সারসংক্ষেপ: যাকাত ইসলামের পঞ্চভিত্তির মধ্যে অন্যতম একটি ভিত্তি। এটি ধন-সম্পদের দিক দিয়ে ইসলামের আদর্শগত ও কর্মগত বুনিয়াদ। ব্যক্তির আয়ত্তাধীন সম্পদের উপর আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানা স্বীকারে যাকাত বাস্তব একটি অনুষ্ঠান। নিয়মিত যাকাত আদায়ের মাধ্যমে যাবতীয় ধনসম্পদ ও ব্যক্তিসত্ত্বার প্রকৃত মালিক যে আল্লাহ তা‘আলা তারই স্বীকৃতি দেয়া হয়। অপরদিকে এর দ্বারা মানুষের অন্তরের পবিত্রতা বিধান এবং আল্লাহ কতৃক প্রদেয় দায়িত্ব পালনের অনূভুতি সৃষ্টি হয়। অপরদিকে আত্মপ্রেম ও লোভ কার্পণ্যের প্রকৃতিগত ভাবধারা দূর করে মনমানষিকতাকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, নির্মল, ও স্বচ্ছ করে তোলাই হল যাকাতের মূল উদ্দেশ্য। সমাজে ধনী ও দরিদ্র ব্যক্তির মধ্যে অসম দুরত্ব হ্রাস করার নিমিত্তে যাকাতের বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। তাই দারিদ্র সমস্যা সমাধানে এবং মানব কল্যাণে যাকাতের ভূমিকা ও অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে শুধু সমাজই নয় রাষ্ট্রও হয় উপকৃত। দারিদ্র মানবতার প্রধান শক্র। ত্রেবিশেষে তা মানুষকে কুফুরী পর্যন্ত পৌঁছায়। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে সমাজে সৃষ্টি হয় হতাশা ও বঞ্চনা। পরিণামে অধিকাংশ সমাজে অপরাধ ও মারাত্মক সংঘাতের জন্ম হয়। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য ইসলামের সোনালী যুগ হতেই যাকাত ইসলামের দারিদ্র বিমোচক মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থ-সম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্র মানুষের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপত্তাময় হয়, তেমনি সুযোগ সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানেরও। আলোচ্য নিবন্ধে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণে দারিদ্র বিমোচক মুখ্য হাতিয়ার যাকাতের গুরুত্ব ও অসামান্য অবদান সংপ্তি পরিষরে বিধৃত হয়েছে।
১. ভূমিকা
ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান। ইসলাম মানুষের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি েেত্র মানবীয় মূল্যবোধের সাথে সমন্বিত ভারসাম্যমূলক আর্থ-সামাজিক জীবন পদ্ধতি উপহার দিয়েছে বিশ্বমানবতাকে। ইসলাম সুখী সমৃদ্ধ কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন সুস্থ রাজনৈতিক পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছে ইনসাফপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্তকরণ এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। তাই আর্থ সামাজিক ভারসাম্য সংরণে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে যেমন একদিকে সম্পদের পরিশুদ্ধি ঘটে তেমনি বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্পদের ঘাটতি হলেও পরিণামে তা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত।
২. যাকাত পরিচিতি
যাকাত শব্দের অর্থ হলো, পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য। কেননা যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র। ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায়-জীবন-যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট এক অংশ আল্লাহ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়। সুতরাং যাকাত হচ্ছে, বিত্তবানদের ধন সম্পদের সেই অপরিহার্য অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়। ইমাম ইবন তাইমিয়া বলেন, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত আদায়কারীর মন ও আত্মা পবিত্র হয়, বৃদ্ধি পায় তার ধন ও সম্পদ। এই ক্রমবৃদ্ধি ও পবিত্রতা কেবল ধন-মালের মধ্যেই সীমিত থাকে না, বরং তা যাকাত প্রদানকারীর মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সম্ভবত এ দিক ল্য করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِيِّهِمْ بِهَا “আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদাকাহ্ (যাকাত) গ্রহণ করুন, আপনি এর দ্বারা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করবেন।” সুতরাং দারিদ্র বিমোচনের জন্য সমাজের সামর্থবান লোকদের উপর তার সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অসহায় লোকদের মাঝে দান করা অপরিহার্য।
৩. যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এর উপরই ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। আল-কুর’আন সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল-কুর’আনে মোট ১৯টি সূরাহ্য় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়। এরমধ্যে ৯টি মাক্কী সূরাহ এবং ৯টি মাদানী সূরাহ। মাক্কী সূরায় যাকাতকে মুমিনদের একটি মহৎ গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজ সমষ্টির কোন দায়িত্বের কথা তাতে বলা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাদানী সূরাহ্সমূহে। নবী করীম (স.) তাঁর বহুসংখ্যক হাদীছের মাধ্যমে ইসলামে যাকাতের স্থান ও গুরুত্ব স্পষ্ট করেছেন। তিনি তা আদায় করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন তার উম্মাহকে, এবং যারা তা দিতে অস্বীকার করে তাদের জন্য সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। সহীহুল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীছসমূহে যাকাতকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাই নবী করীম (স.) বিভিন্ন স্থানে প্রশাসক প্রেরণের সময় তাদেরকে যাকাত সম্পর্কিত কুর’আনী গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিতেন। যেমন তিনি হযরত মু‘আয ইবন জাবাল ইয়ামানে প্রেরণকালে বলেছিলেন, যখন তুমি ইয়ামানে আহ্লে কিতাবদের নিকট আগমন করবে, তাদের তুমি দা‘ওয়াত দেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স্যাদানের জন্য। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপর ফরয করেছেন দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। তারা তা মেনে নিলে তাদের জানাবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর ‘সাদাকাহ’ (যাকাত) ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। তারা এ কথা মেনে নিলে তারপর তোমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, তাদের ধন-মালের উত্তম অংশ তুমি নিয়ে না নাও, আর মাযলূমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহর মাঝে কোন আবরণ থাকে না। এ হাদীছে সালাত এবং যাকাত আদায়ের জন্য নবী করীম (স.) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ঈমানের স্যা দেয়ার পর সালাত এবং যাকাতকে ভ্রাতৃত্ববোধের সেতুবন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেন, فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلَوةَ وَاَتُوْا الزَّكَوَةَ فَاِخْوَانُكُمْ فِى الذِّيْنِ “তারা যদি তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।”
যাকাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এত অপরিসীম যে, আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে সমস্ত প্রতিনিধিদল নবী করীম (স.)-এর নিকট সাাতের জন্য আগমন করত তিনি তাদের প্রত্যেককেই সালাত কায়েমের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন। এ প্রসঙ্গে জারির ইবন ‘আব্দিল্লাহ্র বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন بَايَعَتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى اِقَامِ الصَّلَوةِ وَ اِيْتَاءِ الزَّكَوَةِ وَالنَّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ “আমি রাসূলের (স.) হাতে সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য উপদেশ দেয়ার জন্য বায়‘আত করেছি।”
নবী করীম (স.) যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য এর অনাদায়কে যুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এভাবে,
اُمِرْتُ اَنْ اُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا اَنْ لاَّاِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ وَيُقِيْمُوْا الصَّلَوةَ وَيُؤْتُوْا الزَّكَوةَ
“আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতণ না তারা স্যা দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে।”
যাকাত শুধু এই উম্মতের উপরই ফরয নয় বরং পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের উপরও এটি ধর্মীয় ফরযরূপে প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ছিল। কিন্তু সম্পদের কিয়দংশ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের রীতি পূর্বকালীন সকল উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এমন কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের প্রতি দরিদ্রকে সাহায্য ও স্বজাতির সেবা করার আদেশ দেয়া হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, ইসলাম কেবলমাত্র সাহায্য-সেবার আদেশ প্রদান করেই ান্ত হয়নি বরং প্রতিটি ধনবান মুসলিমের উপর যাকাত ফরয করে সকল আয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব করতঃ প্রতি বছর তা আদায় করা অবশ্য কর্তব্যরূপে ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টনের সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে যাকাতকে গণ্য করা হয়েছে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনে ক্ষেত্রে বিরাজমান পার্থক্য হ্রাসের জন্য যাকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। কিন্তু যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয় যা দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদেরকে দয়া করে দেয়া হয়। যাকাত হলো, ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় এর নির্দিষ্ট অংশ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ “আর তাদের সম্পদে রয়েছে নিঃস্ব ও বঞ্চিতদের অধিকার।”
৩.১ যাকাত অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ
ইসলামী শরী‘আতে যাকাত ফরয হওয়ার বিষয়টি এতই অকাট্য যে, যদি কোন মুসলিম তা অস্বীকার করে সে অবশ্যই কাফিরে পরিণত হবে। তার উপর মুরতাদ হওয়ার শাস্তি কার্যকর হবে। প্রথমে তাকে তওবা করতে বলা হবে এবং তওবা না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। কেননা যাকাত ইসলামের একটি অঙ্গ। কাজেই তা অস্বীকার করা মানেই আল্লাহকে অস্বীকার করা। অতএব তার কাফির হওয়ার বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। ইবনু কুদামাসহ বড় বড় ফিকহ্বিদ এ অভিমত পোষণ করে থাকেন। যাকাত অস্বীকারকারী কাফির হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ইসলাম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ হাদীছ দ্বারা যেমনি প্রমাণিত, তেমনি এর বৈধতার উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ মর্মে হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, নবী করীম (স.) ঘোষণা করেছেন,
اَمِرْتُ اَنْ اُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا انْ لاَّ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ ويُقِيْمُوْا الصَّلَوَةَ وَيُوْتُوْا الزَّكَوةَ فَاِنْ فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّى دِمَآءَهُمْ اِلاَّ بِحَقَّ الاِسْلاَمَ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ
“লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতণ পর্যন্ত না তারা এ স্যা দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, এবং মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল, আর নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দিবে। যদি তারা তা করে তাহলে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করার প্রয়োজন হলে সেটি ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ আল্লাহ্র কর্তৃত্বাধীন।”
হাদীছ গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকরের (রা.) ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। তাঁর খিলাফতকালে ‘আরবের বিভিন্ন গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। যদিও তারা নামায-রোযা পালনে প্রস্তুত ছিল। মুসায়লামাতুল কায্যাব, শাজাহ ও তুলায়হা প্রমুখ ভণ্ড নবীসহ তাদের অনুসারীরা যাকাত অস্বীকারকারীদের এই নীতিকে প্রবল সমর্থন জানায়। হযরত ‘উমার (রা.) তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে কি শাস্তি গ্রহণ করা হবে তা জানতে চাইলে খলীফা আবূ বকর (রা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন,
وَاللَّهِ لاَُقَاتِلَنَّ مَّنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَوةِ وَالزَّكَوةِ فَاِنَّ الزَّكَوةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُوْنِىْ عِقَالاً كَانُوْا يُوْدُّوْنَهُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللَّهِ لَقَاتَلْتُ مَنْعِهِمْ
“আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই সেই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, যে নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করবে। কেননা যাকাত হলো, সম্পদের হক। আল্লাহর শপথ! তারা যদি (যাকাত ফরযকৃত উটের) লাগাম দিতে অস্বীকার করে যা তারা রাসূলের দরবারে উপস্থিত করত। তাহলে আমি তাদের এ অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব। এ কথা শুনে হযরত ‘উমার (রা.) বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আবূ বকরের অন্তরকে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এটিই সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত।” অবশেষে হযরত আবূ বকর (রা.) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করেছিলেন এবং যাকাত দানে বাধ্য করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবূ বকর (রা.) পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রে-ই সর্বপ্রথম দরিদ্র, মিসকীন ও সমাজের দুর্বল ব্যক্তিদের ন্যায়-সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যাকাত যেমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে, তেমনি নিঃস্ব ও দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩.২ যাকাত অনাদায়ে বৈষয়িক ও পরকালীন শাস্তি
যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির জন্য যেমন পরকালীন শাস্তি রয়েছে তেমনি তার জন্য রয়েছে বৈষয়িক শাস্তি। আর এ শাস্তি যেমন শরী‘আত সম্মত তেমনি পরিণামগত। এ প্রসঙ্গে নবী করীমের (স.) সতর্ক বাণী উল্লেখ করা যেতে পারে। বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল-তাবারানী বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী সূত্রে উল্লেখ করেন যে, নবী করীম (স.) বলেছেন, “যে সব লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানাবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন এবং তারা অনাবৃষ্টির কবলে পড়বে।” নবী করীম (স.) আরও বলেন, “যার মালের সাথে যাকাত মিশ্রিত হয়ে থাকবে তার অবশ্যই বিপর্যয় ঘটবে।” এ ছাড়া আল-তাবারানী উদ্ধৃত আরেকটি হাদীছে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে যে, مَا تَلَفَ مَالٌ فِى بَرّ وَّ لاَ بَحْرٍ اِلاَّ بِحَبْسِ الزَّكَوةِ যাকাত আটকে রাখার কারণে স্থল ও জল ভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয়।” যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে, উক্ত সম্পদের মালিক যদি এর যাকাত প্রদান না করে, তার সম্পর্কে কঠোর আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে সতর্ক বাণী উচ্চারিত হয়েছে এভাবে,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنهَا فِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍه يُوْمَ يَحْمَىْ عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَ ظُهُوْرُهُمْ هَذَا ما كَنَزْتُمْ لاَِنَفِسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ.
