষকে দিয়ে যাওয়া এবং মানুষের মধ্যে প্রচার করে যাওয়া, যার ফলে মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আল্লাহর পথে চলতে থাকে। এ শিক্ষাদান থেকেও মৃত ব্যক্তির আমল নামায় নেক আমল যোগ হতে থাকবে। মৃত পিতা মাতার জন্যে সৎ সন্তানের দোয়াও আল্লাহ্ কবুল করেন। সৎ সন্তানের দোয়ায় মৃত পিতা মাতার নেক আমল বৃদ্ধি পায়। মুসলমান মুসলমানের ভাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ২৫. “মুসলমান মুসলামানের ভাই। এক মুসলমান ভাই তার আরেক মুসলমান ভাইয়ের প্রতি যুলুম করতে পারেনা। তাকে ঘৃনা করতে পারেনা। অপমান করতে পারেনা। যে ব্যক্তি মুসলমান ভাইকে ধৃণা করলো, বা ছোট মনে করলো, সে অত্যন্তখারাপ লোক। যে কোনো মুসলমানের রক্ত, অর্থ সম্পদ এবং মান ইজ্জত সকল মুসলমানের নিকট সম্মানিত।” (মুসলিম : আবু হুরাইরা রাঃ) সাহায্য করো দীনি ভাইকে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিদায়াত দিয়ে গেছেনঃ ২৬. “তোমার মুসলমান ভাইকে সাহায্য করো, সে যালিম হোক কিংবা মযলুম। একথা শুনে একজন লোক জিজ্ঞাসা করলো, ইয়া রসূলুল্লাহ মযলুমকে তো সাহায্য করতে পারবো, কিন্তু যালিমকে কিভাবে সাহায্য করবো? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যুলুম করা থেকে তাকে বিরত রাখাটাই তাকে সাহায্য করা।” ব্যাখ্যাঃ যে জুলুম করে, এই যুলম করাটা তার ক্ষতি বা গুনাহ। আর যুলুম না করাটা হলো নেক কাজ। যুলুম করা থেকে তাকে বিরত রাখার মাধ্যমে গুনাহ থেকে তাকে বাচানো হলো এবং নেক কাজে সাহায্য করা হলো। এটাই হচ্ছে যালিমকে সাহায্য করার অর্থ। সৎ ব্যবসায়ী অতি মহান নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ২৭. “সৎ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী পরকালে নবী,সিদ্দীক ও শহীদদের সাথে থাকবে।” (তিরমিযী : আবু সায়ীদ খুদরী রাঃ) ব্যাখ্যাঃ অনৈসলামী সমাজে সৎ পথে ব্যবসা করা যে খুব কঠিন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিকার মুসলমান ব্যবসায়ী কোনো অবস্থাতেই ব্যবসায়ে অসততা অবলম্বন করতে পারেনা। সততার সাথে ব্যবসা করার জন্যে তাকে সংগ্রাম করে যেতে হবে। তবেই হাদীসে বর্ণিত এই মর্যাদা লাভ করা যাবে। পরের জমির আইল ঠেলোনা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ২৮. “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমিও দখল করে নেয়, কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত স্তবক বেড়ী পরানো হবে। (বুখারীঃ সায়ীদ ইবনে যায়েদ রাঃ) ফল ফসল সদকা হবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ২৯. “কোনো মুসলমান যদি ফসলের ক্ষেত করে, কিংবা ফলের গাছ লাগায় আর তা থেকে মানুষ বা পশু পাখি যে আহার করে, সেটাকে ঐ মুসলমান ব্যক্তির সদকা হিসেবে আল্লাহ্ লিখে রাখেন। (মুসলিম) শ্রমের মর্যাদা জানো কি? সততার সাথে গায়ে খেটে যারা উপার্জন করে, তারা আল্লাহ্ তায়ালার ভালবাসা পায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩০. “আল্লাহ্ তায়ালা পরিশ্রম করে উপার্জনকারী মুমিনকে ভালবাসেন।” (তিবরানী) অন্য একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩১. “সার্বত্তোম রোজগার হলো, আল্লাহর পছন্দনীয় তরীকায় ব্যবসা করা এবং গায়ে খেটে উপার্জন করা।” (মুসনাদে আহমদ) স্বজন পোষণ দানের কাজ সৎ পথে উপার্জন করে নিজের সংসার চালালে তাতেও আল্লাহ্ তায়ালা সদকার সওয়াব দেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩২. “তোমার