নবী (সাঃ)- ০১।

নবী (সাঃ) এর জীবনী ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হয়েছে (১+২+৩+৪+৫+৬+৭+৮)

জন্ম ও বাল্যকাল

বংশ পরিচিতি

হযরত মুহাম্মদ(স)-এর সম্মানিত পিতার নাম আব্দুল্লাহতিনি কবার মুতাওয়াল্লী আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ছিলেনতার বংশ-পরম্পরা উর্ধ্ব দিকে প্রায় ষাট পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছে ইব্রাহীম (আঃ)-তনয় হযরত ইসমাঈল(আ)-এর সাথে মিলিত হয়েছেতার খান্দানের নাম কুরাইশআরব দেশের অন্যান্য খান্দানের মধ্যে এটিই পুরুষানুক্রমে সবচেয় শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত খান্দান বলে পরিগণিত হয়ে আসছেআরবদেশের ইতিহাসে এই খান্দানের অনেক বড়ো বড়ো মান্য-গণ্য ব্যক্তির নাম দেখতে পাওয়া যায়এদের ভেতর আদনান, নাযার, ফাহার, কালাব, কুসসী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যকুসসী তার জামানায় কাবা শরীফের মুতাওয়াল্লী ছিলেন তিনি অনেক বড়ো বড়ো স্মরণীয় কাজ করে গেছেনযেমন : হাজীদের পানি সরবরাহ করা, তাদের মেহমানদারির ব্যবস্থা করা ইত্যাদিতার পরেও তার খান্দানের লোকেরা এই সকল কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেএসব জনহিতকর কাজ এবং কাবা শরীফের মুতাওয়াল্লী হবার কারণে কুরাইশরা সারা আরব দেশে অতীব সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ খান্দান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেসাধারণভাবে আরবে লুটতরাজ, রাহাজানি ইত্যাকার দুষ্কৃতি হিসেবে স্বীকতি প্রচলিত ছিল এবং এ কারণে রাস্তাঘাট আদৌ নিরাপদ ছিল নাকিন্তু কাবা শরীফের মর্যাদাও হাজীদের খেদমতের কারণে কুরাইশদের কাফেলার ওপর কখনো কেউ হামলা করতো নাতারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ব্যবসায়ের পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো

আব্দুল মুত্তালিবের দশটি (মতান্তরে বারোটি) পুত্র ছিলকিন্তু কুফর বা ইসলামের বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে পাঁচ জন মাত্র খ্যাতি লাভ করেনপ্রথম আব্দুল্লাহ, ইনি হযরত(স)-এর পিতাদ্বিতীয়,আবু তালিব; ইনি ইসলাম কবুল করেননি বটে,তবে কিছুকাল হযরতের সাহায্য ও পৃষ্টপোষকতা করেছেনতৃতীয়,হযরত হামযা(রা) এবং চতুর্থ,হযরত আব্বাস(রা)-এরা দুজনই ইসলামে সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন এবংইসলামের ইতিহাসে অতীব উচ্চ মর্যাদা লাভ করেনআর পঞ্চম হচ্ছে আবু লাহাব;ইসলামের প্রতি বৈরিতার কারণে ইতিহাসে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যকুরাইশদের একটি গোত্রের নাম হচ্ছে জাহারাএই গোত্রের ওহাব বিন আবদুল মানাফের কন্যা আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বিবাহ হয়সমগ্র কুরাইশ খান্দানের ভেতর ইনি একজন বিশিষ্ট মহিলা ছিলেনবিবাহকালে আবদুল্লাহর বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছরবিয়ের পর খান্দানী রীতি অনুযায়ী তিনি তিন দিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করেনঅতঃপর ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া গমন করেনফিরবার পথে মদিনা পর্যন্ত পৌঁছেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেনঐ সময় আমিনা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন

জন্ম তারিখ

ঈসায়ী ৫৭১ সালের ২০ এপ্রিল মুতাবেক ৯ রবিউল আওয়াল সোমবারের সুবহে সাদিকএই স্মরণীয় মুহূর্তে রহমতে ইলাহীর ফয়সালা মুতাবেক সেই মহান ব্যক্তিত্ব জন্ম গ্রহণ করলেন,সারা দুনিয়া থেকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার বিদূরিত করে হেদায়েতের আলোয় গোটা মানবতাকে উদ্ভাসিত করার জন্যে যার আবির্ভাব ছির একান্ত অপরিহার্য এবং যিনি ছিলেন কিয়ামত পর্যন্ত এই দুনিয়ায় বসবাসকারী সমগ্র মানুষের প্রতি বিশ্বপ্রভুর পরম আর্শিবাদ স্বরূপজন্মের আগেই এই মহামানবের পিতার ইন্তেকাল হয়েছিলতাই দাদা আবদুল মুত্তালিব এর নাম রাখলেন মুহাম্মদ(স)