“যারা স্বর্ণ, রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখে এবং তা (যাকাতের মাধ্যমে) আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সু-সংবাদ দিন। সেদিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে, পৃষ্ঠে ও পাঁজরে দগ্ধীভূত করে দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে তোমাদের সঞ্চিত সম্পদের আস্বাদ গ্রহণ কর।”
আল-সুন্নাহ্য় যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির জন্য পরকালীন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। নবী করীম (স.) বলেন, “আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগর (যার দুই চোখের উপর দুটি কালো চিহ্ন রয়েছে) রূপ ধারণ করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়।”
৩.৩ যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলী
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যে সমস্ত শর্তের প্রয়োজন তা নিুরূপ:
এক. মুসলমান হওয়া: অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয হয় না।
দুই. নিসাবের মালিক হওয়া: মাল নিসাব পরিমাণ হওয়া। নিসাব পরিমান না হলে তাতে যাকাত ফরয হয় না।
তিন. স্বাধীন হওয়া: ক্রীতদাসের উপর যাকাত ফরয হয়না। কেননা সে কোন সম্পদের মালিক নয়।
চার. সম্পদের পূর্ন মালিকানা থাকা: তথা উক্ত সম্পদের উপর মালিকানা সত্ত্ব ও দখলদারিত্ব থাকতে হবে। মালিকানা সত্ত্ব আছে, কিন্তু দখল নেই, অথবা দখল আছে, কিন্তু মালিকানা সত্ত্ব নেই, এরূপ সম্পদে যাকাত ফরয হবেনা।
পাঁচ. ঋণগ্রস্থ না হওয়া: যে সমস্ত ঋণে তাগাদা রয়েছে এ জাতীয় ঋণ থেকে যাকাত দাতাকে মুক্ত থাকতে হবে।
ছয়. সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া: নাবালিগ ও পাগলের উপর যাকাত ফরয নয়। তবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক যখনই বয়ঃপ্রাপ্ত হবে তখন থেকেই তার সম্পদে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্তির পর উক্ত সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
সাত. নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হওয়ার পর উক্ত সম্পদে তার মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হতে হবে। যদিও বছরের প্রথম ও শেষে সম্পদ নিসাব পরিমান থাকে, কিন্তু বছরের মাঝখানে নিসাব থেকে কিছু কমে যায়, তাতেও যাকাত ফরয হবে। যদি কোন ব্যক্তি ব্যবসায়ী মাস পরিবর্তন করে নেয় তা হলেও যাকাত দিতে হবে।
আট. নিসাব মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া: বসবাসের গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, আসবাবপত্র, যাতায়াতের যানবাহন, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এগুলোর উপর যাকাত ফরয হয়না।
নয়. নিসাবের সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া: তা প্রত্যভাবেই হোক অথবা পরোভাবেই হোক।
৩.৪ যাকাতের নিসাব
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ইসলাম ক্রমবর্ধমানশীল ধনসম্পদের সুনির্দিষ্ট একটি পরিমাণ মাল থাকা অপরিহার্য শর্তারোপ করেছে। সর্বনিম্ম যে পরিমাণ ধন-সম্পদ সম্পূর্ণ দায়মুক্ত অবস্থায় পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকবে সে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়। ফিক্হ অভিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকেই নিসাব বলে। বিভিন্ন সম্পদের জন্য তার নিসাব ও যাকাতের হার সম্পর্কিত নিম্মে একটি সারণী প্রদত্ত হল:
সম্পদ নিসাব যাকাতের হার
টাকা ২.৫%
রৌপ্য ৫২.৫ তোলা ২.৫%
স্বর্ণ ৭.৫ তোলা ২.৫%
পণ্য ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের সমপরিমাণ ২.৫%
উট ৫টি উট ১টি ১ বছরের ছাগল
গরু মহিষ ৩০ টি ১টি ১ বছরের বাছুর
ছাগল ভেড়া ৪০ টি ১টি ছাগল/ ১টি ভেড়া
খনিজ সম্পদ যে কোন পরিমাণ বিশ ভাগের একভাগ
৩.৫ যে সমস্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরয
ইসলামী শরী‘আত যে সমস্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছে তার পূর্ব শর্ত হলো, উক্ত সম্পদ পবিত্র ও হালাল হওয়া। হারাম পথে উপার্জিত সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করা হয়না। তাই যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করা হয়ে থাকে সেগুলো নিুরূপ:
এক. বর্ধনশীল পশুসম্পদ। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া। তবে যে সকল পশু গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা হয় তার উপর যাকাত ধার্য হয়না। দুই. ব্যবসা পণ্য। তিন. স্বর্ণ-রৌপ্য। চার. খনিজ সম্পদ। পাঁচ. কৃষি সম্পদ। তবে এেেত্র পচনশীল ও গৌণ শস্যের উপর যাকাত ধার্য করা হয়না। ছয়. সামুদ্রিক সম্পদ। সাত. নগদ অর্থ।
৩.৬ যৌথ মালিকানাধীন সম্পদের যাকাত
যৌথ মালিকানার সম্পদের েেত্র প্রত্যেক মালিকের অংশে কি পরিমাণ সম্পদ ভাগে পড়েছে তা হিসেব করার পর যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে উক্ত অংশের যাকাত দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, যৌথ মালিকানাধীন সম্পদের েেত্র মোট সম্পদ থেকে একসাথে যাকাত আদায় করা যেতে পারে। এরপর মালিকগণ স্ব স্ব অংশ অনুপাতে তা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করে নেবে। প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং সরকারী শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য যার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার কোন অংশীদারিত্ব নেই তাতে যাকাত ফরয হবে না। তবে যে সকল সরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি মালিকানার অংশীদারিত্ব রয়েছে তাতে শুধু ব্যক্তি মালিকদের অংশের উপর যাকাত ফরয হবে, সরকারী অংশের উপর যাকাত ফরয হবে না।
শেয়ার ও বন্ড আধুনিক অর্থনীতিতে একটি বহুল পরিচিত নাম। যে সকল শেয়ার ক্রেতা শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়কে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে এবং বিক্রয়ের জন্যই শেয়ার ক্রয় করে থাকে শেয়ারের মূল্যই তাদের ব্যবসায়ী সম্পদ। সুতরাং তাদের মালিকানাধীন শেয়ারের মূল্যকে ব্যবসায়ী সম্পদ হিসেবে ধরে নিয়ে বছরান্তে যথা নিয়মে তার উপর যাকাত ফরয হবে। আর যার মূল প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হওয়ার জন্য শেয়ার ক্রয় করে তাদের হিসেব হবে মূল প্রতিষ্ঠানের হিসেবের সাথে।
সুদভিত্তিক অর্থনীতি নির্ভর ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড এবং অনৈসলামী বীমা কোম্পানীর শেয়ার বাবদ প্রাপ্ত লাভ সুদ হিসেবে গণ্য বিধায় সরাসরি হারাম ও অবৈধ। হারাম ও অবৈধ হওয়ার কারণে লাভের সম্পূর্ণ অংশ ছওয়াবের নিয়্যাত ছাড়া গরীব-মিসকীনদের দান করে অথবা জনহিতকর কাজে ব্যয় করে দায়মুক্ত হওয়া আবশ্যক। এসকল বন্ডের আসল ও মূলধনের উপর যথা নিয়মে যাকাত ফরয হবে।
যাকাত ব্যয়ের খাত
যাকাতের অর্থ যাদেরকে প্রদান করা যায় ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় তাদেরকে যাকাতের মাসরাপ বলা হয়। আল-কুর’আনে যাকাতের মাসরাফ বা ব্যয়ের খাত ৮টি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إنما الصدقت للفقرآء والمساكين و العاملين عليها والمؤلفة قلوبهم و فى الرقاب والغارمين وفى سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله و الله عليم حكيم
“সাদাকা (যাকাত) ও কেবল মাত্র ফকীর, মিসকীন ও যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, গোলাম আজাদ করার জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফীরদের জন্য- এটি হলো আল্লাহর বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।”
আল-কুর’আনে বর্ণিত উপর্যুক্ত ৮টি খাতের সংপ্তি ব্যাখ্যা নিুরূপ:
১. ফকীর (الفقير): আল-কুর’আনে যাকাত ব্যয়ের খাত হিসেবে সর্ব প্রথম ফকীরকে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী কথন রীতি অনুযায়ী সর্ব প্রথমে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। তাই আল-কুর’আনেও এ রীতি অনুসরণ করে যাকাতের হকদার হিসেবে সর্বপ্রথম ফকীরকে উল্লেখ করা হয়েছে। ফকীহ্গণের মতে, যে ব্যক্তি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক নন সেই ফকীর। যদি কারো কাছে নিসাব পরিমান সম্পদ থাকে যা তার প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় তবে এ অবস্থাতেও সে ফকীর হিসেবে গণ্য হবে। ফকীর মিসকীন অপো নিঃস্ব নয়। ইব্ন ‘আব্বাস, হাসান আল-বাসরী, মুজাহিদ, ‘ইকরামা ও জহুরীর মতে, ফকীর এমন ধরণের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এেেত্র ফকীরের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফি‘ঈর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবী নয় এবং যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানীফাসহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন, الفقير أحسن حالاً من المسكين و من الناس
“মিসকীন অপো ফকীরের অবস্থা উত্তম।”
২. মিসকীন (المسكين): মিসকীন বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোষাকের জন্য অন্যের মুখাপেী হয়। কেউ কেউ বলেন, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার দারিদ্র চরম সীমায় পৌঁছেনি বটে কিন্তু তাকে সাহায্য না করা হলে সে এরূপ অবস্থায় উপনীত হয়ে পড়বে। ইব্ন যায়দ বলেন, মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে অভাবগ্রস্থ কিন্তু মানুষের কাছে চায়না। মুহাম্মাদ ‘আলী আস-সাবূনীর মতে, মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কোন কিছুই নেই। ইউনূস বলেন, আমি জনৈক ‘আরব বেদুঈনকে বললাম, তুমি কি ফকীর? তদুত্তরে সে বললো, আল্লাহর কসম আমি ফকীর নই, বরং মিসকীন। আল-তাবারী বলেন, সে অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ফকীর বলা হয়, যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রা করে চলে, কারো কাছেই কোন কিছুই প্রার্থনা করে না। আর মিসকীন হচ্ছে এমন অভাবী ব্যক্তি, যে ভিা করে বেড়ায়। তাঁর এ ব্যাখ্যার সমর্থনে উল্লেখ করেন যে, মাসাকানাহ শব্দটি দারিদ্রকেই বুঝায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে বলেন, وضربت عليهم الذلة والمسكنة
ফকীর ও মিসকীনের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও শব্দ দু’টি ইসলাম ও ঈমান শব্দদ্বয় ব্যবহারের মত। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, এ দু’টি শব্দ এক স্থানে ব্যবহৃত হলে তাৎপর্য ভিন্ন ভিন্ন হবে। তখন প্রতিটি শব্দের একটি বিশেষ অর্থ হবে। আর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হলে শব্দ দু’টির অর্থ হবে অভিন্ন।
আবার কেউ কেউ ফকীর ও মিসকীনের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন এভাবে যে, ফকীর কোন কিছু চাইতে লজ্জাবোধ করেনা, কিন্তু মিসকীন শুধু ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার কারণে অন্যের নিকট অবজ্ঞা করতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সা.) হাদীছ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন,
ليس المسكين الذى ترده التمرة والتمرتان ولا اللقمة و لا اللقمتان وإنما المسكين الذى يتعفف وإقرءوا إن شئتم يحن قوله لايسئلون الناس الحافًا
“সেই লোকটি মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দু’টি খেজুর অথবা দু-এক গ্রাম খাদ্যের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন তো সেই লোকটি, যে কারো কাছে চায় না। (মিসকীন সম্পর্কে জানতে হলে) তোমরা কুরআনের আয়াত لايسألون إلحافا “তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায়না” পাঠ করো।”
৩. ‘আমিল (العامل): যাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘আমিল বলা হয়। সরকার যাদেরকে যাকাত আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত করে তাদের ও তাদের সহযোগীদেরকে যাকাতের মাল থেকে এই পরিমাণ অর্থ প্রদান করা যাবে যার দ্বারা যাকাত আদায়কালীন সময়ে তাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা যথেষ্ট হয়। তবে তাদের এ ব্যয় বহন মধ্যম প্রকৃতির হতে হবে। যদি এমন হয় যে, ‘আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে সে েেত্র তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশি দেয়া যাবে না।
যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। তা যাকাতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। যেমন- কোন লোকের উপর এবং কোন্ মালের যাকাত ধার্য হবে, যাকাতের পরিমান কত হবে, যাকাত কে কে পেতে পারে, তাদের প্রয়োজনের চূড়ান্ত মাত্রা বা পরিমাণ কত, কত পেলে তাদের জন্য যথেষ্ট হয় অথবা প্রয়োজন মিটে এসব নির্ধারণ করা তাদেরই বড় কাজ। এেেত্র বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য দু’টি সংস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। ১. যাকাত আদায় বা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। ২. যাকাত বন্টনকারী প্রতিষ্ঠান।
৪. মুআল্লাফাতুল কুলূব (مؤلفة القلوب): ইসলামের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি জন্য যাদেরকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা হতো তাদেরকে মুআল্লাফাতুল কুলূব বলা হয়। মুআল্লাফাতুল কুলূব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ইমাম কুরতুবী বলেন,
وهم قوم كانوا فى صدر الاسلام ممن يظهر الاسلام يتألفون بدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم
“তাদেরকে মুআল্লাফাতুল কুলূব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দূর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা।” এ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরী বলেন,
المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا
“ইয়াহুদী অথবা খিষ্ট্রানদের মধ্য থেকে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাকেই মুআল্লাফাতুল কুলূূব বলা হয়। যদিও তিনি ধনী হন।” ইমাম ইবনু জারীর আল-তাবারীর মতে,
و أما المؤلفة قلوبهم فإنهم قوم كانو يتألفون على الإسلام ممن لم تصرح نصرته إستصلاحا به نفه وعشيرته.