উপার্জন থেকে যা তুমি নিজে খাও, তাতে তোমার জন্যে দানের সওয়াব রয়েছে। যা তোমার সন্তানের জন্যে ব্যয় করো তাও তোমার একটি দান। যা বিবির জন্যে ব্যয় করো, তাও দান। যা চাকর বাকরের জন্যে ব্যয় করো, তাও সদকা। (তারগীব ও তারহীব : মিকদাম বিন মাদীকরব রাঃ) ধার করয দাও সবে আমরা এক সমাজে বাস করি। নিজেদের প্রয়োজনে টাকা পয়সা ধার করয নিই এবং ধার করয দিই। আমাদের এক ঘরের মেয়েরা আরেক ঘর থেকে নুন, তেল, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি ছোট খাটো ছোট খাট জিনিস ধার করয নেয়, দেয়। এইরূপ ধার করয দেয়ার মধ্যে কোনো সওয়াব আছে কি? হাঁ, অবশ্যি আছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩৩. “প্রত্যেকটা ধার করযাই একটি দান।”(তারগীব : ইবনে মাসউদ রাঃ) তিনি আরো বলেছেনঃ ৩৪. “কোনো মুসলমান তার মুসলমান ভাইকে একবার ধার দিলে, সে দুইবার দান করার সওয়াব পাবে। (ইবনে মাজাহ : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ) হিংসা করো ত্যাগ কোনো মুসলমানের অন্তরে হিংসা বিদ্বেষ থাকতে পারবেনা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাদীসে এ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ ৩৫. “তোমরা কিছুতেই পরস্পরেকে হিংসা করবেনা। কারণ, হিংসা মানুষের নেক আমলকে ঠিক সেইভাবে খেয়ে ফেলে, যেমন করে আগুন কাঠখড়ি খেয়ে ফেলে। (আবু দাউদ : আবু হুরাইরা রাঃ) দুঃখীজনে দয়া করো ৩৬. তোমাদের কেউ যদি আল্লাহর কাছে কিয়ামতের কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পেতে চায়, তবে সে যেনো অভাবী দেনাদারকে সময় দেয়, কিংবা নিজের পাওনা মাফ করে দেয়। ” (মুললিম : কাতাদা রাঃ) ব্যাখ্যাঃ ঋণগ্রস্থ লোক দুই প্রকার হয়ে থাকে। এক প্রকার ঋণগ্রস্থ লোক সত্যি অভাবী। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনা। এদেরকে সময় দেয়া উচিত, কিংবা এদের ঋণ মাফ করে দেয়া উচিত। আরেক প্রকার ঋণগ্রস্থ লোক তারা, যারা ঋণ পরিশোধের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করেনা। এরা খুবই খারাপ লোক। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করাটা কিন্তু খুবই শক্ত গুনাহ। ঋণ করো পরিশোধ কেউ যদি ঋণ করার পর তা পরিশোধ না করে, কিংবা পরিশোধ করার সামর্থ না থাকলে ক্ষমা চেয়ে না নেয়, তবে সে যদি আল্লাহর পথে শহীদও হয়ে যায়, তবু এই ঋণ পরিশোধ না করার গুনাহ তার মাফ হবেনা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩৭. “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তার সকল গুনাহই মাফ করে দেয়া হবে। তবে দেনার ব্যাপারটা মাফ করা হবেনা।” (মুসলিম : আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাঃ) আমানত করোনা খিয়ানত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩৮. “যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তুমি তার আমানত ফিরিয়ে দাও। আর যে তোমার খিয়ানত করেছে তুমি তার খিয়ানত করোনা।” (তিরমিযী : আবু হুরাইরা রাঃ) ঠকাবেনা ওয়ারিশকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৩৯. “যে ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশকে তার ওয়ারিশী থেকে বঞ্চিত করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তায়ালা তাকে বেহেশতের ওয়ারিশী থেকে বঞ্চিত করবেন।” (ইবনে মাজাহ : আনাস রাঃ) সুদের কাছে যেয়োনা কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা সুদ সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছেন। সুদের সাথে জড়িত হওয়া কবীরা গুনাহ। নবীর সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন : ৪০. “যারা সুদ খায়, যারা সুদ দেয়, যারা সুদের সাক্ষী হয় এবং যারা সুদের আদান প্রদান লেখে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সকলকে অভিশাপ দিয়েছেন।” (বুখারীঃ ইবনে মাসউদ রাঃ) ঘুষ দিয়ো না ঘুষ নিয়োনা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৪১. “ ঘুষদাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ।” (বুখারী : ইবনে উমর রাঃ) তিনি আরো বলেছেন : “ঘুষদাতা এবং ঘুষ দু’জনই জাহান্নামে থাকবে।” বাধা দাও অন্যায় কাজে বর্তমানে আমাদের সমাজে অন্যায়ে ভরে গেছে। অল্প কিছু লোক ছাড়া সমাজের বড় কর্তা থেকে আরম্ভ করে ছোট কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই অন্যায় কাজ কলে। এই সমাজে অন্যায় করা এবং অন্যায় পথে চলাই সহজ। অন্যায়কারীদের জন্যে সমাজে টিকে থাকাই কঠিন। কিন্তু একথা জেনে রাখা দরকার, কোনো সমাজে সত্যিকার মুসলমান থাকলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম করা কর্তব্য। মুসলমানরা যদি ইসলাম বিরোধী তাদের সংগ্রাম করা কর্তব্য। মুসলমানরা যদি ইসলাম বিরোধী কাজ না ঠেকায়, তবে তাদের ঈমান আছে বলেই ধরা যায়না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৪২.“তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় ও ইসলাম বিরোধী কাজ হতে দেখে তবে সে যেনো শক্তি প্রয়োগ করে তা ঠেকায়। আর তার যদি সেই শক্তি না থাকে, তবে যেনো মুখে নিষেধ ও সমালোচনা করে। এটাও করার অবস্থা যদি না থাকে, তবে সে যেনো মনে মনে সে কাজকে ঘৃণা করে এবং তার পরবির্তন চায়। আর এই মনে মনে ঘৃণা করাটা একেবারে দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।” (মুসলিম : আবু সায়ীদ খুদরী রাঃ) আদেশ দাও সৎ কাজের কোনো সমাজের ভালো লোকেরা যদি এক হয়ে সত্য ন্যায় ও সুকীর্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন না করে, তবে দুনিয়াতেই তাদের উপর চরম যুলম, নির্যাতন চলবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “ তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের নির্দেশ দিবে। অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। ভালো কাজে মানুষকে উৎসাহিত করবে। এ কাজগুলো যদি না করো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সকলকে কঠিন শাস্তিতে নিমজ্জিত করবেন। অথবা তোমাদের মধ্যে যারা দুষ্ট লোক, তাদেরকে তোমাদের কর্তা ও শাসক বানিয়ে দেবেন। তখন তোমাদের ভালো লোকেরা এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যে দোয়া করবে। কিন্তু তখন আর আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করবেনা।” (মুসনাদে আহমদ : হুযাইফা রাঃ) জোট বাঁধো জামাত গড়ো সমাজের অন্যায়কারীরা সব জোটবদ্ধ। এমতাবস্থায় ভালো লোকেরা একা একা কিভাবে তাদেরকে বাধা দেবে? আর তাদেরকে বাধা না দেয়ার ফলে তো আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিপদের কথা বলেছেন, তা আমাদের উপর চেটেই বসেছে। এমতাবস্থায় সত্যিকার মুসলমানদেরকে সংঘব্ধ হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তাদেরকে দলবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রিয় নবীও হাদীসে জামাতবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ ৪৪. “আমি তোমাদের পাঁটটি কাজের নির্দেশ দিচ্ছিঃ সেগুলো হলোঃ তোমরা জামাতবদ্ধ থাকবে। নেতার কথা শুনবে। নেতার আনুগত্য করবে। হিজরত করবে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। আর যে ব্যাক্তি জামাত থেকে এক বিঘতও বেরিয়ে যায়, সে পুনরায় জামাতে ফিরে না আসা পর্যন্ত যেনো ইসলামের রশি নিজের গলদেশ থেকে খুলে ফেললো।” (মুসনাদে আহমদ : হারেছ আশআরী রাঃ) ব্যাখ্যাঃ হিজরত শব্দের অর্থ ত্যাগ করা। এই হাদীসে হিজরত দু’টি অর্থ হতে পারেঃ (১) আল্লাহর নিষেধ করা কাজ ত্যাগ করা (২) নিজের দেশে যদি আল্লাহর হুকুম মতো চলার কোনো পথই না থাকে, তবে নিজের দেশে ত্যাগ করে এমন কোনো জায়গায় যাওয়া, যেখানে আল্লাহর হুকুম মতো চলার সুযোগ আছে। হাদীসে আমরা দেখলাম, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদ করারও হুকুম করেছেন। কিন্তু আমাদের জন্যে জিহাদ করা কি ফরয? আসলে জিহাদ করার কথা শুধু নবীই বলেননি, কুরআন পাকে আল্লাহও জিহাদ করার হুকুম করেছেন। জিহাদ মানে হলো আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা সংগ্রাম করা এবং কুরআন হাদীস অনুযায়ী সমাজ গড়ার আন্দোলন করা। যে দেশের আইন কানুন কুরআন হাদীস অনুযায়ী নয়, সেদেশে ইসলামের সুখী সমাজ গড়ার জন্যে জিহাদ বা আন্দোলন করা ফরয। তাছাড়া জিহাদ মানুষের শ্রেষ্ঠ আমল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ৪৫.“মানুষের সবচেয়ে ভালো আমল হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং ইসলামী সমাজ গড়ার আন্দোলন।” (মিশকাত) জিহাদ করো মুনাফিকী করোনা যে দেশে আল্লাহর দীন কায়েম নাই। আল্লাহর আইন কানুন মতো দেশ চলেনা। কোর্ট কাছারীতে আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার হয়না। কর্তা ব্যক্তিরা যুলম অন্যায় করে। সেই দেশের কোনো মানুষই পুরোপুরি হক পথে, মানে আল্লাহর পথে চলতে পারেনা। এই রকম দেশের মুসলমানদের উপর আল্লাহর আইন এবং সৎ লোকের শাসন কায়েম করার জন্যে জিহাদ করা ফরয। মুসলমান হয়ে কোনো ব্যক্তি একাজ না করলে সে বিরাট গুনাহগার হবে। এমন ব্যক্তিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাফিক বলেছেনঃ ৪৬. “যে ব্যক্তি জিহাদে শরীক না হয়ে এবং জিহাদে শরীক হবার কোনো চিন্তা না করে মারা গেলো, সে মুনাফিকী নিয়ে মৃত্যুবরণ করলো।” (মুসলিম : আবু হুরাইরা রাঃ) মুনাফিককে চিনে নাও প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ৪৭. “যার মধ্যে এই চারটি স্বভাব থাকবে, সে পূরো মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ চারটি কোনো একটি স্বভাব থাকবে, সে আংশিক মুনাফিক, যতোক্ষণ না সে এগুলো ত্যাগ করবে। স্বভাবগুলো হলোঃ ১. আমানত রাখা হলে সে খিয়ানত করে, ২. কথা বলার সময় মিথ্যা কথা বলে, ৩. ওয়াদা করলে তা খিলাফ করে এবং ৪. বিবাদকালে গালিগালাজ করে। (বুখারী মুসলিম : আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাঃ) ব্যাখ্যা : প্রশ্ন করা যেতে পারে, জিহাদ না করলে এ হাদীসের আলোকে কি কাউকে মুনাফিক বলা যেতে পারে? ব্যাপারটা হলো, আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের কাছে আল্লাহর কুরআন ও তার সুন্নাহ আমানত রেখে গেছেন। এখন যে ব্যক্তি মুসলমান হবার পরও কুরআন হাদীস মতো নিজে চলার এবং সমাজ গড়ার সংগ্রাম করলোনা। সেতো তার উপর অর্পিত আমানতের খিয়ানত করলো। মুসলমান হবার দাবী