শৈশবে লালন-পালন

সর্বপ্রথম হযরত(স)- এর স্নেহময়ী জননী আমিনা তাকে দুধ পান করানদু-তিন দিন পর আবু লাহাবের বাঁদী সাওবিয়াও তাকে স্তন্য দান করেনসে জামানার রেওয়াজ অনুযায়ী শহরের সম্ভান- লোকেরা তাদের সন্তান-সন্ততিকে দুধ পান করানো এবং তাদের লালন -পালনের জন্য গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দিতেনসেখানকার খোলা আলো-হাওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ভালো হবে এবং তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখতে পারবে বলে তারা মনে করতেনকেনা, আরবের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ভাষা অধিকতর বিশুদ্ধ বলে ধারণা করা হতোএই নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের মেয়েরা শহরে এসে বড়ো বড়ো অভিজাত পরিবারের সন্তানদের লালন- পালনের জন্যে সঙ্গে নিয়ে যেতোতাই হযরত(স)-এর জন্মের কয়েক দিন পরই হাওয়াযেন গোত্রের কতিপয় মহিলা শিশুর সন্ধানে মক্কায় আগমন করেনএদের হালিমা সাদিয়া নাম্নী এক মহিলাও ছিলেনএই ভাগ্যবতী মহিলা অপর কোন বড়ো লোকের শিশু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমিনার ইয়াতিম শিশু সন্তানকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন

দুবছর পর আমিনা তাঁর শিশু পুত্রকে ফেরত নিয়ে আসেন এর কিছুদিন পর মক্কায় মহামারী বিস্তার লাভ করলোতাই আমিনা তাকে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন সেখানে তিনি ছয় বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেন

হযরত (স)- এর বয়স যখন ছবছর, তখন আমিনা তাকে নিয়ে মদিনায় গমন করেন সম্ভবত স্বামীর কবর জিয়ারত অথবা কোন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করার জন্যে তিনি এই সফরে বের হনমদিনায় তিনি প্রায় এক মাস কাল অবস্থান করেনকিন্তু ফিরবার পথে আরওয়া নামক স্থানে তিনি মৃত্যু বরণ করেন এবং সেখানেই চিরতরে সমাহিত হন

আম্মার মৃত্যুর পর হযরত(স)-এর লালন-পালন ও দেখা শোনার ভার দাদা আবদুল মুত্তালিবের ওপর অর্পিত হয়তিনি হামেশা তাকে সঙ্গে-সঙ্গে রাখতেনহযরত(স)- এর বয়স যখন আট বছর,তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবও মৃত্যুবরণ করেনমৃত্যুকালে তিনি হযরত(স)-এর লালন পালনের ভার পুত্র আবু তালিবের ওপর ন্যস্ত করে যানতিনি এই মহান কর্তব্য অতীব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করেনআবু তালিব এবংআবদুল্লাহ (হযরতের পিতা)সহোদর ভাই ছিলেনএদিক দিয়েও হযরত(স)- এর প্রতি আবু তালিবের গভীর মমত্ব ছিলতিনি নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও হযরত(স)-কে বেশি আদায় যত্ন করতেনশোবার কালে তিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে নিয়ে শুইতেন;বাইরে বেরুবার সময়ও তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুতেন

হযরত(স)-এর বয়স যখন দশ-বারো বছর, তখন তিনি সমবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ছাগলও চরানআরবে এটাকে কোন খারাপ কাজ বলে মনে করা হতো নাভালো ভালো সম্ভান্ত ঘরের ছেলেরাও তখন মাঠে ছাগল চরাতো

আবু তালিব ব্যাবসায় করতেনকুরাইশদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার তিনি সিরিয়া যেতেনহযরত(স)-এর বয়স তখন সম্ভবত বারো বছর; এসময় একবার আবু তালিব সিরিয়া সফরের ইরাদা করলেনসফরকালীন কষ্টের কথা স্মরণ করে তিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেনকিন্তু হযরত(স)-এর প্রতি তার অত্যন্ত প্রগাঢ় মমতা ছিল; তাই সফরে রওয়ানা করার সময় তার সঙ্গে যাবার জন্যে হযরত(স) পীড়াপীড়ি শুরু করলে আবু তালিব তার মনে আঘাত দিতে পারলেন নাতিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে নিয়ে গেলেন

নবুয়্যাতের আগে

ফুজ্জারে যুদ্ধ

ইসলাম-পূর্বযুগে আরবদের মধ্যে এক সুদীর্ঘ ও অসমাপ্য ধারা বর্তমান ছিলএর ভেতর সবচেয়ে ভয়ংকর ও মশহুর ছিল ফুজ্জারের যুদ্ধএই যুদ্ধ কুরাইশ ও কায়েস গোত্রসমূহের মধ্যে সংঘটিত হয়এতে কুরাইশদের ভূমিকা ছির সম্পূর্ণ ন্যায়ানুগ ;তাই হযরত(স) ও কুরাইশদের পক্ষ থেকে এতে অংশগ্রহণ করেনকিন্তু তিনি করো ওপর আঘাত হানেন নি এ যুদ্ধে প্রথমে কায়েস এবং পরে কুরাইশরা জয়লাভ করেশেষ অবধি সন্ধি মারফত এর পরিসমাপ্তি ঘটে