মুহাম্মদ আলী আস-সাবূনী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন,
هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام.
“مؤلفة قلوبهم হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব মহানবী (সা.) ইসলামের জন্য তাদের অন্তর জয় করার নিমিত্ত্বে উপঢৌকন দিতেন।”
এ শ্রেণীর লোকদেরকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. কাফির শ্রেণী। যাকে অর্থ বা উপঢৌকন দিলে তার গ্রোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করবে বলে আশা করা হয়। এ মতের সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদীছ যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে:
إن النبى صلى الله عليه وسلم أعطنى صفوان بن امية من غنائم حنين وقد شهدها مشركا قال فلم يزل يعطنى حتى صار ائب لناس إلىّ
“নবী করীম (সা.) সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল থেকে দান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, নবী করীম (সা.) এরূপ ভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীকালে তিনি নবী করীম (সা.) এর মহানুভবতায় আকৃষ্ট হয়ে, ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
দুই: শত্র“ পরে প্রতিবন্ধকতা ও শত্র“তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাদেরকে কিছু দান করা। অনেক দেশের সীমান্তে অমুসলিম দেশ অবস্থিত। তাই শত্র“ দেশের সীমান্তে আক্রমণ হলে যারা প্রতিরামূলক কাজ করে মুসলিম সমাজকে রা করতে পারে তাদেরকে যাকাত ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে।
তিন: দূর্বল ঈমানের মুসলমানেরাও এই শ্রেণীভূক্ত। তাদেরকে অর্থ দান করা হলে তাদের ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের নিকট থেকে আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা.) এই শ্রেনীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণিমতের মাল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শ পালনে তাদের দৃঢ়তা অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিল।
চার: নতুন ইসলাম গ্রহণকারী লোকেরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। কেননা তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাদের পিতামাতার ও বংশ পরিবারের ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলশ্র“তিতে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়। এজন্য তাদেরকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাদের অনুরক্ততা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
পাঁচ: বর্তমান যুগে কুফুরী শক্তি মুসলমানদের মনোতুষ্টি সাধন করার জন্য তাদেরকে স্বপে কিংবা তাদের ধর্মে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহ মুসলমানদেরকে দাস বা গোলাম বানানোর চেষ্টায় রত আছে। এতদ্দুদ্দেশ্যে তারা অপরিমেয় ধনসম্পদ ও কলা-কৌশল ব্যয় ও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংস করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এমতাবস্থায় যাকাতের ফাণ্ড থেকে লোকদের মনতুষ্ট সাধনের জন্য এবং ইসলামের উপর অটল রাখার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
যাকাতের এই খাতটি সাহাবীগনের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে রহিত হয়ে গিয়েছে বলে কোন কোন ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন। তাদের এই মতের বিপরীতে বলা যায় যে, এই বিষয়ে ইজমা‘ হওয়ার ব্যাপারটি হযরত উমর (রা.)-এর যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। হাদীছের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, পরবর্তীকালে এর কার্যকারিতা রহিত হয়। এ বিষয়ে ইবনু আবিদীন স্বীয় গ্রন্থে ইজমা‘ রহিত হওয়া প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
لا إجماع الا عن مستند يجب علمهم بدليل أفاد نسخ ذلك قبل وفاته صلى الله عليه وسلم أو تقييد الحكم بحياته أو كونه حكمًا مغيا بإنتهاء علته وقد اتفق انتهاوءها بعد وفاته صلى الله عليه وسلم.
৫. আর রিকাব (الرقاب): দাস বা দাসীমুক্তিকে রিকাব বলা হয়। অত্র আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, যে দাস বা দাসী মুনিবের সাথে চুক্তি করেছে যে, সে তাকে এত টাকা দিয়ে দিলে মনিব তাকে মুক্ত করে দেবে। যাকাতের অর্থ দিয়ে এই চুক্তি পূরণে তাকে সাহায্য করা হবে। মহান আল্লাহ যাকাতের একটি অংশ তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বর্তমান যুগে এ দাসপ্রথা না থাকায় যাকাতে তাদের এ অংশটি দ্বারা যুদ্ধবন্দী মুক্ত করা যেতে পারে। কাযী ইবনুল ‘আরাবী আল-মালিকী লিখেছেন যে, যাকাতের টাকা দিয়ে বন্দী মুক্ত করণের েেত্র ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ পরিলতি হয়। ফকীহ আল-আতবাক লিখেছেন যে, তা যায়িয হবে না। ইব্ন হাবীব এর মতে অবশ্যই বৈধ হবে। যাকাতের অর্থ দিয়ে মুসলিম বন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করা অধিক উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাফসীরকার সায়্যেদ রশীদ রিযা লিখেছেন, ফীর রিকাব বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ বিষয়ে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শায়খ প্রফেসর মাহমূদ শালতুত লিখেছেন যে,
ولكن فيما أرى قد حل محله الآن، رق هو اشد خطرا منه على الإنسانية، ذلكم هو إسترقاق الشعوب فى أفكارها، وفى أموالها وسلطانها وحريتها فى بلادها.
৬. আল-গারিমূন (الغارمون): আল-গারিমূন দ্বারা ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। ইবনুল হুমাম লিখেছেন যে, গারিমূন হচ্ছে, সেই সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করতে পারছেনা তাকেও গারিমূন বলার প্রচলন আছে। এই সমস্ত লোকের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই বলে তাদের উপর যাকাত ফরয হয়না। এ প্রসঙ্গে আল-তাবারী বলেন,
أما الغارمون فالذين استد انوا فى خير معصية الله ثم لم يجدوا قضاء فى عين ولاعرض.
“গারিমূন হলো, তারাই যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য অর্থ ঋণ করেছে।”
আল-তাবারী কর্তৃক গারিমূন এর এ সংগায় সে সমস্ত লোক অন্তর্ভূক্ত যারা আকস্মিকভাবে জীবনের কঠিনতম বিপদে নিপতিত হয়েছে। তারা এমন সব আঘাত পেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে যে, তাদের ধন-মাল সব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় তারা প্রয়োজনবশতই নিজের এবং পরিবারবর্গের জন্য ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এ সমস্ত লোকদেরকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। যাকাত দ্বারা যেমন জীবিত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা যায় তেমনি মৃত ব্যক্তির ঋণও কি পরিশোধ করা যাবে কিনা এ বিষয়ে ইমাম নববী দু’টি মত উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে, তা জায়েয নয়। অপরটি জায়েযের স্বপ।ে কেননা আয়াতে সাধারণভাবেই ঋণগ্রস্থদের কথা উল্লেখিত হয়েছে। অতএব মৃত্যুকে জীবিতের ন্যায় মনে করেই তার ঋণও পরিশোধ করা যাবে। ইমাম আল-কুরতুবী এ মতের স্বপে যুক্তি দেখিয়ে নিম্নোক্ত হাদীছ উল্লেখ করেন:
أنا أولى بالمؤمن من نفسه من ترك مالاً فلاهله ومن ترك دينًا أوضياعًا فإلىّ وعلىّ.
“প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির জন্য আমি তার নিজের থেকে অধিক আপন। যে লোক ধন-মাল রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। আর যে লোক ঋণ অথবা (বলেছেন) অসহায় সন্তানাদি রেখে যাবে তা আমার উপর ন্যস্ত হবে।”
হানাফী মাযহাব মতে, মৃত্যু ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে হানাফী ফকীহ ইবনু ‘আবিদীন বলেন,
لايسرف إلا بناء مسجد ولا إلى كفن ميت و قضاء دينه.
“যাকাতের অর্থ মসজিদ নির্মাণ, মৃত্যু ব্যক্তির কাফন ও তার ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় করা যাবে না।”
এ মতের পে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে যে, মৃত্যু হওয়ার কারণে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ দাতার যিম্মাদারী থেকে মুক্ত হয়েছেন। তবে বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ইবনুল হুমাম কতিপয় ফকীহর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে,
المفيد لو قضا بها دين حى أو ميت بأمره جاز.
“যদি জীবিত অথবা মৃত্যু ব্যক্তির অসিয়তক্রমে যাকাতের অর্থ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হয় তাহলে তা বৈধ হবে।”
হানাফী ফকীহ্গণের এ ধরণের মতামত নীতিবাচক বা আংশিকভাবে ইতিবাচক হলেও এ বিষয়ে স্পষ্ট হাদীছ বিদ্যমান থাকায় অথবা মৃত্যু ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধের অসিয়তের প্রতি দৃষ্টি রেখে ঋণের রাহু গ্রাস থেকে মৃত্যু ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করাই যুক্তিযুক্ত।
৭. ইবনুস সাবীল (ابن السبيل): ইবনুস সাবীল দ্বারা ঐ পথচারী মুসাফিরকে বুঝানো হয়েছে, যে শহর থেকে শহরান্তরে এবং দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণরত। নিবাসে সে ধনী হলেও প্রবাসে সে রিক্তহস্ত হওয়ায় তাকে যাকাতের অর্থ দেয়ার কথা আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এমর্মে আল-তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের নিঃস্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
হানাফী ফকীহগণের এ বিষয়ে বক্তব্য হলো, যাকাতের অর্থে এ ধরণের নিঃস্ব মুসাফিরের হক রয়েছে। তবে পারলে তার ঋণ না নেয়াই উত্তম, কর্তব্য নয়। কেননা এ ঋণ পরিশোধে সে অম হয়ে পড়তে পারে। তবে কতটুকু সম্পদ তাকে দেয়া যাবে এ বিষয়ে হানাফীদের দু’টি মত পাওয়া যায়। প্রথমটি হলো, যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবেনা। অপর মত হলো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। উস্তায আহমদ মুস্তফা আল-মারাগী মনে করেন যে, বর্তমান যুগে ইবনুস সাবীল ধরণের লোক দেখতে পাওয়া যায়না। কেননা এ যুগের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিজ্ঞান উন্নত হওয়ায়, গোটা পৃথিবী যেন এক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া লোকদের উপায়-উপকরণও বিপুল ও সহজলভ্য। পৃথিবীর যে কোন স্থানে বসে মানুষ ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে স্বীয় ধন-মাল নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতার নীরিখে মারাগীর এমত বিশ্লেষণ করলে এটি ইতিবাচক মন্তব্য বলে প্রতীয়মান হয়না। কেননা এখনও মানুষ একমাত্র দ্বীনি উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করছে। সে তার এ ভ্রমণ পথে যে কোন কারণে রিক্ততা তার স্কন্ধে আরোহন করতে পারে। এমতাবস্থায় তার সাহায্যের মুখাপেী হওয়া অবাস্তব কিছু নয়। তবে যারা একমাত্র ভ্রমণ উৎসব পালনের জন্য বহির্বিশ্বে গমন করে তাদের বিষয়টি ইবনুস সাবীলের আওতাভুক্ত নয় বলে উস্তাদ শালতূত মনে করেন।
৮. ওয়া ফী সাবীলিল্লাহ (و فى سبيل الله): ওয়া ফী সাবীলিল্লাহ দ্বারা স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা-সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানের কাজে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলমানদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ বল দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদেরকে সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরয যাকাতের একটি অংশরূপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহর পথে গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করার জন্য। যেমনিভাবে মু’মিনদেরকে সাধারণত: তাদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশ্বে প্রচলিত চারটি মাযহাবের নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে সাবীলিল্লাহ দ্বারা সামরিক ও স্বশস্ত্রতার অর্থে জিহাদ ও যুদ্ধকে বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন সাম্প্রতিককালে মুসলিম বিশ্বে ঘটমান যুদ্ধ ইসলামী যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ হচ্ছে জাতীয় বা স্বদেশিক পর্যায়ের যুদ্ধ। জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে অস্ত্র ধারণ করা আসলে বৈষয়িক যুদ্ধ বৈ আর কিছুই নয়। দ্বীনের সাথে তার দূরতম ও সম্পর্ক নেই। অতএব এসব যুদ্ধ কখনই ফী সাবীলিল্লাহ বলে গণ্য হতে পারেনা। আর এজন্যই এসব যুদ্ধে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা বৈধ নয়। তাদের এ ধারণা বিশ্লেষণ সাপে। ইসলামী জিহাদ কেবলমাত্র সেসব রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় যা সাহাবায়ে কিরামের যুগে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বিদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিসমূহ দমন বা উৎখাতের নামে যেসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে এর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াই বড় জিহাদ। সাহাবী ও তাবি‘ঈগণের যুদ্ধ যখন ইসলামী দা‘ওয়াত সংরণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল, তখন নূরুদ্দীন, সালাহুদ্দীন ও কুতুজের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের দেশ ও ভূমি রার উদ্দেশ্যে। আর জিহাদ যেমন ফরয হয়েছে ইসলামী ‘আকীদাহ- বিশ্বাস রার্থে তার সমর্থনে, তেমনি ফরয হয়েছে ইসলামী দেশ রার জন্যও। কেননা ইসলামী ‘আকীদাহ-বিশ্বাস ইসলামী দেশের মতই। এ দু’টিরই পূর্ণ সংরণ এবং আক্রমণকারীদের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া একান্তই আবশ্যক।
৪. আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণে যাকাত