করে মিথ্যা কথা বললো এবং আল্লাহকে ইলাহ্ বা হুকুমকর্তা আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রসূল মানার যে ওয়াদা সে করেছে, তা খিলাফ করলো। এমতাবস্থায় সে মুনাফিক হবে নাতো কি হবে? যারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং এতোদিন যে দীন ইসলাম কায়েমের জিহাদ বা আন্দোলন শরীক হয় নাই, সেজন্যে তওবা করে এবং সাথে সাথে আন্দোলন শরীফ হয়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা তাদের সে গুনাহ মাফ করে দেবেন। আমাদেরও এই শপথ নেয়া দরকার যে, আমরা সবাই কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে ইসলামের সুখি সমাজ গড়ার জন্যে সংগ্রাম করে যাবো। আমাদের প্রিয় নবীর জীবনটাই জিহাদ করে কেটেছিলো। জিহাদ করে তিনি নিজ দেশে ইসলামী সমাজ কায়েম করে সে দেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। আর ইসলামকে বিজয়ী করাবার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা তাকে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং ইসলামকে বিজয়ী করাবর কাজে আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেক মুসলমানেরই অবশ্য কর্তব্য। নবীর দলে এসো যে ব্যক্তি সত্যিকার মুসলিম, সেই নবীর দল বা নবীর উম্মতের লোক। কিন্তু যে চারটি কাজ করবেনা, সে কিন্তু নবীর দলে যাবেনা। প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ৪৮. “সে আমার দলের লোক নয়, যে বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করেনা, ছোটদের দয়ামায়া ও স্নেহমমতা করেনা, আলো কাজ করতে বলেনা এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করেনা।”(তিরমিযী : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস) নিজের মর্যাদা বাড়াও সব মানুষই চায়, নিজের মর্যাদা বাড়ুক। কিন্তু মর্যাদা কিসে বাড়ে তা কি জানো? হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি একদিন তাঁর সাহাবীদের জিজ্ঞেস করেন? “আমি কি তোমাদের বলবো, কিসে মানুষের মর্যাদা বাড়ায়?” তাঁরা বললেনঃ “অবশ্যি বলুন, হে আল্লাহর রসূল!” তখন তিনি বললেন: ৪৯. “মর্যাদাদানকারী জিনিসগুলো হলোঃ ১. যে তোমার সাথে মুর্খের মতো ব্যবহার করবে, তুমি তার সাথে বিজ্ঞের মতো আচরণ করবে। ২. যে তোমার প্রতি অবিচার করবে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দেবে ৩. যে তোমাকে বঞ্চিত করবে, তুমি তাকে দেবে ৪. যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তুমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়বে।” (তারগীব ও তারহীব : উবাদা ইবনে সামিত) নবীর উপদেশ মেনে নাও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত সাহাবী মুয়ায বিন জাবাল (রা) বলেন, একদিন প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাতে ধরলেন। কিছু পথ চললেন। তারপর বললেনঃ ৫০. “মুয়ায! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছিঃ ১. আল্লাহকে ভয় করবার ২. সত্য কথা বলবার ৩. প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবার ৪. আমানত ফিরিয়ে দেবার ৫. খিয়ানত না করবার ৬. এতীমের প্রতি দয়া করবার ৭. প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করবার ৮. রাগ দমন করবার ৯. নম্র ভাষায় কথা বলবার ১০. সালাম বিনিময় করবার এবং ১১. নেতার সাথে লেগে থাকবার।” (তারগীব ও তারহীব : মুয়ায বিন জাবাল রাঃ) মুসলমানদের অধিকার জেনে নাও