হিলফুল ফুযুল

এভাবে অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে আরবের শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল লোকদের না ছিল দিনের বেলায় কোন স্বস্তি আর নাছিল রাত্রে কোন আরামফুজ্জারের যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু কল্যাণকামী লোক এর প্রতিকারের জন্যে একটা আন্দোলন শুরু করেনহযরত(স)-এর চাচা জুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব পরিস্থিতি দ্রুত শোধরাবার জন্যে বাস্তব ধর্মী কাজের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেনএর কিছু দিন পর কুরাইশ খান্দানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগন জমায়েত হয়ে নিম্নোক্ত চুক্তি সম্পাদন করেনঃ

১.আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো

২.পথিকের জান-মালের হেফাজত করবো

৩.গরীবদের সাহায্য করতে থাকবো

৪.মজলুমের সহায়তা করে যাবো

৫.কোনো জালেমকে মক্কায় আশ্রয় দেব না

এই চুক্তিতে হযরত(স) ও অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হননবুয়্যাতের জামানায় এ চুক্তি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন :আমাকে ঐ চুক্তির বদলে যদি একটি লাল রং-এর মূল্যবান উটও দেয়া হতো, তবু তা আমি কবুল করতাম নাআজো যদি কেউ এরুপ চুক্তির জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, তাতে সাড়া দিতে আমি প্রস্তুত

কাবা গৃহের সংস্কার

তখন কাবা গৃহের শুধু চারটি দেয়াল বিদ্যমান ছিলতার ওপর কোনো ছাদ ছিল নাদেয়ালগুলোও বড়জোর মানুষের দৈর্ঘ্য সমান উঁচু ছিলপরন্ত গৃহটি ছিল খূব নীচু জায়গায়শহরের সমস্ত পানি গড়িয়ে সেদিকে যেতোফলে পানি প্রতিরোধ করার জন্যে বাঁধ দেয়া হতোকিন্তু পানির চাপে বাঁধ বারবার ভেঙ্গে যেতো এবং গৃহ প্রাঙ্গনে পানি জমে উঠতোএভাবে গৃহটি দিন দিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলতাই গৃহটি ভেঙ্গে ফেলে একটি নতুন মজবুত গৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলসমগ্র কুরাইশ খান্দান মিলিতভাবে নির্মাণ কাজ শুরু করলো কেউ যাতে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত না হয় , সেজন্য বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা গৃহের বিভিন্ন অংশ ভাগ করে নিলোকিন্তু কাবা গৃহের দেয়ালে যখন হাজরে আসওয়াদস্থাপনের সময় এলো তখন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেধে গেলোপ্রত্যেক গোত্রই দাবি করছিল যে, এ খেদমতটি শুধু তারাই আঞ্জাম দেবার অধিকারী্‌ অবস্থা এতদূর গড়ালো যে, অনেকের তলোয়ার পর্যন্ত কোষমুক্ত হলোচারদিন পর্যন্ত এই ঝগড়া চলতে থাকলোপঞ্চম দিন আবু উম্মিয়া বিন মুগিরা নামক এক প্রবীণ ব্যক্তি প্রস্তাব করেন যে,আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি এখানে সবার আগে হাজির হবে,এর মিমাংসার জন্যে তাকেই মধ্যস্থ নিয়োগ করা হবেসে যা সিদ্ধান্ত করবে, তাই পালন করা হবেসবাই এ প্রস্তাব মেনে নিলো

পরদিন আল্লাহর কুদরতে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির ওপর সবার নজর পড়লো, তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ(স)ফয়সালা অনুযায়ী তিনি হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করতে ইচ্ছুক প্রতিটি খান্দান কে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে বললেন্ অতঃপর একটি চাদর বিছিয়ে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে তার ওপর রাখলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিগণকে চাদরের প্রান্ত ধরে পাথরটিকে ওপরে তুলতে বললেনচাদরটি তার নির্দিষ্ট স্থান বরাবর পৌছলে হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে স্থাপন করলেনএভাবে তিনি একটি সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিলেনএ সংঘর্ষে কতো খুন-খারাবী হতো,কে জানে!

এবার কাবার যে নয়া গৃহ নির্মিত হলো,তার ওপর যথারীতি ছাদও দেয়া হলো;কিন্তু পুরো ভূমির গৃহ নির্মাণের উপযোগী উপকরণ না থাকায় এক দিকের ভূমি কিছুটা বাইরে ছেড়ে দিয়ে নয়া ভিত্তি গড়ে তোলা হলোএই অংশটিকেই এখন হিত্তিমবলা হয়

ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ

আরবদের, বিশেষত কুরাইশদের পুরানো পেশা ছিল ব্যবসায় হযরত(স)-এর চাচা আবু তালিবও একজন ব্যবসায়ী ছিলেনএ কারণেই হযরত(স)-যখন যৌবনে পদার্পন করেন, তখনও তিনি ব্যবসায় কে অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করেনকিশোর বয়সে চাচার সঙ্গে তিনি ব্যবসায় উপলক্ষে যে সফর করেন,তাতে তার যথেষ্ঠ সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েএ ব্যাপারে তিনি লোকদের কাছে অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রতিপন্ন হলেনলোকেরা তার ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ মূলধন তার কাছে জমা করতে লাগলোপরন্ত ওয়াদা পালন,সদাচরণ ন্যায়পরায়ণতা,বিশ্বস্ততা ইত্যাদি কারণেও তিনি লোকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা অর্জন করলেনএমনকি, লোকেরা তাকে আস-সাদিক’(সত্যবাদী)আল-আমীন’(বিশ্বস্ত) বলে সাধারণভাবে অভিহিত করতে লাগলোব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া,বসরা, বাহরাইন ও ইয়েমেনে কয়েকবার সফর করেন