যাকাতের ধর্মীয়, নৈতিক ও নানাবিধ ইতিবাচক উদ্দেশ্য থাকলেও এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য সবিশেষ গুরুত্ববহ। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ একটি মারাত্মক অপরাধ। সম্পদের ব্যাপক ব্যয়-ব্যবহার এবং বিনিয়োগই হচ্ছে তার জন্য স্বাভাবিক ব্যবস্থা। যাকাত এ ব্যবস্থার বাস্তব সাংগঠনিক পদ্ধতি এটি সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের প্রধান প্রতিরোধক। কেননা ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু অপছন্দই করে না বরং তা দুরীভূত করার কথাও বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা-ই নয়, সমাজে আয় বন্টনের েেত্র বৈষম্য অনেক খানি হ্রাস পাবে।
সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য আজ বিশ্বে ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক মিশ্র অর্থনৈতিক পদ্ধতির উন্মেষ ঘটেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে উল্লিখিত উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে সফল করা সম্ভব হয়নি। এ সব অর্থনৈতিক পদ্ধতি মানবীয় কল্যাণকে করেছে সংকুচিত। এতে বিশেষ ব্যক্তি ও বুর্জুয়ারা লাভবান হয়েছে। তারা শোষণের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে পাহাড়তুল্য সম্পদ। ফলে সমাজে স্বল্পবিত্ত ব্যক্তিরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র ইসলামই চায় ধনশালীরা যেন অতিরিক্ত সম্পদকে যাকাতের মাধ্যমে অপোকৃত গরীবদের মাঝে ব্যয় করে যা উভয়ের েেত্র কল্যাণ বয়ে আনবে এবং ধন-সম্পদের আবর্তণে গোটা অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটে। বিশেষ করে স্বল্পবিত্ত লোকেরা যেন তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ লাভ করতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সুনিশ্চিত হবে অন্যদিকে ধনী-গরীবের আয়ের বৈষম্যও বহুলাংশে লাঘব হবে। এ েেত্র উভয়ের মাঝে যাকাত হলো আল্লাহ প্রদত্ত সেতুবন্ধন। এদিকেই ইংগিত করে কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, كَىْ لاَيَكُوْنَ دَوْلَةً بَيْنَ الاَغْنِيَآءِ مِنْكُمْ “যেন সম্পদ তোমাদের কেবল ধনীদের মধ্যেই আবর্তন না করে।” সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের যে সমস্ত ক্ষেত্রে যাকাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেগুলো নিম্নরূপ:
৪.১ দারিদ্র্য বিমোচন
ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা দারিদ্র বিমোচনের েেত্র একটি সুনিশ্চিত কার্যকর পন্থা। এতে শুধু সমাজই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হয় সমানভাবে। দরিদ্রতা যে কোন দেশ ও সমাজে একটি জটিল ও তীব্র সমস্যা। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধও ঘটে এই দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থ সম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি কর্ম সংস্থানেরও সুযোগ হয়। বাংলাদেশে যাকাত, ‘উশর, খনিজ সম্পদ ও প্রাণীকুলের যাকাত শরী‘আত নির্ধারিত নিয়মে বাধ্যতামূলকভাবে আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র মোচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে খুব বেশী নয় মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব।
আল-কুরআনে বর্ণিত যাকাতের অর্থ ব্যয়ের যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে তাতে প্রথম খাতেই রয়েছে দরিদ্র ও অভাবী লোকদের মধ্যে যাকাতের অর্থ সামগ্রী বন্টন করা। এতে শুধু অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয় বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিবেগের সঞ্চার হয়। যাকাতের অপর হিতকর ও কল্যাণধর্মী দিক হলো, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মুক্তি ও প্রবাসে বিপদকালে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন প্রয়োজন মোকাবিলার কারণে যদি কেউ ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং সে উক্ত ঋণ পরিশোধের সামর্থ হারিয়ে ফেলে তাহলে যাকাতের অর্থ দিয়েই সংকট মোচন করা যায়। দেউলিয়া হয়ে সমাজে অসম্মানিত জীবন যাপনের গ্লানি মোচনে যাকাত এক মোম হাতিয়ার।
৪.২ কল্যাণমূলক কর্মসূচী
যাকাতের অর্থ দিয়ে যদি দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষদেরকে কর্মম করার জন্য পুনর্বাসন প্রশিণ এবং কর্মসংস্থানমূলক কল্যাণধর্মী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য সত্যিকার অর্থে বিদায় নিবে। এ প্রস্তাবিত কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিধবা, বিকলাঙ্গদের কল্যাণ, বৃদ্ধদের জন্য মাসহারা, কন্যাদায়গ্রস্তদের সাহায্য, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণের সাহায্য, এতিমদের প্রতিপালন, স্মরণার্থী সহায়তা ও উদ্বাস্ত পুনর্বাসন এবং অভাবী সাধারণ জনগণের সুচিকিৎসার জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক মেডিকেল সেন্টার স্থাপন। এ ছাড়া যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীবদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার নিমিত্তে রিক্স্রা, ভ্যান কিনে দেয়া থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন ধরণের হালাল ব্যবসায় পুঁজি যোগান দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করা যেতে পারে।
৪.৩ শিা ও প্রশিণমূলক কর্মসূচী
যাকাতের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে শিা ও প্রশিণমূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসলামী শিা বিস্তারের জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীব ছাত্রদের বই কিনে দেয়া থেকে শুরু করে তাদের জামা-কাপড় ও লিল্লাহ বোডিং-এ থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া গরীব ও মেধাবী ছাত্রদেরকে তাদের শিা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিা বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কম্পিউটার প্রশিণ প্রদানের মাধ্যমে গরীব জনশক্তিকে অধিকতর উৎপাদনমুখী করা যেতে পারে এই অর্থ দিয়েই। এ ছাড়া ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ ও প্রসারের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করে জনসাধারণকে ইসলামমুখী করা যেতে পারে। যাকাত ব্যয়ের খাতে উল্লিখিত وَفِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ দ্বারা এর বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
৪.৪ কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচী
যাকাতের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচী সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। গরীব কৃষকদের গরুর বলদ ক্রয়ে এ অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। এ ছাড়া এ অর্থ দিয়ে ুদ্র আকারের উৎপাদনমুখী কর্মসূচী যেমন, চাল, চিড়া, মুড়ি তৈরী, নার্সারী তৈরী, তাঁত সামগ্রী তৈরী, হাঁস-মুরগী পালন, মাছের চাষ, সেলাই মেশিন, ইলেক্ট্রিক সামগ্রী মেরামত, রিক্সা-ভ্যান তৈরী ও মেরামত ইত্যাদি। এ ছাড়া ুদ্রাকারের ব্যবসা, যেমন মুদি দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, মাছের ব্যবসা, ফলের ব্যবসা ইত্যাদি পরিচালনা করা যেতে পারে। যাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায় মহিলাদেরকে এ অর্থ দিয়ে সেলাই কাটিং বুটিকসহ বিভিন্ন কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরী করার প্রশিণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা যেতে পারে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক লোক বন্যা, নদী ভাংগন ও অগ্নিকান্ডে তাদের ঘর-বাড়ী হারায়। যাকাতের অর্থ দিয়ে এ বাস্তুহারা মানুষদেরকে গৃহ নির্মাণে সহায়তা করে তাদেরকে বাস্তুর সন্ধান দেয়া যেতে পারে।
৪.৫ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী
আল্লাহর যমীনে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাকে ফরয করা হয়েছে। এ েেত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। আল-কুর’আন এ েেত্র যাকাত লব্ধ অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বরা হয়েছে,
لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ لاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَربًا فِى الاَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تعْرِفُهُمْ بِسِيْمهُمْ
“এটি প্রাপ্য অভাবগ্রস্থ লোকদের, যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য যমীনে পদচারণা করতে সম হয় না এবং আত্মসম্ভ্রমের কারণে কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে তাদের মুখমন্ডলে দরিদ্রের ছায়াপাতের কারণে চিনতে পার।” দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে খৃষ্টান মিশনারী ও এনজিওদের অপতৎপরতা মোকাবেলা করার ল্েয বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী পাঠাগার স্থাপন করা যেতে পারে। যাকাত ব্যবস্থা শুধু দুঃস্থের পুনর্বাসনেই নয়, সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব প্রতিরোধের েেত্র যাকাত মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলামী সরকার বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় করলে ইসলামী জনতা তা আল্লাহর হুকুম পালন ও ইবাদত মনে করে সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ ও প্রতিবিপ্লবের উদ্যোগ গ্রহণ করবে না।
৪.৬ উৎপাদন বৃদ্ধি
যাকাত যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে তেমনি অর্থনীতিতে উৎপাদনও বৃদ্ধি করে। যাকাতে অর্থ নিস্ব ব্যক্তিদের ভিার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে। যে কোন উৎপাদন কাজে শ্রমের সাথে পুঁজির সংযোজন অনস্বীকার্য। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে বিশ্ময়কর উন্নয়ন ঘটাতে পারে, কাজে লাগাতে পারে অসংখ্য প্রকৃতির সম্পদকে, পারে মরুভূমিকে উর্বর জমিতে পরিণত করতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার যা অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি দ্রব্য (চৎড়ফঁপবৎ মড়ড়ফং) বলা হয়ে থাকে। পুঁজির অভাবে বহু কর্মম দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেকারত্ব জীবন-যাপন করছে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে এই সকল দরিদ্র জনশক্তিকে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
৪.৭ শ্রমিক সরবরাহ
শ্রমিক সরবরাহ সংক্রান্ত নিওকাসিকাল তত্ত্ব থেকে প্রতিয়মান হয় যে, যাকাত অর্থনীতিতে শ্রমিক সরবরাহের ক্ষেত্রে ধ্বণাত্ত্বক প্রভাব ফেলে। এই তত্ত্বে শ্রমিক সরবরাহ ব্যষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য হয়ে থাকে। যেখানে একজন শ্রমিক কাজের মাধ্যমে আয় উপার্জন ও অবসর এ দুই-এর সমন্বয়ে ভারসাম্য বিন্দুতে পৌঁছে। এ তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলামি অর্থনীতিতে যাকাত কিভাবে শ্রমিক সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলে তা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এভাবে।
ধরা যাক, একজন শ্রমিকের প্রাথমিক ভারসাম্য বিন্দু ছিল অ যা উপযোগ রেখা ট১ এর উপর অবস্থিত। এই অবস্থায় সে ভারসাম্য বিন্দুতে অবস্থান করছিল। দরিদ্র অবস্থায় কোন মূলধন দ্রব্য না থাকায় দৈহিক পরিমাপ করে কাজ করতে কষ্ট হয়, বিধায় অল্প কাজে যা আয় হতো তার উপর সন্তুষ্ট থাকে এবং অধিকাংশ সময় অবসরে কাটায়। যাকাতের অর্থ পাওয়ায় তার পূর্বের বাজেট রেখা গঘ, স্থানান্তরিত হয়ে গচছ এসেছে। এমতাবস্থায় তার পূর্বের চেয়ে আয় বেড়ে যাওয়ায় অপোকৃত উচু নিরপে রেখা ট২ এর সাথে ই বিন্দুতে ভারসাম্য পৌঁছিয়েছে। ভারসাম্য বিন্দু অ থেকে ই তে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য অবসর পূর্বের ঙজ থেকে ঙঝ এ নেমে আসে। অর্থাৎ এ েেত্র অবসরকে কমিয়ে কাজের মাধ্যমে আয় উপার্জনের দিকে উৎসাহিত হয়। ফলে শ্রমিক সরবরাহ বৃদ্ধি পায়।
৫. জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা ও যাকাত
মানব চিন্তাধারায় গঠিত আধুনিক পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নে ব্যর্থ হওয়ার ফলে যাকাত ভিত্তিক জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র ও ধনীকে আরো ধনী করে তুলতে সহায়তা করার ফলে সমাজে একটি অসম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে জাতীয় উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তাই সমাজে সুষম উন্নয়নের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।
৬. উপসংহার
মানব জীবনে আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন এবং মানব কল্যাণমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করলে সমাজে ধনী ও গরীবের মাঝে যে বিস্তার ব্যবধান রয়েছে তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এ ছাড়া পুঁজিবাদী আগ্রাসন, সমাজে দীনতা ও অভাবের ফলে যে অপরাধ প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। আজকে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত ‘ওশরসহ সকল প্রকার সাদাকাহ্ সংগ্রহ করে দরিদ্র, দুঃস্থ, ফকীর, মিসকীন, বেকার লোকদের সচ্ছলতা দানের উদ্দেশ্যে তাদের জন্য বৃহৎ-মাঝারি ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা ও কল্যাণমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবী। এতে করে সমাজে বেকার সমস্যার সমাধান ঘটবে এবং সমাজ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ। দারিদ্র দূরীকরণের প্রধান দিক হলো পল্লী জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন। কারণ দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পল্লী অঞ্চলেই বসবাস করে থাকে। তাই দারিদ্র দূর করতে হলে সর্বপ্রথমে পল্লী অঞ্চলের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ইত্যাদি দেশী-বিদেশী অনেক এনজিও সহ দেশের সরকারী ও আধাসরকারী বহু প্রতিষ্ঠান এ সংস্থা দারিদ্র বিমোচনে ঋণদানে এগিয়ে আসলেও এখানে ঋণ সুদভিত্তিক হওয়ায় পল্লী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে বহুলাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এর অর্থ গরীব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনা সুদে বিনিয়োগ করা হলে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব।