প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ৫১. “মুসলমানের উপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার আছে : ১. সাক্ষাত হলে তাকে সালাম দেবে ২. ডাকলে সাড়া দেবে ৩. উপদেশ চাইলে কল্যাণময় উদেশ দেবে ৪. হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে তুমি ‘ইয়ার হামকাল্লাহ’ বলবে ৫. রোগাক্রান্তহলে সেবা যত্ন করবে এবং ৬. মারা গেলে তার গোসল, জানাযা, কবর ইত্যাদির ব্যবস্থা করবে।” (মুসলিম : আবু হুরাইরা) ব্যাখ্যাঃ এগুলো মুসলমানের উপর মুসলমানের সামাজিক অধিকার। এই পারস্পরিক অধিকারগুলো পূর্ণ করার ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানেরই সচেতন থাকা উচিত। এই সব অধিকার পূর্ণ না করলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য। মুসলমানের উপর মুসলমানের অনেক অধিকার আছে। এই হাদীসে ছয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাত জাহান্নামের পরিচয় ৫২. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন। আল্লাহ যখন জান্নাত ও জাহান্নাম তৈরী করলেন, তখন জিব্রীলকে জান্নাতে পাঠালেন। বললেন, যাও জান্নাত দেখে এসো এবং জান্নাতবাসীদের জন্যে সেখানে আমি যেসব অনুগ্রহরাজি তৈরী রেখেছি, সেগুলোও দেখে এসো। জিব্রীল এলেন। জান্নাত দেখলেন। তিনি আরো দেখলেন যেসব নিয়ামত, যেগুলো জান্নাতবাসীদের জন্যে আল্লাহ তৈরী করে রেখেছেন্ এরপর আল্লাহর কাছে ফিরে এসে বললেন, তোমার ইযযতের শপথ করে বলছি, এমন জান্নাতের খবর যে শুনবে, সেই তাতে প্রবেশ না করে থাকবেনা। অতপর আল্লাহর নির্দেশে জান্নাতকে দুঃখকষ্ট ও বিপদ মুসীবত দিয়ে ঘিরে দেয়া হলো। এবার আল্লাহ বললেনঃ হে জিব্রীল! আবার যাও, গিয়ে জান্নাত আর জান্নাতবাসীদের জন্যে আমি তাতে যেসব জিনিস তৈরী করে রেখেছি দেখে এসো। জিব্রীল পুনরায় জান্নাত দেখতে। এসে দেখলেন, দুঃখকষ্ট আর বিপদ মুসীবত দিয়ে তাকে ঘিরে দেয়া হয়েছে।। এবার তিনি ফিরে এসে আল্লাহকে বললেন, আপনার মর্যাদার শপথ, আমার ভয় হচ্ছে কেউই এ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। অতপর আল্লাহ বললেনঃ এবার গিয়ে জাহান্নাম দেখে এসো এবং দেখে এসো (সেইসব ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা) যা তার অধিবাসীদের জন্যে তাতে তৈরী করে রেখেছি। তিনি গিয়ে জাহান্নামের (ভয়ংকর) দৃশ্য দেখলেন। ফিরে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ! তোমার ইযযতের কসম! যে-ই এ (ভয়ংকর) জাহান্নামের সংবাদ শুনবে, সে কখনো তাতে প্রবেশ করতে প্রস্তুত হবেনা। অতপর আল্লাহর নির্দেশে কামনা বাসনা ও লোভ লালসা দিয়ে জাহান্নামকে ঘিরে দেয়া হলো। এবার আল্লাহ্ বললেনঃ জিব্রীল! পুনরায় গিয়ে জাহান্নাম দেখে এসো। নির্দেশমতো তিনি গেলেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে আরয করলেনঃ তোমার ইযযতের কসম হে আল্লাহ! আমার আশংকা হচ্ছে সকল মানুষই জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কেউই তা থেকে রক্ষা পাবেনা। (তিরমিযী : আবু হুরাইরা) সার কথা : হাদীসটির সার কথা হলো এই যে, আল্লাহ জান্নাত ও জাহান্নাম তৈরী করে রেখেছেন। জান্নাতকে পরম সুখ ও আনন্দ এবং সীমাহীন নিয়ামত দ্বারা পরিপূর্ন করে রেখেছেন। কিন্তু তাকে চরম দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসীবত দিয়ে তিনি পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন তার পথ ভীষণ কন্টকাকীর্ণ। তা লাভ করার জন্যে প্রয়োজন