খাদীজার সাথে বিবাহ

তখন খাদীজা নামে আরবে এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মহিলা ছিলেনতিনি হযরত(স)- এর দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন ছিলেনপ্রথম বিবাহের পর তিনি বিধবা হন এবং দ্বিতীয় বিবাহ করেনকিন্তু কিছুদিন পর তার দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন এবং পুনরায় বিধবা হনতিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেনলোকেরা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে তাহিরা’(পবিত্রা) বলে ডাকতোতার আগে ধন-দৌলত ছিলতিনি লোকদের কে পুঁজি এবং পণ্য দিয়ে ব্যবসায় চালাতেন

হযরত(স)-এর বয়স তখন পঁচিশ বছরইতোমধ্যে ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি বহুবার সফর করেছেনতার সততা,বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রের কথা জনসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিলতার এ খ্যাতির কথা শুনে হযরত খাদীজা তার কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান : আপনি আমার ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে সিরিয়া গমন করুনআমি অন্যান্যদের কে যে হারে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি, আপনাকেও তা-ই দেবোহযরত(স)- তার এই প্রস্তাব কবুল করলেন এবং পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত গমন করলেন

খাদীজা হযরত(স)-এর অসামান্য যোগ্যতা ওঅতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে প্রায় তিন মাস পর তার কাছে বিয়ের পয়গাম প্রেরণ করেনহযরত(স)-তার পয়গাম মন্‌জুর করলেন এবং বিয়ের দিন-ক্ষণও নির্ধারিত হলোনির্দিষ্ট দিনে আবু তালিব, হযরত হামযা এবং খান্দানের অপরাপর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে হযরত(স) খাদীজার বাড়িতে উপস্থিত হলেনআবু তালিব বিয়ের খোতবা পড়লেনপাঁচ শো তালায়ী দিরহাম (স্বর্ণ-মুদ্রা) বিয়ের মোহরানা নির্ধারিত হলো

বিবাহকালে হযরত খাদীজার বয়স চল্লিশ বছর এবং তার পূর্বোক্ত দুই স্বামীর ঔরসজাত দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল

অসাধারণ ঘটনাবলী

দুনিয়ায় যতো বিশিষ্ট লোকের আবির্ভাব ঘটে তাঁদের জীবনে শুরু থেকেই অসাধারণ কিছু নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করা যায় এ দ্বারা তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা সহজেই অনুমান করা চলে একথা অবশ্য এমন সব লোকের বেলায়ই প্রযোজ্য,যারা পরবর্তী কালে কোন বিশেষ খান্দান,কওম বা দেশের উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধন করে থাকেনকিন্তু যে মহান সত্তাকে কিয়ামত অবধি সারা দুনিয়ার নেতত্বের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যাকে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পূর্ণ সংস্কারের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে,তার জীবন-সূচনায় এমন অসাধারণ নিদর্শনাবলী তো প্রচুর পরিমাণে দৃষ্টিগোচর হওয়ায় স্বাভাবিকতাই স্বভাবই তার জীবনী গ্রন্থগুলোয় এ ধরণের নিদর্শনাবলীর প্রচুর উল্লেখ দেখা যায়কিন্তু যে সকল ঘটনা প্রামাণ্য বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতসহ উল্লিখিত হয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলোঃহযরত(স) বলেছেনঃ আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তার দেহ থেকে একটি আলো নির্গত হয়েছে এবং তাতে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছেবহু রেওয়ায়েত থেকে এ-ও জানা যায় যে, তখন ইহুদী ও খ্রিষ্টান এক নতুন নবীর আগমন প্রতিক্ষায় ছিল এবং এ ব্যাপারে তারা নানা রকম ভবিষ্যত বাণী করেছিল

রাসূল (স)-এর বাল্যকালের একটি ঘটনাতখন কাবা গৃহ কিছুটা সংস্কার কার্য চলছিল এবং এ ব্যাপারে বড়োদের সাথে ছোট ছোট ছেলেরাও ইট বহণ করে নিয়ে যাচ্ছিলএই ছেলেদের মধ্যে হযরত (স) এবং চাচা হযরত আব্বাসও ছিলেনহযরত আব্বাস তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃতোমার লুঙ্গি খূলে কাঁধের ওপর নিয়ে নাও, তাহলে ইটের চাপে ব্যথা পাবে নাতখন তো বড়োরা পর্যন্ত নগ্ন হতে লজ্জানুভব করতো নাকিন্তু হযরত(স) যখন এরুপ করলেন, নগ্নতার অনুভূতিতে সহসা তিনি বেহঁশ হয়ে পড়লেনতার চোখ দুটো ফেটে বের হয়ে যাবার উপক্রম হলোসম্ভিত ফিরে এলে তিনি শুধু বলতে লাগলেনঃআমার লুঙ্গি আমার লুঙ্গি লোকেরা তাড়াতাড়ি তাকে লুঙ্গি পরিয়ে দিলকিছুক্ষণ পর আবু তালিব তার অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বললেনঃআমি সাদা কাপড় পরিহিত এক লোককে দেখতে পাইসে আমাকে বললো, শিগগির সতর আবৃত করসম্ভবত এই প্রথম হযরত(স) গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান

আরবে তখন আসর জমিয়ে কিসসা বরার একটা কুপ্রথা চালু ছিললোকেরা রাত্রি বেলায় কোন বিশেষ স্থানে জমায়েত হতো এবং কাহিনীকাররা রাতের পর রাত তাদের নানারুপ উদ্ভট কিস্‌সা-কাহিনী শোনাতোবাল্য বয়সে হযরত(স)একবার এই ধরণের আসরে যোগদান করার ইরাদা করেনকিন্তু পথিমধ্যে একটা বিয়ে মজলিস দেখার জন্যে তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং পরে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েনঅতঃপর চোখ মেলে দেখেন যে ভোর হয়ে গেছেএরুপ তার জীবনে আরো একবার সংঘটিত হয়এভাবে আল্লাহ তাআলা তাকে কুসংসর্গ থেকে রক্ষা করেন

রাসূল(স) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, তখন মক্কা মূর্তি-পূজার সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিলখোদ কাবা গৃহে তখন তিন শষাটটি মূর্তির পূজা হতো এবং তার নিজ খান্দানের লোকেরা অর্থা কুরাইশরাই তখন কাবার মুতাওয়াল্লী বা পূজারী ছিলেনকিন্তু এতদ সত্ত্বও হযরত(স) কোনদিন মূর্তির সামনে মাথা নত করেন নি এবং সেখানকার কোন মুশরিকী অনুষ্ঠানেও অংশ নেন নিএছাড়া কুরাইশরা আর যে সব খারাপ রসম-রেওয়াজে অভ্যস্ত ছিল, তার কোন ব্যাপারে হযরত(স) কোনদিন তার খান্দানের সহযোগিতা করেন নি

নবুয়্যাতের সূচনা

হযরত(স) এর বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছলোতার জীবনে এবার আর একটি বিপ্লবের সূচনা হতে লাগলোনির্জনে বসে একাকী আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা এবং আপন সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় তিনি মশগুল হয়ে পড়লেনতিনি ভাবতে লাগলেনঃ তার কওমের লোকেরা কিভাবে হাতে-গড়া মূর্তিকে নিজেদের মাবুদ ও উপাস্য বানিয়েছেনৈতিক দিক থেকে তারা কত অধঃপাতে পৌঁছেছে!তাদের এই সব ভ্রান্তি কি করে দূরীভূত হবে?খোদা-পরস্তির নির্ভুল পথ কিভাবে তাদের দেখানো যাবে? এই বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত স্রষ্টা মালিকের বন্দেগী করা উচিত? এমন অসংখ্য রকমের চিন্তা ও প্রশ্ন তার মনের ভেতর তোলপাড় করতে লাগলোঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এসব বিষয়ে তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন

হেরা গুহায় ধ্যান

মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালূন নূর-এ হেরানামে একটি পর্বত-গুহা ছিলহযরত(স) প্রায়শই সেখানে গিয়ে অবস্খান করতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা-ভাবনা ও খোদার ধ্যানে মগ্ন থাকতেনসাধারণত খানাপিনার দ্রব্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতেনকখনো কখনো হযরত খাদীজা(র) ও তা পৌঁছে দিতেন

সর্ব প্রথম ওহী নাযিল

এভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেলহযরত চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেনএকদা তিনি হেরা গুহার ভেতর যথারীতি খোদার ধ্যানে মশগুল রয়েছেন্‌ সময়টি তখন রমজান মাসের শেষ দশকসহসা তার সামনে আল্লাহর প্রেরিত এক ফেরেশতা আত্নপ্রকাশ করলেনইনি ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ জিবরাঈল(আ) ইনিই যুগ যুগ ধরে আল্লাহর রাসূলদের কাছে তার পয়গাম নিয়ে আসতেন

হযরত জিবরাঈল(আ) আত্নপ্রকাশ করেই হযরত(স)-কে বললেনঃপড়োতিনি বললেনঃআমি পড়তে জানি নাএকথা শুনে জিবরাঈল(আ) হযরত(স)-কে বুকে জড়িয়ে এমনি জোরে চাপ দিলেন যে, তিনি থতমত খেয়ে গেলেনঅতঃপর হযরত(স)-কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃপড়োকিন্তু তিনি আগের জবাবেরই পুনরুক্তি করলেনজিবরাঈল(আ) আবার তাকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেনঃপড়োএবারও হযরত(স)জবাব দিলেনঃআমি পড়তে জানি নাপুনর্বার জিবরাঈল(আ) হযরত(স)-কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ{1} خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ{2} اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ{3} الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ{4} عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ{5}