১. ভূমিকা
ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান। ইসলাম মানুষের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি েেত্র মানবীয় মূল্যবোধের সাথে সমন্বিত ভারসাম্যমূলক আর্থ-সামাজিক জীবন পদ্ধতি উপহার দিয়েছে বিশ্বমানবতাকে। ইসলাম সুখী সমৃদ্ধ কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন সুস্থ রাজনৈতিক পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছে ইনসাফপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্তকরণ এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। তাই আর্থ সামাজিক ভারসাম্য সংরণে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে যেমন একদিকে সম্পদের পরিশুদ্ধি ঘটে তেমনি বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্পদের ঘাটতি হলেও পরিণামে তা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত।
২. যাকাত পরিচিতি
যাকাত শব্দের অর্থ হলো, পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য। কেননা যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র। ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায়-জীবন-যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট এক অংশ আল্লাহ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়। সুতরাং যাকাত হচ্ছে, বিত্তবানদের ধন সম্পদের সেই অপরিহার্য অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়। ইমাম ইবন তাইমিয়া বলেন, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত আদায়কারীর মন ও আত্মা পবিত্র হয়, বৃদ্ধি পায় তার ধন ও সম্পদ। এই ক্রমবৃদ্ধি ও পবিত্রতা কেবল ধন-মালের মধ্যেই সীমিত থাকে না, বরং তা যাকাত প্রদানকারীর মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সম্ভবত এ দিক ল্য করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِيِّهِمْ بِهَا “আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদাকাহ্ (যাকাত) গ্রহণ করুন, আপনি এর দ্বারা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করবেন।” সুতরাং দারিদ্র বিমোচনের জন্য সমাজের সামর্থবান লোকদের উপর তার সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অসহায় লোকদের মাঝে দান করা অপরিহার্য।
৩. যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এর উপরই ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। আল-কুর’আন সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল-কুর’আনে মোট ১৯টি সূরাহ্য় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়। এরমধ্যে ৯টি মাক্কী সূরাহ এবং ৯টি মাদানী সূরাহ। মাক্কী সূরায় যাকাতকে মুমিনদের একটি মহৎ গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজ সমষ্টির কোন দায়িত্বের কথা তাতে বলা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাদানী সূরাহ্সমূহে। নবী করীম (স.) তাঁর বহুসংখ্যক হাদীছের মাধ্যমে ইসলামে যাকাতের স্থান ও গুরুত্ব স্পষ্ট করেছেন। তিনি তা আদায় করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন তার উম্মাহকে, এবং যারা তা দিতে অস্বীকার করে তাদের জন্য সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। সহীহুল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীছসমূহে যাকাতকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাই নবী করীম (স.) বিভিন্ন স্থানে প্রশাসক প্রেরণের সময় তাদেরকে যাকাত সম্পর্কিত কুর’আনী গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিতেন। যেমন তিনি হযরত মু‘আয ইবন জাবাল ইয়ামানে প্রেরণকালে বলেছিলেন, যখন তুমি ইয়ামানে আহ্লে কিতাবদের নিকট আগমন করবে, তাদের তুমি দা‘ওয়াত দেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স্যাদানের জন্য। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপর ফরয করেছেন দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। তারা তা মেনে নিলে তাদের জানাবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর ‘সাদাকাহ’ (যাকাত) ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। তারা এ কথা মেনে নিলে তারপর তোমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, তাদের ধন-মালের উত্তম অংশ তুমি নিয়ে না নাও, আর মাযলূমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহর মাঝে কোন আবরণ থাকে না। এ হাদীছে সালাত এবং যাকাত আদায়ের জন্য নবী করীম (স.) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ঈমানের স্যা দেয়ার পর সালাত এবং যাকাতকে ভ্রাতৃত্ববোধের সেতুবন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেন, فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلَوةَ وَاَتُوْا الزَّكَوَةَ فَاِخْوَانُكُمْ فِى الذِّيْنِ “তারা যদি তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।”
যাকাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এত অপরিসীম যে, আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে সমস্ত প্রতিনিধিদল নবী করীম (স.)-এর নিকট সাাতের জন্য আগমন করত তিনি তাদের প্রত্যেককেই সালাত কায়েমের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন। এ প্রসঙ্গে জারির ইবন ‘আব্দিল্লাহ্র বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন بَايَعَتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى اِقَامِ الصَّلَوةِ وَ اِيْتَاءِ الزَّكَوَةِ وَالنَّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ “আমি রাসূলের (স.) হাতে সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য উপদেশ দেয়ার জন্য বায়‘আত করেছি।”
নবী করীম (স.) যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য এর অনাদায়কে যুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এভাবে,
اُمِرْتُ اَنْ اُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا اَنْ لاَّاِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ وَيُقِيْمُوْا الصَّلَوةَ وَيُؤْتُوْا الزَّكَوةَ
“আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতণ না তারা স্যা দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে।”
যাকাত শুধু এই উম্মতের উপরই ফরয নয় বরং পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের উপরও এটি ধর্মীয় ফরযরূপে প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ছিল। কিন্তু সম্পদের কিয়দংশ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের রীতি পূর্বকালীন সকল উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এমন কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের প্রতি দরিদ্রকে সাহায্য ও স্বজাতির সেবা করার আদেশ দেয়া হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, ইসলাম কেবলমাত্র সাহায্য-সেবার আদেশ প্রদান করেই ান্ত হয়নি বরং প্রতিটি ধনবান মুসলিমের উপর যাকাত ফরয করে সকল আয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব করতঃ প্রতি বছর তা আদায় করা অবশ্য কর্তব্যরূপে ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টনের সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে যাকাতকে গণ্য করা হয়েছে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনে ক্ষেত্রে বিরাজমান পার্থক্য হ্রাসের জন্য যাকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। কিন্তু যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয় যা দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদেরকে দয়া করে দেয়া হয়। যাকাত হলো, ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় এর নির্দিষ্ট অংশ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ “আর তাদের সম্পদে রয়েছে নিঃস্ব ও বঞ্চিতদের অধিকার।”
৩.১ যাকাত অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ
ইসলামী শরী‘আতে যাকাত ফরয হওয়ার বিষয়টি এতই অকাট্য যে, যদি কোন মুসলিম তা অস্বীকার করে সে অবশ্যই কাফিরে পরিণত হবে। তার উপর মুরতাদ হওয়ার শাস্তি কার্যকর হবে। প্রথমে তাকে তওবা করতে বলা হবে এবং তওবা না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। কেননা যাকাত ইসলামের একটি অঙ্গ। কাজেই তা অস্বীকার করা মানেই আল্লাহকে অস্বীকার করা। অতএব তার কাফির হওয়ার বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। ইবনু কুদামাসহ বড় বড় ফিকহ্বিদ এ অভিমত পোষণ করে থাকেন। যাকাত অস্বীকারকারী কাফির হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ইসলাম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ হাদীছ দ্বারা যেমনি প্রমাণিত, তেমনি এর বৈধতার উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ মর্মে হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, নবী করীম (স.) ঘোষণা করেছেন,
اَمِرْتُ اَنْ اُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا انْ لاَّ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ ويُقِيْمُوْا الصَّلَوَةَ وَيُوْتُوْا الزَّكَوةَ فَاِنْ فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّى دِمَآءَهُمْ اِلاَّ بِحَقَّ الاِسْلاَمَ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ
“লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতণ পর্যন্ত না তারা এ স্যা দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, এবং মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল, আর নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দিবে। যদি তারা তা করে তাহলে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করার প্রয়োজন হলে সেটি ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ আল্লাহ্র কর্তৃত্বাধীন।”
হাদীছ গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকরের (রা.) ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। তাঁর খিলাফতকালে ‘আরবের বিভিন্ন গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। যদিও তারা নামায-রোযা পালনে প্রস্তুত ছিল। মুসায়লামাতুল কায্যাব, শাজাহ ও তুলায়হা প্রমুখ ভণ্ড নবীসহ তাদের অনুসারীরা যাকাত অস্বীকারকারীদের এই নীতিকে প্রবল সমর্থন জানায়। হযরত ‘উমার (রা.) তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে কি শাস্তি গ্রহণ করা হবে তা জানতে চাইলে খলীফা আবূ বকর (রা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন,
وَاللَّهِ لاَُقَاتِلَنَّ مَّنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَوةِ وَالزَّكَوةِ فَاِنَّ الزَّكَوةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُوْنِىْ عِقَالاً كَانُوْا يُوْدُّوْنَهُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللَّهِ لَقَاتَلْتُ مَنْعِهِمْ
“আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই সেই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, যে নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করবে। কেননা যাকাত হলো, সম্পদের হক। আল্লাহর শপথ! তারা যদি (যাকাত ফরযকৃত উটের) লাগাম দিতে অস্বীকার করে যা তারা রাসূলের দরবারে উপস্থিত করত। তাহলে আমি তাদের এ অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব। এ কথা শুনে হযরত ‘উমার (রা.) বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আবূ বকরের অন্তরকে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এটিই সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত।” অবশেষে হযরত আবূ বকর (রা.) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করেছিলেন এবং যাকাত দানে বাধ্য করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবূ বকর (রা.) পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রে-ই সর্বপ্রথম দরিদ্র, মিসকীন ও সমাজের দুর্বল ব্যক্তিদের ন্যায়-সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যাকাত যেমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে, তেমনি নিঃস্ব ও দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩.২ যাকাত অনাদায়ে বৈষয়িক ও পরকালীন শাস্তি
যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির জন্য যেমন পরকালীন শাস্তি রয়েছে তেমনি তার জন্য রয়েছে বৈষয়িক শাস্তি। আর এ শাস্তি যেমন শরী‘আত সম্মত তেমনি পরিণামগত। এ প্রসঙ্গে নবী করীমের (স.) সতর্ক বাণী উল্লেখ করা যেতে পারে। বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল-তাবারানী বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী সূত্রে উল্লেখ করেন যে, নবী করীম (স.) বলেছেন, “যে সব লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানাবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন এবং তারা অনাবৃষ্টির কবলে পড়বে।” নবী করীম (স.) আরও বলেন, “যার মালের সাথে যাকাত মিশ্রিত হয়ে থাকবে তার অবশ্যই বিপর্যয় ঘটবে।” এ ছাড়া আল-তাবারানী উদ্ধৃত আরেকটি হাদীছে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে যে, مَا تَلَفَ مَالٌ فِى بَرّ وَّ لاَ بَحْرٍ اِلاَّ بِحَبْسِ الزَّكَوةِ যাকাত আটকে রাখার কারণে স্থল ও জল ভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয়।” যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে, উক্ত সম্পদের মালিক যদি এর যাকাত প্রদান না করে, তার সম্পর্কে কঠোর আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে সতর্ক বাণী উচ্চারিত হয়েছে এভাবে,
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنهَا فِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍه يُوْمَ يَحْمَىْ عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَ ظُهُوْرُهُمْ هَذَا ما كَنَزْتُمْ لاَِنَفِسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ.
