নবী (সাঃ) এর জীনব কথা।

জন্ম

হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহন করেনতাঁর জন্মের তারিখ ছিল ১২ ই রবিউল আউয়াল, ইংরেজি সন মোতাবেক ৫৭০ খৃস্টাব্দেপ্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মন্টগোমারি ওয়াট তার পুস্তকে ৫৭০ সনই ব্যবহার করেছেনতবে নবীর প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা বেশ কষ্টসাধ্যএজন্যই এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছেযেমন এক বর্ণনা মতে তাঁর জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিলসাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ (সাঃ) পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছেতবে শেষোক্ত মতই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশী নির্ভরযোগ্যযাই হোক, নবীর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই

শৈশব ও কৈশোর কাল

তত্কালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরীর জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেনএই রীতি অনুসারে মোহাম্মদ (সাঃ)কেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হনতখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য - শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেনদুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদ (সাঃ)কে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেনকিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতেএতে তার আশা পূর্ণ হলইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে - একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেনছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটানএই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেনসম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিলআমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেনতিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেনএকমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেনমাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেনএর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের (সাঃ) দেখাশোনা করতে থাকেনমোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যানমৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে মোহাম্মদের (সাঃ) দায়িত্ব দিয়ে যান

আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেনমুহাম্মাদের (সাঃ) বয়স যখন ১২ ব্ছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেনপ্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননাযাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেনসে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিলকথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেনতিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেনএ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে (সাঃ) দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেনকারণ তিনি তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করেন যে সব গাছপালা, পাথর এই বালকটিকে সেজদা করছেফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছরএই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহন করেনযুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হনকিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনাসে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন

নবুয়তের পূর্বের জীবন

আরবদের মধ্যে উপস্থিত হিংশ্রতা, খেয়ানতদারীতা এবং প্রতিশোধমূলক মনোভাব দমনের জন্যই হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়মুহাম্মাদ (সাঃ)এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেনবিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তরুণ বয়সে মুহাম্মাদের (সাঃ) তেমন কোন পেশা ছিলনাতবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেনসাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা'দ গোত্রেরকয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেনএরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেনমুহাম্মাদ (সাঃ)অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেনএতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী ব্যবসা উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেনমুহাম্মাদের (সাঃ) সুখ্যাতি যখন চারতিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবগত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানানমুহাম্মাদ (সাঃ)এই প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান

খাদীজা মাইছারার মুখে মুহাম্মাদের (সাঃ) সততা ও ন্যায়পরায়নতার ভূয়সী প্রশংশা শুনে অভিভূত হনএছাড়া ব্যবসার সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হনএক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে(সাঃ) ভালবেসে ফেলেনতিনি তার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেননাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ (সাঃ)বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলেন জানাবেনঅবশ্য মানসিকভাবে তিনি তখনই রাজি ছিলেনমুহাম্মাদ (সাঃ)তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেনবিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের (সাঃ)বয়স ছিল ২৫খাদীজার জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননিখাদীজার গর্ভে মুহাম্মাদের (সাঃ) ৬ জন সন্তান জন্মগ্রহন করে যার মধ্যে ৪ জন মেয়ে এবং ২ জন ছেলেতাদের নাম যথাক্রমে কাসেম, যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায়মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামী যুগ পায় এবং ইসলাম গ্রহন করে এবং একমাত্র ফাতিমা ব্যতিত সবাই নবীর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করে

মুহাম্মাদের (সাঃ) বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা'বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়মূলত কোন গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দলনির্মাণকাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলকিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজকে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার পাঁচ দিন যাব এ বিবাদ চলতে থাকার এক পর্যায়ে এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যা পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবেপরদিন মুহাম্মাদ (সাঃ)সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেনএতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়আর তার প্রতি সবার ব্যপক আস্থাও ছিলযা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেনতিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করেএরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন

নবুওয়ত প্রাপ্তি

চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থা এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেননবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেনত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেনতাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেনএমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেনজিব্রাইল তাঁকে এই পংক্তি কটি পড়তে বলেন:

পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেনসৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকেপাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না[১]

উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেনকিন্তু এবারও মুহাম্মাদ (সাঃ)নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেনএভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ (সাঃ)পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হনঅবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতপ্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেনবারবার বলতে থাবেন, "আমাকে আবৃত কর"খাদিজা নবীর সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেনভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মাদকে (সাঃ) নিয়ে খাদিজা নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে যাননওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবীতারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্যএকটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসেএবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্‌সির-এর কয়েকটি আয়াতএর পর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ (সাঃ)এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থাতাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুরএই প্রতিকূলততার মধ্যেই নবীর মক্কী জীবন শুরু হয়

গোপন প্রচার

প্রত্যাদেশ অবতরণের পর নবী বুঝতে পারেন যে, এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে; কারণ তকালীন নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যাতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিলনাতাই প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেনমুহাম্মাদের (সাঃ) আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন খাদিজাএরপর মুসলিম হন মুহাম্মাদের (সাঃ) চাচাতো ভাই এবং তার ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী, ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছরইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য নবী নিজ বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন; এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ সেন নেয়নি, এ সভাতে একজনই ইসলাম গ্রহণ করে, সে হলো আলীইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল নবীর অন্তরঙ্গ বন্ধূ আবু বকরএভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেনএই প্রচার ছিল সম্পূর্ণ গোপনে

প্রকাশ্য দাওয়াত

তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ (সাঃ)প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেনএ ধরণের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিলনবী সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিকার করে সকলকে সমবেত করেনএরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)আল্লাহ্‌র রাসূলকিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়

মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন

বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে নির্যাতন শুরু করে: প্রথমত উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি, এরপর অপপ্রচার, কুটতর্ক এবং যুক্তিএক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় যাকে সফল করার জন্য একটি নেতিবাচক ফ্রন্ট গড়ে উঠেএকই সাথে গড়ে তোলা হয় সাহিত্য ও অশ্লীল গান-বাজনার ফ্রন্ট, এমনকি একং পর্যায়ে মুহাম্মাদের সাথে আপোষেরও প্রচেষ্টা চালায় কুরাইশরাকিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ)তা মেনে নেননি; কারণ আপোষের শর্ত ছিল নিজের মত ইসলাম পালন করা, সেক্ষেত্র তার ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতো

ইথিওপিয়ায় হিজরত

ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রুপ ধারণ করে তখন নবী কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসনিয়ায় হিজরত করতে পাঠানসেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তকালীন আবিসনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ

এরপর ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণনবী সবসময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করেতার এই ইচ্ছা এতে পূর্ণতা লাভ করেআরব সমাজে উমরের বিশেষ প্রভাব থাকায় তার ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারকে খানিকটা সহজ করে, যদিও কঠিন অংশটিই তখনও মুখ্য বলে বিবিচেত হচ্ছিলএরপর একসময় নবীর চাচা হামযা ইসলাম গ্রহণ করেনতার ইসলাম গ্রহণে আরবে মুসলিমদের আধিপত্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়

একঘরে অবস্থা

এভাবে ইসলাম যখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ (সাঃ)ও তার অনুসারী সহ সহ গোটা বনু হাশেম গোত্রকে একঘরে ও আটক করেতিন বছর আটক থাকার পর তারা মুক্তি পায়

দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন

কিন্তু মুক্তির পরের বছরটি ছিল মুহাম্মাদের(সাঃ) জন্য দুঃখের বছরকারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিব মারা যায়দুঃখের সময়ে নবী মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপরে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েনহতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান (অবশ্য তায়েফ গমনের তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে)কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হনএমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদের(সাঃ) পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি; নব নব সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন

মি'রাজ তথা উর্দ্ধারোহন

এমন সময়েই কিছু শুভ ঘটনা ঘটেইসলামী ভাষ্যমতে এ সময় মুহাম্মাদ (সাঃ)এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমন ইতিহাসে ইসরা নামে পরিচিতকথিত আছে, মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে উর্দ্ধারোহণ করেন এবং মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন, এছাড়া তিনি বেহেশ্‌ত দোযখ সহ মহাবিশ্বের সকল স্থান অবলোকন করেনএই যাত্রা ইতিহাসে মি'রাজ নামে পরিচিতএই সম্পূর্ণ যাত্রার সময়ে পৃথিবীতে কোন সময়ই অতিবাহিত হয়নি বলে বলা হয়