কঠিন সাধনা, পরম ধৈর্য ও দৃড়তা। জাহান্নামকে বীভৎস ভয়াবহ আযাবের স্থানরূপে তৈরী করে রেখেছেন। কিন্তু লোভ লালসা ও কামনা বাসনা দিয়ে তা পরিবেষ্টিত করে দিয়েছেন। তার পথ বড়ই মনোহরী লোভনীয়। তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ও প্রয়োজনক কঠোর সাধনা এবং পরম ধৈর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বন। এসো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে কিয়ামতের দিন বিচার ফায়সালা হয়ে যাবার পর যারা বেহেশতী হবে, তারা যখন বেহেশতে চলে যাবে, তখন আল্লাহ তাদেরকে তার সব অনুগ্রহরাজি দান করবেন । তাদের প্রাপ্য সমস্ত পুরস্কার তাদের দান করবেন। তারা সেগুলো ভোগ করতে থাকবে। দারুন খুশী ও আনন্দের মধ্যে কাটাতে থাকবে। এরি মধ্যে আল্লাহ তাদের শুনাবেন আরো একটা বিরাট আনন্দের খবর। সেটি কি? হ্যাঁ শুনো তবেঃ ৫৩. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তায়ালা জান্নাতবাসীদের সম্বোধন করে বলবেনঃ হে জান্নাতবাসী! তারা জবাব দেবেঃ লাব্বায়িকা ওয়াসাদাইকা হে আমাদের রব! তিনি বলবেনঃ তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছো? তারা বলবেঃ হে আমাদের মালিক! আমরা কেন সন্তুষ্ট হবোনা? আপনি তো আমাদের এতো দিয়েছেন, যা আপনার অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেননি! তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমি এর চাইতেও উত্তম জিনিস তোমাদের দান করবো । তারা বলবেঃ ওগো আমাদের মনিব! তোমাদের প্রতি আমার সন্তোস চিরস্থায়ী করে দিলাম। আর কখনো আমি তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হবোনা। (সহীহ বুখারী : আবু সায়ীদ খুদরী) আল্লাহকে দেখতে চাও? ৫৪. “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন বেহেশতবাসীগণ বেহেশতে প্রবেশ করবে, তখন মহান আল্লাহ বলবেনঃ তোমরা আমার কাছে আরো অতিরিক্ত কিছু আশা করো কি? তারা বলবে, আমরা এর চেয়ে বেশী আর কি কামনা করতে পারি? আমাদের মুখমন্ডল কি হাস্যেজ্জ্বল করা হয়নি? আমাদেরকে কি জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়নি এবং (জাহান্নামের) আগুন থেকে মুক্তি দেয়া হয়নি? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অতপর আল্লাহ তা’য়ালা পর্দা সরিয়ে দেবেন। তখন তারা পরিষ্কার দেখতে পাবে মহান আল্লাহকে। বেহেশতের অধিবাসীদের কাছে আল্লাহকে দেখার চেয়ে অধিক প্রিয় কিছু আর তখন থাকবেনা। (সহীহ মুসলিম : সুহাইব)] এসো নূরের পথে ৫৫. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাতবাসীরা তাদের নিয়ামতরাজি উপভোগে নিমগ্ন থাকবে। হঠাঃ উপর থেকে তাদের প্রতি নূরের জ্যেতি এসে পড়বে। মাথা উঠিয়ে তাকাতেই তারা দেখতে পাবে উপর দিক থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তশরীফ এনেছেন। অতপর তিনি বলবেনঃ আসসালামু আলাইকুম হে জান্নাতবাসীরা! নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এটাই হচ্ছে কুরআনের নিম্নোক্ত বাণীর তাৎপর্যঃ দয়াময় রবের পক্ষ তাদের প্রতি সালাম দেয়া হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতপর আল্লাহ তাদের দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং তারাও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে। যতোক্ষণ তারা আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকবে ততোক্ষণ অন্য কোনো নিয়ামতের দিকে তাদের দৃষ্টি থাকবেনা। অতপর আল্লাহ্ ও তাদের মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি করে দেয়া হবে। কিন্তু তাদের উপর এবং তদের ঘর দোরে আল্লাহর নূর ও বরকত স্থায়ী হয়ে থাকবে। (ইবনে মাজাহ : জাবির) এসো আল্লাহর ছায়ায় ৫৬. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবেনা, সেদিন আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত সাত ব্যক্তিকে ছায়া দান করবেনঃ ১. সুবিচারক ন্যায়পরায়ণ নেতা, ২. ঐ যুবক, যে আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের জীবন যাপন করে বড় হয়েছে, ৩. ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর ঝুলে আছে মসজিদের সাথে, ৪. ঐ দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহকে খুশী করার জন্যে একে অপরকে ভালোবাসে, এ উদ্দেশ্যে তারা একত্র হয় আর এ উদ্দেশ্যেই বিছিন্ন হয়, ৫. ঐ ব্যক্তি, যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় সুন্দরীও আহবান জানালে সে বলেঃ আমি আল্লাহকে ভয় করি, ৬. ঐ ব্যক্তি, যে এমন গোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করে যে, তা তার ডান হাত কি ব্যয় করলো, তার বাম হাত পর্যন্ত জানেনা, ৭. আর ঐ ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রুপাত করে। (বুখারী, মুসলিম) নিজের মুক্তির ব্যবস্থা নিজে করো ৫৭. আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআনের এই আয়তটি নাযিল হলোঃ “আর তোমার আত্মীয় প্রতিবেশীদের সতর্ক করো” তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কুরাইশদের একত্র করে) বললেনঃ হে কুরাইশ! তোমরা নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাও। আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষার ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনোই উপকার করতে পারবোনা। হে আবদে মানাফের বংশধর! আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বিন্দু মাত্র রক্ষা করতে পারবোনা। হে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। আল্লাহর আযাব থেকে আপনাদের আমি বিন্দু মাত্র বাঁচাতে পারবোনা। হে রসূলের ফুফু সুফিয়া! পরকালে আল্লাহর শাস্তি থেকে আমি আপনাদের রক্ষা পারবোনা। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা! আমার ধন সম্পদ থেকে তোমার যা ইচ্ছে চেয়ে নিতে পারো। কিন্তু পরকালের আযাব থেকে (কেবল কন্যা হবার কারণে) তোমাকে আমি রক্ষা করতে পারবোনা। (সহীহ বুখারী) ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ হাদীস থেকে জানা গেলো, স্বয়ং নবী পাক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত তাঁর আত্মীয় স্বজনকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেননা, তারা যদি নিজেরাই নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা না করে। ঈমান ও আমল ছাড়া তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ পাওয়ার যোগ্য হতে পারেনা। অথচ বর্তমানে মুসলিম সমাজ শাফায়াত সংক্রান্তঅলীক ধারণা কল্পনার পিছে ছুটছে। তাদের এ ধারণা কল্পনা পূর্বতন জাহিলী যুগের অন্ধ অনুসরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এখানে কুরআন সুন্নাহর আলোকে সংক্ষিপ্তকারে শাফায়াতের সঠিক ধারণা পেশ করার প্রয়োজন মনে করছি। লিখেছেন আবদুস শহীদ নাসিম |
হাদীস পড়ো জীবন গড়ো
Labels: ইসলাম ।Diseño e iconos por N.Design Studio | A Blogger por Blog and Web