পড়ো তোমার প্রভুর(রব) নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন;সৃষ্টি করেছেন জমাট-বাঁধা রক্ত থেকেপড়ো এবং তোমার প্রভু অতীব সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেনতিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানতো না

এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী নাযিলের ঘটনাএ ঘটনার পর হযরত(স) বাড়ি চলে গেলেনতখন তার পবিত্র অন্তঃকরণে এক প্রকার অস্থিরতা বিরাজ করছিলতিনি কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা (রা) কে বললেনঃআমাকে শিগগির কম্বল দ্বারা ঢেকে দাওখাদীজা(রা) তাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেনঅতঃপর কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তিনি খাদীজা (রা)-এর কাছে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করলেন;বললেনঃ আমার নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছেখাদীজা(রা) বললেনঃনা, কক্ষনোই নয়আপনার জীবনের কোন ভয় নেইখোদা আপনার প্রতি বিমুখ হবেন নাকেননা আত্মীয়দের হক আদায় করেন;অক্ষম লোকদের ভার-বোঝা নিজের কাঁধে তুরে নেন;গরীব-মিসকিনদের সাহায্য করেন;পথিক-মুসাফিরদের মেহমানদারী করেনমোটকথা, ইনসাফের খাতিরে বিপদ- মুসিবতের সময় আপনিই লোকদের উপকার করে থাকেন

এরপর খাদীজা(রা) হযরত(স)-কে নিয়ে প্রবীণ খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা অরাকা বিন নওফেলের কাছে গমন করলেনতিনি তাওরাত সম্পর্কে খুব ভালো পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেনহযরত খাদীজা(রা) তার কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেনতিনি সব শুনে বললেনঃ এ হচ্ছে মূসার ওপর অবতীর্ণ সেই নামূস’(গোপন রহস্যজ্ঞানী ফেরেশতা)হায়! তোমার কওমের লোকেরা যখন তোমাকে বের করে দেবে, তখন পর্যন্ত আমি যদি জিন্দা থাকতাম! হযরত(স) জিজ্ঞেস করলেনঃ আমার কওমের লোকেরা কি আমায় বের করে দেবে? অরাকা বললেনঃ তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো, তা নিয়ে ইতঃপূর্বে যে-ই এসেছে, তার কওমের লোকেরা তার সঙ্গে দুশমনি করেছেআমি যদি তখন পর্যন্ত জিন্দা থাকি, তাহলে তোমায় যথাসাধ্য সাহায্য করবোএর কিছুদিন পরই অরাকার মৃত্যু ঘটে

এরপর কিছুদিন জিবরাঈলের আগমন বন্ধ রইলোকিন্তু হযরত(স) যথারীতি হেরা গুহায় যেতে থাকলেনএই অবস্থা অন্তত ছয়মাস চলতে থাকলোএই বিরতির ফলে কিছুটা ফায়দা হলোমানবীয় প্রকৃতির দরুণ তার অন্তরে ওহী নাযিলের ঔসুক্য সঞ্চারিত হলোএমন কি, এই অবস্থা কিছুটা বিলম্বিত হলে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে জিবরাঈলের আগমন শুরু হলোতবে ঘন ঘন নয়,মাঝে মাঝেজিবরাঈল এসে তাকে এই বলে প্রবোধ দেন যে,আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল মনোনীত হয়েছেনএরপর হযরত(স) শান্ত চিত্তে প্রতিক্ষা করতে লাগলেনকিছুদিন পর জিবরাঈল ঘন ঘন আসা শুরু করলেন

হেরা গুহায় প্রথম ওহী নাযিলের পর কিছুদিন পর্যন্ত আর কোন ওহী আসেনিএরপর সূরা মুদ্দাসিরের প্রারম্ভিক আয়াতসমূহ নাযিল হলো-

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ{1} قُمْ فَأَنذِرْ{2} وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ{3} وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ{4} وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ{5} وَلَا تَمْنُن تَسْتَكْثِرُ{6} وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ{7}

হে কম্বল আচ্ছাদনকারী ওঠো এবং (ভ্রষ্টাচারী লোকদেরকে)ভয় দেখাওআর আপন প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেবাস-পোশাক পরিষ্কার রাখো এবং নোংরামী ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকোবেশি পাওয়ার উদ্দেশ্যে কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না এবং আপন প্রভুর খাতিরে বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করো

নবুয়্যাতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবার এটা ছিল সূচনা মাত্রএবার তিনি যথারীতি হুকুম পেলেন যে,ওঠো এবং ভ্রষ্ঠ মানবতাকে কল্যাণ দেখাও লোকদের কে সতর্ক করে দাও যে, সফলতার পথ মাত্র একটি এবং তা হচ্ছে এক খোদার বন্দেগী ও আনুগত্যযারা এই পথ অবলম্বন করবে, পরিণামে তারাই সফলকাম হবে আর যারা এ ছাড়া অন্য পথ অবলম্বন করতে চায়,তাদের কে আখিরাতে মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখাওতাদের কে বল, মানুষের জীবন-ধারা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত শুধুমাত্র এক খোদার বন্দেগী,তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের স্বীকৃতির ওপরএকমাত্র এভাবেই মানুষ সর্ববিধ প্রকাশ্য নাপাকী ও গোপন নোংরামী থেকে বেঁচে থাকতে পারেপক্ষান্তরে খোদা ছাড়া অন্যান্য শক্তির বন্দেগী হচ্ছে ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার মূলীভূত কারণএকইভাবে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সদ্ব্যবহার ও সদাচরণ করা উচিত;সে সদাচরণের বুনিয়াদ কোন পার্থিব স্বার্থ কিংবা লালসার ওপর স্থাপিত হওয়া উচিত নয়