“যারা স্বর্ণ, রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখে এবং তা (যাকাতের মাধ্যমে) আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সু-সংবাদ দিন। সেদিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে, পৃষ্ঠে ও পাঁজরে দগ্ধীভূত করে দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে তোমাদের সঞ্চিত সম্পদের আস্বাদ গ্রহণ কর।”
আল-সুন্নাহ্য় যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির জন্য পরকালীন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। নবী করীম (স.) বলেন, “আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগর (যার দুই চোখের উপর দুটি কালো চিহ্ন রয়েছে) রূপ ধারণ করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়।”
৩.৩ যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলী
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যে সমস্ত শর্তের প্রয়োজন তা নিুরূপ:
এক. মুসলমান হওয়া: অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয হয় না।
দুই. নিসাবের মালিক হওয়া: মাল নিসাব পরিমাণ হওয়া। নিসাব পরিমান না হলে তাতে যাকাত ফরয হয় না।
তিন. স্বাধীন হওয়া: ক্রীতদাসের উপর যাকাত ফরয হয়না। কেননা সে কোন সম্পদের মালিক নয়।
চার. সম্পদের পূর্ন মালিকানা থাকা: তথা উক্ত সম্পদের উপর মালিকানা সত্ত্ব ও দখলদারিত্ব থাকতে হবে। মালিকানা সত্ত্ব আছে, কিন্তু দখল নেই, অথবা দখল আছে, কিন্তু মালিকানা সত্ত্ব নেই, এরূপ সম্পদে যাকাত ফরয হবেনা।
পাঁচ. ঋণগ্রস্থ না হওয়া: যে সমস্ত ঋণে তাগাদা রয়েছে এ জাতীয় ঋণ থেকে যাকাত দাতাকে মুক্ত থাকতে হবে।
ছয়. সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া: নাবালিগ ও পাগলের উপর যাকাত ফরয নয়। তবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক যখনই বয়ঃপ্রাপ্ত হবে তখন থেকেই তার সম্পদে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্তির পর উক্ত সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
সাত. নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হওয়ার পর উক্ত সম্পদে তার মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হতে হবে। যদিও বছরের প্রথম ও শেষে সম্পদ নিসাব পরিমান থাকে, কিন্তু বছরের মাঝখানে নিসাব থেকে কিছু কমে যায়, তাতেও যাকাত ফরয হবে। যদি কোন ব্যক্তি ব্যবসায়ী মাস পরিবর্তন করে নেয় তা হলেও যাকাত দিতে হবে।
আট. নিসাব মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া: বসবাসের গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, আসবাবপত্র, যাতায়াতের যানবাহন, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এগুলোর উপর যাকাত ফরয হয়না।
নয়. নিসাবের সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া: তা প্রত্যভাবেই হোক অথবা পরোভাবেই হোক।
৩.৪ যাকাতের নিসাব
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ইসলাম ক্রমবর্ধমানশীল ধনসম্পদের সুনির্দিষ্ট একটি পরিমাণ মাল থাকা অপরিহার্য শর্তারোপ করেছে। সর্বনিম্ম যে পরিমাণ ধন-সম্পদ সম্পূর্ণ দায়মুক্ত অবস্থায় পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকবে সে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়। ফিক্হ অভিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকেই নিসাব বলে। বিভিন্ন সম্পদের জন্য তার নিসাব ও যাকাতের হার সম্পর্কিত নিম্মে একটি সারণী প্রদত্ত হল:
সম্পদ নিসাব যাকাতের হার
টাকা ২.৫%
রৌপ্য ৫২.৫ তোলা ২.৫%
স্বর্ণ ৭.৫ তোলা ২.৫%
পণ্য ৫২.৫ তোলা রৌপ্যের সমপরিমাণ ২.৫%
উট ৫টি উট ১টি ১ বছরের ছাগল
গরু মহিষ ৩০ টি ১টি ১ বছরের বাছুর
ছাগল ভেড়া ৪০ টি ১টি ছাগল/ ১টি ভেড়া
খনিজ সম্পদ যে কোন পরিমাণ বিশ ভাগের একভাগ
৩.৫ যে সমস্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরয
ইসলামী শরী‘আত যে সমস্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছে তার পূর্ব শর্ত হলো, উক্ত সম্পদ পবিত্র ও হালাল হওয়া। হারাম পথে উপার্জিত সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করা হয়না। তাই যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করা হয়ে থাকে সেগুলো নিুরূপ:
এক. বর্ধনশীল পশুসম্পদ। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া। তবে যে সকল পশু গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা হয় তার উপর যাকাত ধার্য হয়না। দুই. ব্যবসা পণ্য। তিন. স্বর্ণ-রৌপ্য। চার. খনিজ সম্পদ। পাঁচ. কৃষি সম্পদ। তবে এেেত্র পচনশীল ও গৌণ শস্যের উপর যাকাত ধার্য করা হয়না। ছয়. সামুদ্রিক সম্পদ। সাত. নগদ অর্থ।
৩.৬ যৌথ মালিকানাধীন সম্পদের যাকাত
যৌথ মালিকানার সম্পদের েেত্র প্রত্যেক মালিকের অংশে কি পরিমাণ সম্পদ ভাগে পড়েছে তা হিসেব করার পর যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে উক্ত অংশের যাকাত দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, যৌথ মালিকানাধীন সম্পদের েেত্র মোট সম্পদ থেকে একসাথে যাকাত আদায় করা যেতে পারে। এরপর মালিকগণ স্ব স্ব অংশ অনুপাতে তা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করে নেবে। প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং সরকারী শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য যার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার কোন অংশীদারিত্ব নেই তাতে যাকাত ফরয হবে না। তবে যে সকল সরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি মালিকানার অংশীদারিত্ব রয়েছে তাতে শুধু ব্যক্তি মালিকদের অংশের উপর যাকাত ফরয হবে, সরকারী অংশের উপর যাকাত ফরয হবে না।
শেয়ার ও বন্ড আধুনিক অর্থনীতিতে একটি বহুল পরিচিত নাম। যে সকল শেয়ার ক্রেতা শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়কে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে এবং বিক্রয়ের জন্যই শেয়ার ক্রয় করে থাকে শেয়ারের মূল্যই তাদের ব্যবসায়ী সম্পদ। সুতরাং তাদের মালিকানাধীন শেয়ারের মূল্যকে ব্যবসায়ী সম্পদ হিসেবে ধরে নিয়ে বছরান্তে যথা নিয়মে তার উপর যাকাত ফরয হবে। আর যার মূল প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হওয়ার জন্য শেয়ার ক্রয় করে তাদের হিসেব হবে মূল প্রতিষ্ঠানের হিসেবের সাথে।
সুদভিত্তিক অর্থনীতি নির্ভর ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড এবং অনৈসলামী বীমা কোম্পানীর শেয়ার বাবদ প্রাপ্ত লাভ সুদ হিসেবে গণ্য বিধায় সরাসরি হারাম ও অবৈধ। হারাম ও অবৈধ হওয়ার কারণে লাভের সম্পূর্ণ অংশ ছওয়াবের নিয়্যাত ছাড়া গরীব-মিসকীনদের দান করে অথবা জনহিতকর কাজে ব্যয় করে দায়মুক্ত হওয়া আবশ্যক। এসকল বন্ডের আসল ও মূলধনের উপর যথা নিয়মে যাকাত ফরয হবে।
যাকাত ব্যয়ের খাত
যাকাতের অর্থ যাদেরকে প্রদান করা যায় ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় তাদেরকে যাকাতের মাসরাপ বলা হয়। আল-কুর’আনে যাকাতের মাসরাফ বা ব্যয়ের খাত ৮টি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إنما الصدقت للفقرآء والمساكين و العاملين عليها والمؤلفة قلوبهم و فى الرقاب والغارمين وفى سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله و الله عليم حكيم
“সাদাকা (যাকাত) ও কেবল মাত্র ফকীর, মিসকীন ও যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, গোলাম আজাদ করার জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফীরদের জন্য- এটি হলো আল্লাহর বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।”
আল-কুর’আনে বর্ণিত উপর্যুক্ত ৮টি খাতের সংপ্তি ব্যাখ্যা নিুরূপ:
১. ফকীর (الفقير): আল-কুর’আনে যাকাত ব্যয়ের খাত হিসেবে সর্ব প্রথম ফকীরকে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী কথন রীতি অনুযায়ী সর্ব প্রথমে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। তাই আল-কুর’আনেও এ রীতি অনুসরণ করে যাকাতের হকদার হিসেবে সর্বপ্রথম ফকীরকে উল্লেখ করা হয়েছে। ফকীহ্গণের মতে, যে ব্যক্তি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক নন সেই ফকীর। যদি কারো কাছে নিসাব পরিমান সম্পদ থাকে যা তার প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় তবে এ অবস্থাতেও সে ফকীর হিসেবে গণ্য হবে। ফকীর মিসকীন অপো নিঃস্ব নয়। ইব্ন ‘আব্বাস, হাসান আল-বাসরী, মুজাহিদ, ‘ইকরামা ও জহুরীর মতে, ফকীর এমন ধরণের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এেেত্র ফকীরের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফি‘ঈর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবী নয় এবং যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানীফাসহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন, الفقير أحسن حالاً من المسكين و من الناس
“মিসকীন অপো ফকীরের অবস্থা উত্তম।”
২. মিসকীন (المسكين): মিসকীন বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোষাকের জন্য অন্যের মুখাপেী হয়। কেউ কেউ বলেন, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার দারিদ্র চরম সীমায় পৌঁছেনি বটে কিন্তু তাকে সাহায্য না করা হলে সে এরূপ অবস্থায় উপনীত হয়ে পড়বে। ইব্ন যায়দ বলেন, মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে অভাবগ্রস্থ কিন্তু মানুষের কাছে চায়না। মুহাম্মাদ ‘আলী আস-সাবূনীর মতে, মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কোন কিছুই নেই। ইউনূস বলেন, আমি জনৈক ‘আরব বেদুঈনকে বললাম, তুমি কি ফকীর? তদুত্তরে সে বললো, আল্লাহর কসম আমি ফকীর নই, বরং মিসকীন। আল-তাবারী বলেন, সে অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ফকীর বলা হয়, যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রা করে চলে, কারো কাছেই কোন কিছুই প্রার্থনা করে না। আর মিসকীন হচ্ছে এমন অভাবী ব্যক্তি, যে ভিা করে বেড়ায়। তাঁর এ ব্যাখ্যার সমর্থনে উল্লেখ করেন যে, মাসাকানাহ শব্দটি দারিদ্রকেই বুঝায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে বলেন, وضربت عليهم الذلة والمسكنة
ফকীর ও মিসকীনের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও শব্দ দু’টি ইসলাম ও ঈমান শব্দদ্বয় ব্যবহারের মত। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, এ দু’টি শব্দ এক স্থানে ব্যবহৃত হলে তাৎপর্য ভিন্ন ভিন্ন হবে। তখন প্রতিটি শব্দের একটি বিশেষ অর্থ হবে। আর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হলে শব্দ দু’টির অর্থ হবে অভিন্ন।
আবার কেউ কেউ ফকীর ও মিসকীনের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন এভাবে যে, ফকীর কোন কিছু চাইতে লজ্জাবোধ করেনা, কিন্তু মিসকীন শুধু ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার কারণে অন্যের নিকট অবজ্ঞা করতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সা.) হাদীছ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন,
ليس المسكين الذى ترده التمرة والتمرتان ولا اللقمة و لا اللقمتان وإنما المسكين الذى يتعفف وإقرءوا إن شئتم يحن قوله لايسئلون الناس الحافًا
“সেই লোকটি মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দু’টি খেজুর অথবা দু-এক গ্রাম খাদ্যের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন তো সেই লোকটি, যে কারো কাছে চায় না। (মিসকীন সম্পর্কে জানতে হলে) তোমরা কুরআনের আয়াত لايسألون إلحافا “তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায়না” পাঠ করো।”
৩. ‘আমিল (العامل): যাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘আমিল বলা হয়। সরকার যাদেরকে যাকাত আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত করে তাদের ও তাদের সহযোগীদেরকে যাকাতের মাল থেকে এই পরিমাণ অর্থ প্রদান করা যাবে যার দ্বারা যাকাত আদায়কালীন সময়ে তাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা যথেষ্ট হয়। তবে তাদের এ ব্যয় বহন মধ্যম প্রকৃতির হতে হবে। যদি এমন হয় যে, ‘আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে সে েেত্র তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশি দেয়া যাবে না।
যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। তা যাকাতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। যেমন- কোন লোকের উপর এবং কোন্ মালের যাকাত ধার্য হবে, যাকাতের পরিমান কত হবে, যাকাত কে কে পেতে পারে, তাদের প্রয়োজনের চূড়ান্ত মাত্রা বা পরিমাণ কত, কত পেলে তাদের জন্য যথেষ্ট হয় অথবা প্রয়োজন মিটে এসব নির্ধারণ করা তাদেরই বড় কাজ। এেেত্র বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য দু’টি সংস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। ১. যাকাত আদায় বা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। ২. যাকাত বন্টনকারী প্রতিষ্ঠান।
৪. মুআল্লাফাতুল কুলূব (مؤلفة القلوب): ইসলামের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি জন্য যাদেরকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা হতো তাদেরকে মুআল্লাফাতুল কুলূব বলা হয়। মুআল্লাফাতুল কুলূব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ইমাম কুরতুবী বলেন,
وهم قوم كانوا فى صدر الاسلام ممن يظهر الاسلام يتألفون بدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم
“তাদেরকে মুআল্লাফাতুল কুলূব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দূর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা।” এ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরী বলেন,
المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا
“ইয়াহুদী অথবা খিষ্ট্রানদের মধ্য থেকে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাকেই মুআল্লাফাতুল কুলূূব বলা হয়। যদিও তিনি ধনী হন।” ইমাম ইবনু জারীর আল-তাবারীর মতে,
و أما المؤلفة قلوبهم فإنهم قوم كانو يتألفون على الإسلام ممن لم تصرح نصرته إستصلاحا به نفه وعشيرته.
মুহাম্মদ আলী আস-সাবূনী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন,
هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام.