মদীনায় হিজরত

এরপর আরও শুভ ঘটনা ঘটেমদীনার বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেতারা মূলত হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিলএরা আকাব নামক স্থানে মুহাম্মাদের (সাঃ) কাছে শপথ করে যে তারা যে কোন অবস্থায় নবীকে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবেএই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিতএই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদকে (সাঃ) মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানায় মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকেবিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটেএ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারেনাএজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবেএ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদকে(সাঃ) আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনিএই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যায়সবশেষে মুহাম্মাদ (সাঃ)ও আবু বকর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেনতাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদকে (সাঃ) হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তা সফল হয়নিএভাবেই মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে

মাদানী জীবনJustify Full

নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হতকিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হতএটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষের শেষে AH উল্লেখিত থাকে যার অর্থ: After Hijra

স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন

মুহাম্মাদ (সাঃ)মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবেতখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস খাযরাজতিনি তার দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেনমদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেএই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভুতি সৃষ্টি করা হয়আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিলএছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির)এগুলোসহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিলএই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)হন তার প্রধান

মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ

মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকেমক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকেমুহাম্মাদ (সাঃ)মদীনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেনকিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করেএই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (সাঃ)৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঠায়কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিলকুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করেএই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়মুসলিমদের মতে এই যুদ্ধে আল্লাহ মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেনযাহোক, এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটেএরপর ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়কুরাইশরা বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিতের বেশে মক্কায় প্রবেশ করে৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমন করেকিন্তু এবারও খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়যুদ্ধ বিজয়ে উসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়ফলে আশেপাশের অনেক গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়

মদীনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক

কিন্তু এ সময় মদীনার বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়মূলত ইহুদীরা বিশ্বাস করতনা যে, একজন অ-ইহুদী শেষ নবী হতে পারেএজন্য তারা কখনই ইসলামের আদর্শ মেনে নেয়নি এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বুঝতে পারে তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেমুহাম্মাদ (সাঃ)প্রতিটি যুদ্ধের পরে একটি করে ইহুদী গোত্রের উপর আক্রমন করেনবদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্র সপরিবারে মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়; আর খন্দকের পর সকল ইহুদীকে মদীনা থেকে বিতাড়ন করা হয়মুহাম্মাদের (সাঃ) এই ইহুদী বিদ্বেশের দুটি কারণের উল্লেখ পাওয়া যায়, একটি ধর্মীয় এবং অন্যটি রাজনৈতিকধর্মীয় দিক দিয়ে চিন্তা করলে আহলে কিতাব হয়েও শেষ নবীকে মেনে না নেয়ার শাস্তি ছিল এটিআর রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করলে, ইহুদীরা মদীনার জন্য একটি হুমকী ও দুর্বল দিক ছিলএজন্যই তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়[৬]

হুদাইবিয়ার সন্ধি

কুরআনে যদিও মুসলিমদের হজ্জ্বের নিয়ম ও আবশ্যকীয়তা উল্লেখ ককরা আছে, তথাপি কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ্জ্ব আদায় করতে পারছিল নামুহাম্মাদ(সাঃ)এক দিব্যদর্শনে দেখতে পান তিনি হজ্জ্বের জন্য মাথা কামাচ্ছেন দেখে তিনি হজ্জ্ব করার জন্য মনস্থির করেন এবং ৬ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবা নিয়ে মদীনার পথে যাত্রা করেনকিন্তু এবারও কুরাইশরা বাঁদা দেয়অগত্যা মুসলিমরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করেএখানে কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে সুপরিচিতএই সন্ধি মতে মুসলিমরা সে বছর হজ্জ্ব করা ছাড়াই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেসন্ধির অধিকাংশ শর্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেলেও মুহাম্মাদ (সাঃ)এই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন

চলবে----