সংগ্রামের দুই পর্যায়

এখান থেকে হযরত(স)-এর জীবনের সংগ্রামী পর্যায় শুরু হলোএই পর্যায়কে আমরা দুটি বড়ো বড়ো অংশে ভাগ করতে পারিএক :হিজরতের পূর্বে মক্কায় অতিবাহিত অংশ;যাকে বলা হয় মক্কী পর্যায়দুই :হিজরতের পর মদিনায় অতিক্রান্ত অংশ;একে বলা হয় মাদানী পর্যায়প্রথম পর্যায তের বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় দশ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল

প্রথম পর্যায় :মক্কী জীবন

হযরত(স)-এর সংগ্রামী জীবনের এই পর্যায় তার নিজস্ব পরিণতির দিক দিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণপ্রকৃতপক্ষে এই পর্যায়েই ইসলামের ক্ষেত্র কর্ষিত হয়এই পর্যায়ে মানবতার এমন সব উন্নত নমুনা তৈরি হয়,যাদের কল্যাণে উত্তর কালে ইসলামী আন্দোলন সারা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়ে

বর্তমানে যে সব ইতিহাস ও নবী-চরিত পাওয়া যায়, তার কোথাও মক্কী পর্যায়ের বিস্তৃত ঘটনা দেখা যায় নাতাই এ পর্যায়ের গুরুত্ব এবং শিক্ষামূলক ঘটনাবলী অনুধাবণ করতে হলে কুরআনের মক্কী অংশ গভীর ভাবে অধ্যয়ন করা দরকারপ্রকৃতপক্ষে, এই পর্যায়ের সঠিক গুরুত্ব ঠিক তখন উপলব্ধি করা সম্ভব,যখন মক্কী সূরাসমূহের প্রকাশ-ভঙ্গি, তখনকার পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর বর্ণনা, তওহীদ ও আখিরাতের প্রমাণাদি, জীবন ও চরিত্র গঠনের নির্দেশাবলী এবং হক ও বাতিলের চরম সংঘাতকালে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে মুষ্টিমেয় কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনার বিবরণ সামনে আসবে

মক্কী জীবনের চার স্তর

হিজরতের পূর্বে হযরত(স) তার পবিত্র জীবনের যে অংশ মক্কায় অতিবাহিত করেন এবং যা ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত হয, তাকে আপন বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে চারটি স্বতন্ত্র বিভক্ত করা যায়

প্রথম স্তর :নবুয়্যাতের পর প্রায় তিন বছরকাল;এ সময়ে দাওয়াত ও প্রচারের কাজ গোপনে আঞ্জাম দেয়া হয়

দ্বিতীয় স্তর :নবুয়্যাতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর প্রায় দুবছরকালএ স্তরের প্রথম দিকে আন্দোলনের কিছু বিরোধিতা করা হয়এরপর ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, নানারুপ অপবাদ দিয়ে, মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে এবং বিরুদ্ধ কথাবার্তা বলে তাকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়

তৃতীয় স্তর :এতদসত্ত্বেও যখন ইসলামী আন্দোলন দৃঢ়ভাবে সামনে এগুতে থাকে, তখন জুলুম নির্যাতনের শুরু হয়মুসলমানের ওপর নিত্য- নতুন জোর-জুলুম চলতে থাকে এই অবস্থা প্রায় পাঁচ- ছয় বছরকার অব্যাহত থাকেএ সময় মুসলমানদের নানারুপ বিপদ-মুসিবতের সম্মুখীন হতে হয়

চতুর্থ স্তর :আবু তালিব হযরত খাদিজা(রা)-এর ওফাতের পর থেকে হিজরত পর্যন্ত প্রায় তিন বছরকারএ স্তরটি হযরত(স) এবং তার সঙ্গীদের জন্যে অত্যন্ত কঠিন সংকটকাল ছিল

প্রথম স্তর :গোপন দাওয়াত নবুয়্যাতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবার পর হযরত(স)-এর সামনে প্রথম সমস্যা ছিলোঃএক খোদার বন্দেগী কবুল করার ও অসংখ্য মিথ্যা খোদার অস্তিত্ব অস্বীকার করার দাওয়াত প্রথম কোন ধরণের লোকদের দেওয়া যাবে?দেশ ও জাতির লোকদের তখন যে অবস্থা ছিল,তার একটি মোটামুটি চিত্র ইতঃপূর্বে পেশ করা হয়েছেএহেন লোকদের সামনে তাদের মেজাজ,পসন্দ ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত কোন জিনিস পেশ করা বাস-বিকই অত্যন- কঠিন কাজ ছিলতাই যে সব লোকের সঙ্গে বতেদিন হযরত(স) এর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং যারা তার স্বভাব প্রকৃতি ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সারাসরি অবহিত ছিলেন, তাদেরকেই তিনি সর্ব প্রথম দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করলেনকারণ, এরা হযরত(স)-এর সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিলেন এবং তিনি কোন কথা বললে তাকে সরাসরি অস্বীকার করা এদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল নাএদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত খাদীজা(রা)তারপর হযরত আলী(রা), হযরত জায়েদ(রা), হযরত আবু বকর(রা) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারেআলী(রা) হযরত(স)-এর চাচাতো ভাই,জায়েদ(রা) গোলাম এবং আবু বকর(রা) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেনএরা বছরের পর বছর ধরে হযরত(স)-এর সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেনতাই সর্ব প্রথম হযরত খাদীজা(রা) এবং পরে অন্যান্যদের কাছে তিনি দাওয়াত পেশ করেনএরাই ছিলেন ঊম্মাতের মধ্যে পয়লা ঈমান্দার -ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত প্রথম ভাগ্যবান দলএরা হযরত(স)-এর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই তার সত্যতা স্বীকার করেনএদের পর হযরত আবু বকর(রা)-এর প্রচেষ্টায় হযরত উসমান(রা), হযরত জুবাইর(রা), হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ(রা), হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস(রা) হযরত তালহা(রা) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণ করেনএভাবে গোপনে গোপনে ইসলামের দাওয়াত ছড়াতে লাগলোএবং মুসলমানের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো

কুরআনের অনন্য প্রভাব

এপর্যায়ে কুরআনের যে অংশগুলো নাযিল হয়েছিল, তা ছিল আন্দোলনের প্রথম স্তরের উপযোগী ছোট-খাটো বাক্য সমন্বিতএর ভাষা ছির অতীব প্রাঞ্জল, কবিত্বময়, ও হৃদয়গ্রাহীপরন্ত এতে এমন একটা সাহিত্যিক চমক ছির যে, শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং এক একটি কথা তীরের ন্যায় বিদ্ধ হতোএসব কথা যে শুনতো তার মনেই প্রভাব বিস্তার করতো এবং বারবার তা আবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগতো

আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধন

কুরআন পাকের এই সূরাগুরোতে তওহদি ও আখিরাতের তাপর্য বর্ণনা করা হচ্ছিলএ ব্যাপারে এমন সব প্রমানাদি পেশ করা হচ্ছিল, যা প্রতিটি শ্রোতার মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিলএসব দলিল প্রমাণ শ্রোতাদের নিকটতম পরিবেশ থেকেই পেশ করা হচ্ছিলপরন্ত এসব কথা এমন ভঙ্গিতে পেশ করা হচ্ছিল, যে সম্পর্কে শ্রোতারা পুরোপুরি অভ্যস্ত ও অবহিত ছিলতাদেরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছিলআকিদা-বিশ্বাসের যে সব ভ্রান্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল ছিল, সেগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হচ্ছিল্‌ এ কারণেই খোদার এই কালাম শুনে কেউই প্রভাবিত না হয়ে পারছিল নাখোদার নবী প্রথমে একাকীই এই আন্দোরন শুরু করেছিলেনকিন্তু কুআনের এই প্রাথমিক আয়াতসমূহ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেফলে গোপনে গোপনে আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করতে থাকে

এ পর্যায়ে দাওয়াত প্রচারের জন্যে তওহীদ ও আখিরাতের দলিল-প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে এই বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে খোদ হযরত(স)-কে কিভাবে আত্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং কি কি পন্থা তাকে অবলম্বন করতে হবে সে সম্পর্কেও তাকে সরাসরি শিক্ষাদান করা হচ্ছিল

চুপিসারে নামায

এ পর্যন্ত সবকিছু গোপনে গোপনেই হচ্ছিল্‌ নেহাত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোক ছাড়া বাইরের কারো কাছে কোন কিছু যাতে ফাঁস না হয়ে যায়, সেজন্যে হামেশা সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিলনামাযের সময় হলে হযরত(স) আশেপাশের কোন পাহাড়ের ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং সেখানে নামায আদায় করতেনএকবার তিনি হযরত আলী(রা) কে সঙ্গে নিয়ে কোন এক জায়গায় নামায পড়ছিলেনএমন সময় তার চাচা আবু তালিব ঘটনাক্রমে সেখানে এসে হাজির হলেনতিনি অনেকক্ষণ ধরে ইবাদতের এই নতুন পদ্ধতি তাজ্জবের সাথে লক্ষ্য করলেননামায শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ এটা কোন ধরণের দ্বীনহযরত(স) জববি দিলেনঃআমাদের দাদা ইবরাহীম(আ)-এর দ্বীনআবু তালিব বললেনঃবেশ, আমি যদিও এটা গ্রহণ করতে পারছি না, তবে তোমাকে পালন করার পুরো অনুমতি দিলামকেউ তোমার পথে বাদ সাধতে পারবে না