“مؤلفة قلوبهم হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব মহানবী (সা.) ইসলামের জন্য তাদের অন্তর জয় করার নিমিত্ত্বে উপঢৌকন দিতেন।”
এ শ্রেণীর লোকদেরকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. কাফির শ্রেণী। যাকে অর্থ বা উপঢৌকন দিলে তার গ্রোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করবে বলে আশা করা হয়। এ মতের সমর্থনে নিম্নোক্ত হাদীছ যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে:
إن النبى صلى الله عليه وسلم أعطنى صفوان بن امية من غنائم حنين وقد شهدها مشركا قال فلم يزل يعطنى حتى صار ائب لناس إلىّ
“নবী করীম (সা.) সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল থেকে দান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, নবী করীম (সা.) এরূপ ভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীকালে তিনি নবী করীম (সা.) এর মহানুভবতায় আকৃষ্ট হয়ে, ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
দুই: শত্র“ পরে প্রতিবন্ধকতা ও শত্র“তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাদেরকে কিছু দান করা। অনেক দেশের সীমান্তে অমুসলিম দেশ অবস্থিত। তাই শত্র“ দেশের সীমান্তে আক্রমণ হলে যারা প্রতিরামূলক কাজ করে মুসলিম সমাজকে রা করতে পারে তাদেরকে যাকাত ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে।
তিন: দূর্বল ঈমানের মুসলমানেরাও এই শ্রেণীভূক্ত। তাদেরকে অর্থ দান করা হলে তাদের ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের নিকট থেকে আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা.) এই শ্রেনীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণিমতের মাল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শ পালনে তাদের দৃঢ়তা অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিল।
চার: নতুন ইসলাম গ্রহণকারী লোকেরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। কেননা তারা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাদের পিতামাতার ও বংশ পরিবারের ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলশ্র“তিতে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়। এজন্য তাদেরকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাদের অনুরক্ততা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
পাঁচ: বর্তমান যুগে কুফুরী শক্তি মুসলমানদের মনোতুষ্টি সাধন করার জন্য তাদেরকে স্বপে কিংবা তাদের ধর্মে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহ মুসলমানদেরকে দাস বা গোলাম বানানোর চেষ্টায় রত আছে। এতদ্দুদ্দেশ্যে তারা অপরিমেয় ধনসম্পদ ও কলা-কৌশল ব্যয় ও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংস করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এমতাবস্থায় যাকাতের ফাণ্ড থেকে লোকদের মনতুষ্ট সাধনের জন্য এবং ইসলামের উপর অটল রাখার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
যাকাতের এই খাতটি সাহাবীগনের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে রহিত হয়ে গিয়েছে বলে কোন কোন ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন। তাদের এই মতের বিপরীতে বলা যায় যে, এই বিষয়ে ইজমা‘ হওয়ার ব্যাপারটি হযরত উমর (রা.)-এর যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। হাদীছের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, পরবর্তীকালে এর কার্যকারিতা রহিত হয়। এ বিষয়ে ইবনু আবিদীন স্বীয় গ্রন্থে ইজমা‘ রহিত হওয়া প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
لا إجماع الا عن مستند يجب علمهم بدليل أفاد نسخ ذلك قبل وفاته صلى الله عليه وسلم أو تقييد الحكم بحياته أو كونه حكمًا مغيا بإنتهاء علته وقد اتفق انتهاوءها بعد وفاته صلى الله عليه وسلم.
৫. আর রিকাব (الرقاب): দাস বা দাসীমুক্তিকে রিকাব বলা হয়। অত্র আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, যে দাস বা দাসী মুনিবের সাথে চুক্তি করেছে যে, সে তাকে এত টাকা দিয়ে দিলে মনিব তাকে মুক্ত করে দেবে। যাকাতের অর্থ দিয়ে এই চুক্তি পূরণে তাকে সাহায্য করা হবে। মহান আল্লাহ যাকাতের একটি অংশ তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বর্তমান যুগে এ দাসপ্রথা না থাকায় যাকাতে তাদের এ অংশটি দ্বারা যুদ্ধবন্দী মুক্ত করা যেতে পারে। কাযী ইবনুল ‘আরাবী আল-মালিকী লিখেছেন যে, যাকাতের টাকা দিয়ে বন্দী মুক্ত করণের েেত্র ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ পরিলতি হয়। ফকীহ আল-আতবাক লিখেছেন যে, তা যায়িয হবে না। ইব্ন হাবীব এর মতে অবশ্যই বৈধ হবে। যাকাতের অর্থ দিয়ে মুসলিম বন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করা অধিক উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাফসীরকার সায়্যেদ রশীদ রিযা লিখেছেন, ফীর রিকাব বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ বিষয়ে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শায়খ প্রফেসর মাহমূদ শালতুত লিখেছেন যে,
ولكن فيما أرى قد حل محله الآن، رق هو اشد خطرا منه على الإنسانية، ذلكم هو إسترقاق الشعوب فى أفكارها، وفى أموالها وسلطانها وحريتها فى بلادها.
৬. আল-গারিমূন (الغارمون): আল-গারিমূন দ্বারা ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। ইবনুল হুমাম লিখেছেন যে, গারিমূন হচ্ছে, সেই সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করতে পারছেনা তাকেও গারিমূন বলার প্রচলন আছে। এই সমস্ত লোকের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই বলে তাদের উপর যাকাত ফরয হয়না। এ প্রসঙ্গে আল-তাবারী বলেন,
أما الغارمون فالذين استد انوا فى خير معصية الله ثم لم يجدوا قضاء فى عين ولاعرض.
“গারিমূন হলো, তারাই যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য অর্থ ঋণ করেছে।”
আল-তাবারী কর্তৃক গারিমূন এর এ সংগায় সে সমস্ত লোক অন্তর্ভূক্ত যারা আকস্মিকভাবে জীবনের কঠিনতম বিপদে নিপতিত হয়েছে। তারা এমন সব আঘাত পেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে যে, তাদের ধন-মাল সব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় তারা প্রয়োজনবশতই নিজের এবং পরিবারবর্গের জন্য ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এ সমস্ত লোকদেরকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। যাকাত দ্বারা যেমন জীবিত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা যায় তেমনি মৃত ব্যক্তির ঋণও কি পরিশোধ করা যাবে কিনা এ বিষয়ে ইমাম নববী দু’টি মত উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে, তা জায়েয নয়। অপরটি জায়েযের স্বপ।ে কেননা আয়াতে সাধারণভাবেই ঋণগ্রস্থদের কথা উল্লেখিত হয়েছে। অতএব মৃত্যুকে জীবিতের ন্যায় মনে করেই তার ঋণও পরিশোধ করা যাবে। ইমাম আল-কুরতুবী এ মতের স্বপে যুক্তি দেখিয়ে নিম্নোক্ত হাদীছ উল্লেখ করেন:
أنا أولى بالمؤمن من نفسه من ترك مالاً فلاهله ومن ترك دينًا أوضياعًا فإلىّ وعلىّ.
“প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির জন্য আমি তার নিজের থেকে অধিক আপন। যে লোক ধন-মাল রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। আর যে লোক ঋণ অথবা (বলেছেন) অসহায় সন্তানাদি রেখে যাবে তা আমার উপর ন্যস্ত হবে।”
হানাফী মাযহাব মতে, মৃত্যু ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে হানাফী ফকীহ ইবনু ‘আবিদীন বলেন,
لايسرف إلا بناء مسجد ولا إلى كفن ميت و قضاء دينه.
“যাকাতের অর্থ মসজিদ নির্মাণ, মৃত্যু ব্যক্তির কাফন ও তার ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় করা যাবে না।”
এ মতের পে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে যে, মৃত্যু হওয়ার কারণে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ দাতার যিম্মাদারী থেকে মুক্ত হয়েছেন। তবে বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ইবনুল হুমাম কতিপয় ফকীহর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে,
المفيد لو قضا بها دين حى أو ميت بأمره جاز.
“যদি জীবিত অথবা মৃত্যু ব্যক্তির অসিয়তক্রমে যাকাতের অর্থ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হয় তাহলে তা বৈধ হবে।”
হানাফী ফকীহ্গণের এ ধরণের মতামত নীতিবাচক বা আংশিকভাবে ইতিবাচক হলেও এ বিষয়ে স্পষ্ট হাদীছ বিদ্যমান থাকায় অথবা মৃত্যু ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধের অসিয়তের প্রতি দৃষ্টি রেখে ঋণের রাহু গ্রাস থেকে মৃত্যু ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করাই যুক্তিযুক্ত।
৭. ইবনুস সাবীল (ابن السبيل): ইবনুস সাবীল দ্বারা ঐ পথচারী মুসাফিরকে বুঝানো হয়েছে, যে শহর থেকে শহরান্তরে এবং দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণরত। নিবাসে সে ধনী হলেও প্রবাসে সে রিক্তহস্ত হওয়ায় তাকে যাকাতের অর্থ দেয়ার কথা আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এমর্মে আল-তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের নিঃস্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
হানাফী ফকীহগণের এ বিষয়ে বক্তব্য হলো, যাকাতের অর্থে এ ধরণের নিঃস্ব মুসাফিরের হক রয়েছে। তবে পারলে তার ঋণ না নেয়াই উত্তম, কর্তব্য নয়। কেননা এ ঋণ পরিশোধে সে অম হয়ে পড়তে পারে। তবে কতটুকু সম্পদ তাকে দেয়া যাবে এ বিষয়ে হানাফীদের দু’টি মত পাওয়া যায়। প্রথমটি হলো, যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবেনা। অপর মত হলো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। উস্তায আহমদ মুস্তফা আল-মারাগী মনে করেন যে, বর্তমান যুগে ইবনুস সাবীল ধরণের লোক দেখতে পাওয়া যায়না। কেননা এ যুগের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিজ্ঞান উন্নত হওয়ায়, গোটা পৃথিবী যেন এক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া লোকদের উপায়-উপকরণও বিপুল ও সহজলভ্য। পৃথিবীর যে কোন স্থানে বসে মানুষ ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে স্বীয় ধন-মাল নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতার নীরিখে মারাগীর এমত বিশ্লেষণ করলে এটি ইতিবাচক মন্তব্য বলে প্রতীয়মান হয়না। কেননা এখনও মানুষ একমাত্র দ্বীনি উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করছে। সে তার এ ভ্রমণ পথে যে কোন কারণে রিক্ততা তার স্কন্ধে আরোহন করতে পারে। এমতাবস্থায় তার সাহায্যের মুখাপেী হওয়া অবাস্তব কিছু নয়। তবে যারা একমাত্র ভ্রমণ উৎসব পালনের জন্য বহির্বিশ্বে গমন করে তাদের বিষয়টি ইবনুস সাবীলের আওতাভুক্ত নয় বলে উস্তাদ শালতূত মনে করেন।
৮. ওয়া ফী সাবীলিল্লাহ (و فى سبيل الله): ওয়া ফী সাবীলিল্লাহ দ্বারা স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে। ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা-সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানের কাজে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলমানদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ বল দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদেরকে সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরয যাকাতের একটি অংশরূপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহর পথে গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করার জন্য। যেমনিভাবে মু’মিনদেরকে সাধারণত: তাদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশ্বে প্রচলিত চারটি মাযহাবের নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে সাবীলিল্লাহ দ্বারা সামরিক ও স্বশস্ত্রতার অর্থে জিহাদ ও যুদ্ধকে বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন সাম্প্রতিককালে মুসলিম বিশ্বে ঘটমান যুদ্ধ ইসলামী যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ হচ্ছে জাতীয় বা স্বদেশিক পর্যায়ের যুদ্ধ। জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে অস্ত্র ধারণ করা আসলে বৈষয়িক যুদ্ধ বৈ আর কিছুই নয়। দ্বীনের সাথে তার দূরতম ও সম্পর্ক নেই। অতএব এসব যুদ্ধ কখনই ফী সাবীলিল্লাহ বলে গণ্য হতে পারেনা। আর এজন্যই এসব যুদ্ধে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা বৈধ নয়। তাদের এ ধারণা বিশ্লেষণ সাপে। ইসলামী জিহাদ কেবলমাত্র সেসব রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় যা সাহাবায়ে কিরামের যুগে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বিদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিসমূহ দমন বা উৎখাতের নামে যেসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে এর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াই বড় জিহাদ। সাহাবী ও তাবি‘ঈগণের যুদ্ধ যখন ইসলামী দা‘ওয়াত সংরণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল, তখন নূরুদ্দীন, সালাহুদ্দীন ও কুতুজের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের দেশ ও ভূমি রার উদ্দেশ্যে। আর জিহাদ যেমন ফরয হয়েছে ইসলামী ‘আকীদাহ- বিশ্বাস রার্থে তার সমর্থনে, তেমনি ফরয হয়েছে ইসলামী দেশ রার জন্যও। কেননা ইসলামী ‘আকীদাহ-বিশ্বাস ইসলামী দেশের মতই। এ দু’টিরই পূর্ণ সংরণ এবং আক্রমণকারীদের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া একান্তই আবশ্যক।
৪. আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণে যাকাত
যাকাতের ধর্মীয়, নৈতিক ও নানাবিধ ইতিবাচক উদ্দেশ্য থাকলেও এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য সবিশেষ গুরুত্ববহ। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ একটি মারাত্মক অপরাধ। সম্পদের ব্যাপক ব্যয়-ব্যবহার এবং বিনিয়োগই হচ্ছে তার জন্য স্বাভাবিক ব্যবস্থা। যাকাত এ ব্যবস্থার বাস্তব সাংগঠনিক পদ্ধতি এটি সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের প্রধান প্রতিরোধক। কেননা ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু অপছন্দই করে না বরং তা দুরীভূত করার কথাও বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা-ই নয়, সমাজে আয় বন্টনের েেত্র বৈষম্য অনেক খানি হ্রাস পাবে।
সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য আজ বিশ্বে ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক মিশ্র অর্থনৈতিক পদ্ধতির উন্মেষ ঘটেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে উল্লিখিত উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে সফল করা সম্ভব হয়নি। এ সব অর্থনৈতিক পদ্ধতি মানবীয় কল্যাণকে করেছে সংকুচিত। এতে বিশেষ ব্যক্তি ও বুর্জুয়ারা লাভবান হয়েছে। তারা শোষণের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে পাহাড়তুল্য সম্পদ। ফলে সমাজে স্বল্পবিত্ত ব্যক্তিরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র ইসলামই চায় ধনশালীরা যেন অতিরিক্ত সম্পদকে যাকাতের মাধ্যমে অপোকৃত গরীবদের মাঝে ব্যয় করে যা উভয়ের েেত্র কল্যাণ বয়ে আনবে এবং ধন-সম্পদের আবর্তণে গোটা অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটে। বিশেষ করে স্বল্পবিত্ত লোকেরা যেন তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ লাভ করতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সুনিশ্চিত হবে অন্যদিকে ধনী-গরীবের আয়ের বৈষম্যও বহুলাংশে লাঘব হবে। এ েেত্র উভয়ের মাঝে যাকাত হলো আল্লাহ প্রদত্ত সেতুবন্ধন। এদিকেই ইংগিত করে কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, كَىْ لاَيَكُوْنَ دَوْلَةً بَيْنَ الاَغْنِيَآءِ مِنْكُمْ “যেন সম্পদ তোমাদের কেবল ধনীদের মধ্যেই আবর্তন না করে।” সামাজিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের যে সমস্ত ক্ষেত্রে যাকাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেগুলো নিম্নরূপ:
৪.১ দারিদ্র্য বিমোচন
ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা দারিদ্র বিমোচনের েেত্র একটি সুনিশ্চিত কার্যকর পন্থা। এতে শুধু সমাজই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হয় সমানভাবে। দরিদ্রতা যে কোন দেশ ও সমাজে একটি জটিল ও তীব্র সমস্যা। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধও ঘটে এই দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থ সম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি কর্ম সংস্থানেরও সুযোগ হয়। বাংলাদেশে যাকাত, ‘উশর, খনিজ সম্পদ ও প্রাণীকুলের যাকাত শরী‘আত নির্ধারিত নিয়মে বাধ্যতামূলকভাবে আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র মোচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে খুব বেশী নয় মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব।
আল-কুরআনে বর্ণিত যাকাতের অর্থ ব্যয়ের যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে তাতে প্রথম খাতেই রয়েছে দরিদ্র ও অভাবী লোকদের মধ্যে যাকাতের অর্থ সামগ্রী বন্টন করা। এতে শুধু অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয় বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিবেগের সঞ্চার হয়। যাকাতের অপর হিতকর ও কল্যাণধর্মী দিক হলো, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মুক্তি ও প্রবাসে বিপদকালে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন প্রয়োজন মোকাবিলার কারণে যদি কেউ ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং সে উক্ত ঋণ পরিশোধের সামর্থ হারিয়ে ফেলে তাহলে যাকাতের অর্থ দিয়েই সংকট মোচন করা যায়। দেউলিয়া হয়ে সমাজে অসম্মানিত জীবন যাপনের গ্লানি মোচনে যাকাত এক মোম হাতিয়ার।
৪.২ কল্যাণমূলক কর্মসূচী
যাকাতের অর্থ দিয়ে যদি দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষদেরকে কর্মম করার জন্য পুনর্বাসন প্রশিণ এবং কর্মসংস্থানমূলক কল্যাণধর্মী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য সত্যিকার অর্থে বিদায় নিবে। এ প্রস্তাবিত কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিধবা, বিকলাঙ্গদের কল্যাণ, বৃদ্ধদের জন্য মাসহারা, কন্যাদায়গ্রস্তদের সাহায্য, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণের সাহায্য, এতিমদের প্রতিপালন, স্মরণার্থী সহায়তা ও উদ্বাস্ত পুনর্বাসন এবং অভাবী সাধারণ জনগণের সুচিকিৎসার জন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক মেডিকেল সেন্টার স্থাপন। এ ছাড়া যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীবদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার নিমিত্তে রিক্স্রা, ভ্যান কিনে দেয়া থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন ধরণের হালাল ব্যবসায় পুঁজি যোগান দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করা যেতে পারে।
৪.৩ শিা ও প্রশিণমূলক কর্মসূচী
যাকাতের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে শিা ও প্রশিণমূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসলামী শিা বিস্তারের জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীব ছাত্রদের বই কিনে দেয়া থেকে শুরু করে তাদের জামা-কাপড় ও লিল্লাহ বোডিং-এ থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া গরীব ও মেধাবী ছাত্রদেরকে তাদের শিা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিা বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কম্পিউটার প্রশিণ প্রদানের মাধ্যমে গরীব জনশক্তিকে অধিকতর উৎপাদনমুখী করা যেতে পারে এই অর্থ দিয়েই। এ ছাড়া ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ ও প্রসারের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করে জনসাধারণকে ইসলামমুখী করা যেতে পারে। যাকাত ব্যয়ের খাতে উল্লিখিত وَفِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ দ্বারা এর বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
৪.৪ কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচী
যাকাতের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচী সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। গরীব কৃষকদের গরুর বলদ ক্রয়ে এ অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। এ ছাড়া এ অর্থ দিয়ে ুদ্র আকারের উৎপাদনমুখী কর্মসূচী যেমন, চাল, চিড়া, মুড়ি তৈরী, নার্সারী তৈরী, তাঁত সামগ্রী তৈরী, হাঁস-মুরগী পালন, মাছের চাষ, সেলাই মেশিন, ইলেক্ট্রিক সামগ্রী মেরামত, রিক্সা-ভ্যান তৈরী ও মেরামত ইত্যাদি। এ ছাড়া ুদ্রাকারের ব্যবসা, যেমন মুদি দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, মাছের ব্যবসা, ফলের ব্যবসা ইত্যাদি পরিচালনা করা যেতে পারে। যাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায় মহিলাদেরকে এ অর্থ দিয়ে সেলাই কাটিং বুটিকসহ বিভিন্ন কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরী করার প্রশিণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা যেতে পারে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক লোক বন্যা, নদী ভাংগন ও অগ্নিকান্ডে তাদের ঘর-বাড়ী হারায়। যাকাতের অর্থ দিয়ে এ বাস্তুহারা মানুষদেরকে গৃহ নির্মাণে সহায়তা করে তাদেরকে বাস্তুর সন্ধান দেয়া যেতে পারে।
৪.৫ দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী
আল্লাহর যমীনে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাকে ফরয করা হয়েছে। এ েেত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। আল-কুর’আন এ েেত্র যাকাত লব্ধ অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বরা হয়েছে,
لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللَّهِ لاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَربًا فِى الاَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تعْرِفُهُمْ بِسِيْمهُمْ
“এটি প্রাপ্য অভাবগ্রস্থ লোকদের, যারা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য যমীনে পদচারণা করতে সম হয় না এবং আত্মসম্ভ্রমের কারণে কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে তাদের মুখমন্ডলে দরিদ্রের ছায়াপাতের কারণে চিনতে পার।” দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে খৃষ্টান মিশনারী ও এনজিওদের অপতৎপরতা মোকাবেলা করার ল্েয বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী পাঠাগার স্থাপন করা যেতে পারে। যাকাত ব্যবস্থা শুধু দুঃস্থের পুনর্বাসনেই নয়, সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব প্রতিরোধের েেত্র যাকাত মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলামী সরকার বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় করলে ইসলামী জনতা তা আল্লাহর হুকুম পালন ও ইবাদত মনে করে সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ ও প্রতিবিপ্লবের উদ্যোগ গ্রহণ করবে না।
৪.৬ উৎপাদন বৃদ্ধি
যাকাত যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে তেমনি অর্থনীতিতে উৎপাদনও বৃদ্ধি করে। যাকাতে অর্থ নিস্ব ব্যক্তিদের ভিার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে। যে কোন উৎপাদন কাজে শ্রমের সাথে পুঁজির সংযোজন অনস্বীকার্য। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে বিশ্ময়কর উন্নয়ন ঘটাতে পারে, কাজে লাগাতে পারে অসংখ্য প্রকৃতির সম্পদকে, পারে মরুভূমিকে উর্বর জমিতে পরিণত করতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার যা অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি দ্রব্য (চৎড়ফঁপবৎ মড়ড়ফং) বলা হয়ে থাকে। পুঁজির অভাবে বহু কর্মম দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেকারত্ব জীবন-যাপন করছে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে এই সকল দরিদ্র জনশক্তিকে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
৪.৭ শ্রমিক সরবরাহ
শ্রমিক সরবরাহ সংক্রান্ত নিওকাসিকাল তত্ত্ব থেকে প্রতিয়মান হয় যে, যাকাত অর্থনীতিতে শ্রমিক সরবরাহের ক্ষেত্রে ধ্বণাত্ত্বক প্রভাব ফেলে। এই তত্ত্বে শ্রমিক সরবরাহ ব্যষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য হয়ে থাকে। যেখানে একজন শ্রমিক কাজের মাধ্যমে আয় উপার্জন ও অবসর এ দুই-এর সমন্বয়ে ভারসাম্য বিন্দুতে পৌঁছে। এ তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলামি অর্থনীতিতে যাকাত কিভাবে শ্রমিক সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলে তা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এভাবে।
ধরা যাক, একজন শ্রমিকের প্রাথমিক ভারসাম্য বিন্দু ছিল অ যা উপযোগ রেখা ট১ এর উপর অবস্থিত। এই অবস্থায় সে ভারসাম্য বিন্দুতে অবস্থান করছিল। দরিদ্র অবস্থায় কোন মূলধন দ্রব্য না থাকায় দৈহিক পরিমাপ করে কাজ করতে কষ্ট হয়, বিধায় অল্প কাজে যা আয় হতো তার উপর সন্তুষ্ট থাকে এবং অধিকাংশ সময় অবসরে কাটায়। যাকাতের অর্থ পাওয়ায় তার পূর্বের বাজেট রেখা গঘ, স্থানান্তরিত হয়ে গচছ এসেছে। এমতাবস্থায় তার পূর্বের চেয়ে আয় বেড়ে যাওয়ায় অপোকৃত উচু নিরপে রেখা ট২ এর সাথে ই বিন্দুতে ভারসাম্য পৌঁছিয়েছে। ভারসাম্য বিন্দু অ থেকে ই তে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য অবসর পূর্বের ঙজ থেকে ঙঝ এ নেমে আসে। অর্থাৎ এ েেত্র অবসরকে কমিয়ে কাজের মাধ্যমে আয় উপার্জনের দিকে উৎসাহিত হয়। ফলে শ্রমিক সরবরাহ বৃদ্ধি পায়।
৫. জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা ও যাকাত
মানব চিন্তাধারায় গঠিত আধুনিক পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নে ব্যর্থ হওয়ার ফলে যাকাত ভিত্তিক জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র ও ধনীকে আরো ধনী করে তুলতে সহায়তা করার ফলে সমাজে একটি অসম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে জাতীয় উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তাই সমাজে সুষম উন্নয়নের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।
৬. উপসংহার
মানব জীবনে আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন এবং মানব কল্যাণমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করলে সমাজে ধনী ও গরীবের মাঝে যে বিস্তার ব্যবধান রয়েছে তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এ ছাড়া পুঁজিবাদী আগ্রাসন, সমাজে দীনতা ও অভাবের ফলে যে অপরাধ প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। আজকে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত ‘ওশরসহ সকল প্রকার সাদাকাহ্ সংগ্রহ করে দরিদ্র, দুঃস্থ, ফকীর, মিসকীন, বেকার লোকদের সচ্ছলতা দানের উদ্দেশ্যে তাদের জন্য বৃহৎ-মাঝারি ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা ও কল্যাণমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবী। এতে করে সমাজে বেকার সমস্যার সমাধান ঘটবে এবং সমাজ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ। দারিদ্র দূরীকরণের প্রধান দিক হলো পল্লী জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন। কারণ দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পল্লী অঞ্চলেই বসবাস করে থাকে। তাই দারিদ্র দূর করতে হলে সর্বপ্রথমে পল্লী অঞ্চলের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ইত্যাদি দেশী-বিদেশী অনেক এনজিও সহ দেশের সরকারী ও আধাসরকারী বহু প্রতিষ্ঠান এ সংস্থা দারিদ্র বিমোচনে ঋণদানে এগিয়ে আসলেও এখানে ঋণ সুদভিত্তিক হওয়ায় পল্লী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে বহুলাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এর অর্থ গরীব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনা সুদে বিনিয়োগ করা হলে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব।